বুধবার, ৩০ আগস্ট, ২০২৩ ০০:০০ টা

বেশি ঝুঁকিপূর্ণ ভবন উপজেলায়

ভবন নির্মাণে ইঞ্জিনিয়ারের পরামর্শ নেই, মানা হচ্ছে না কোনো নিয়ম রাজমিস্ত্রিই সব

হাসান ইমন

দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের ফলে বাড়ছে কংক্রিট ভবনের সংখ্যা। ইটপাথর দিয়ে মোড়ানো ভবনের সংখ্যা শুধু শহরে নয়, উপজেলা ও গ্রামেও হুহু করে বাড়ছে। আর্থিক সচ্ছলতার কারণে গ্রামের মানুষ এখন পাকা বাড়ির দিকে ঝুঁকছে। এক তলা, দোতলা এমনকি পাঁচ-ছয় তলা বাড়িও নির্মাণ হচ্ছে। এসব বাড়ি বা ভবন নির্মাণে ইঞ্জিনিয়ারের পরামর্শ নেওয়া হয় না। রাজমিস্ত্রিই সব। তিনি একাই ড্রয়িং ডিজাইন করে থাকেন। খরচ কমানোর জন্য তার পরামর্শে মানহীন নির্মাণসামগ্রী ব্যবহার হয় ভবনে। ফলে ভূমিকম্পের মতো দুর্যোগ হলে শহরের মতো উপজেলা ও গ্রাম পর্যায়ে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা

বিশেষজ্ঞরা আরও বলছেন, উপজেলা বা ইউনিয়ন ও গ্রাম পর্যায়ে এক, দুই ও তিন তলা পর্যন্ত অহরহ নির্মাণ হচ্ছে। আর উপজেলা পর্যায়ে পাঁচ-ছয় তলা নির্মাণ হচ্ছে। যেটার বেশির ভাগই নিয়ম মানা হচ্ছে না। ভবন নির্মাণে মাটির ভার বহন পরীক্ষা, আর্কিটেকচারাল ও স্ট্রাকচারাল, ইলেকট্রিক্যাল ডিজাইন, প্লাম্বিং এবং ফায়ার সার্ভিস থেকে অনুমোদন নেওয়ার সরকারি বিধান রয়েছে। কিন্তু কেউই অনুমোদন নেন না। সেখানে রাজমিস্ত্রি সব করে থাকেন। ড্রয়িং, ডিজাইনসহ সব পরিকল্পনা তিনিই করেন। একই সঙ্গে ভবনের জন্য গুরুত্বপূর্ণ বিম ও পিলার। যেখানে মিক্সার মেশিন দিয়ে বালু, সিমেন্ট ও পাথর মিক্স করতে হয়। কিন্তু উপজেলা ও ইউনিয়ন পর্যায়ে রাজমিস্ত্রিরা হাতেই এসব মিক্সড করে থাকেন। যেটা ভবনের জন্য খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। এ ছাড়া মানহীন রড, সিমেন্ট, বিদ্যুতের ক্যাবলসহ নিম্নমানের নির্মাণসামগ্রী ব্যবহার করেন। আবার অনেকে অনভিজ্ঞ নামধারী নির্মাণ প্রকৌশল প্রতিষ্ঠান দিয়ে ডিজাইন করে থাকেন। তারা ১০-১২টি এ-৪ সাইজের কাগজে কিছু লাইন এঁকে অসম্পূর্ণ ডিজাইনগুলো খুবই অল্প টাকায় ভবন মালিকের হাতে তুলে দেয়। এই অসম্পূর্ণ ডিজাইন নিয়ে ভবন মালিক মিস্ত্রিকে দেন কাজ করতে। মিস্ত্রি ডিজাইনে সব মেজারমেন্ট না পেয়ে নিজের মতো করে কাজ করে ফেলেন। এতে প্রায় মিস্ত্রিই ভুল করে থাকেন। ফলে ভবন মালিকরা ক্ষতির মুখে পড়েন। এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ড. মোয়াজ্জেম হোসেন বলেন, ‘শহরের মতো দুর্যোগপ্রবণ এলাকা তৈরি হচ্ছে উপজেলা পর্যায়েও। কারণ ভবন নির্মাণে উপজেলা পর্যায়ে অধিকাংশ মানুষ কোনো ইঞ্জিনিয়ারের পরামর্শ নেয় না। ফলে ভবনের বিম, পিলারসহ গুরুত্বপূর্ণ অংশ নিয়ম অনুযায়ী করা হয় না। এতে ঝুঁকিতে পড়ে ভবনটি। দেশে ভূমিকম্পের মতো দুর্যোগ এলে শহরের মতো উপজেলা পর্যায়েও অনেক ক্ষয়ক্ষতি হবে।’ তিনি আরও বলেন, ‘সরকার এ বিষয়ে কমিটি করে ক্ষান্ত হলে হবে না। আরও জোর দিতে হবে। তদারকি বাড়াতে হবে।’ এদিকে ২০১৭ সালের ১০ জুলাই স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় থেকে ‘উন্নয়ন কর্তৃপক্ষসমূহের আওতাবহির্ভূত উপজেলা ও ইউনিয়ন পরিষদের অধিক্ষেত্রাধীন এলাকা স্থাপনার নকশা অনুমোদন এবং ভবনের গুনগত মান নিশ্চিতকরণ’ আইন পাস করে গেজেট প্রকাশ করা হয়। প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, স্থানীয় সরকার (ইউনিয়ন পরিষদ) আইন, ২০০৯-এর দ্বিতীয় তফসিলের ২২ নম্বর ক্রমিকে ইউনিয়নে নতুন বাড়ি, দালান নির্মাণ বা পুনর্নির্মাণ এবং বিপজ্জনক দালান নিয়ন্ত্রণে ইউনিয়ন পরিষদের দায়িত্ব রয়েছে। এ পরিপ্রেক্ষিতে উন্নয়ন কর্তৃপক্ষসমূহের আওতাবহির্ভূত উপজেলা ও ইউনিয়ন পরিষদের অধিক্ষেত্রাধীন এলাকায় ইমারত/স্থাপনার নকশা অনুমোদন এবং ভবনের গুণগত মান নিশ্চিতকরণের লক্ষ্যে ১১ সদস্যের কমিটি গঠন করা হয়। কমিটির সভাপতি থাকবেন উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান। আর উপজেলা নির্বাহী অফিসার, সহকারী কমিশনার (ভূমি), এলজিইডির উপজেলা প্রকৌশলী, ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান, ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের প্রতিনিধি, ইনস্টিটিউট অব ইঞ্জিনিয়ার, বাংলাদেশ ও ইনস্টিটিউট অব আর্কিটেক্টস বাংলাদেশ এবং বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্স, ইনস্টিটিউট অব ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার্স অব বাংলাদেশের প্রতিনিধি। আর সহকারী প্রকৌশলী বা উপসহকারী প্রকৌশলী সদস্যসচিব হিসেবে থাকবেন। কিন্তু ২০১৭ সালে আইন পাস করলেও উপজেলা ও ইউনিয়ন পর্যায়ে ভবন নির্মাণে এখনো অনুমোদন নেন না মালিকরা। পৌরসভা পর্যায়ে মালিকরা ভবন নির্মাণে কিছু অংশ অনুমোদন নিয়ে থাকেন। আর ভবনের নকশা ও গুণগত মান নিশ্চিতকরণ কমিটিতে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্স (বিআইপি) প্রতিনিধি হিসেবে থাকলেও গত ছয় বছরে চার-পাঁচটি উপজেলায় নিয়মিত সভা হয়েছে। এর বাইরে কোনো উপজেলায় একটি বা দুটি সভা হয়েছে। আর অধিকাংশ উপজেলায় সভাই হয় না। এ বিষয়ে বিআইপি প্রেসিডেন্ট ফজলে রেজা সুমন বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘২০১৭ সালে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় থেকে এ বিষয়ে প্রজ্ঞাপন জারি হওয়ার পর ২০১৮ সালে ১৩৮ উপজেলায় আমরা প্রতিনিধি ঠিক করি। কিন্তু এখন পর্যন্ত নামমাত্র কয়েকটি উপজেলায় সভা হয়। বেশির ভাগই সভা হয় না।’ এ বিষয়ে লাকসাম উপজেলা প্রকৌশলী মিশুক কুমার দত্ত বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘উপজেলা ও ইউনিয়ন পর্যায়ে ভবন নির্মাণে নকশা ও গুণগত মান নিশ্চিতের জন্য মালিকরা খুব কম আসেন। তবে পৌরসভা পর্যায়ে অধিকাংশ ভবন নির্মাণ নকশা অনুযায়ী হয়ে থাকে।’ উপজেলা পর্যায়ে নকশা অনুযায়ী না হওয়ার কারণ হিসেবে তিনি বলেন, ‘প্রথমত উপজেলা ও ইউনিয়নের মানুষ ভবন নির্মাণে নকশা অনুমোদনসহ আনুষঙ্গিক কাজের যে অনুমোদন নিতে হবে তা জানে না। দ্বিতীয় হচ্ছে, কিছু মানুষ জানলেও কিছু টাকা অতিরিক্ত খরচ হবে সেজন্য আসে না।’

সর্বশেষ খবর