বুধবার, ৩০ আগস্ট, ২০২৩ ০০:০০ টা

সীমান্তের ৩২ জেলায় মাদকের ৩৮৬ স্পট

ঢুকছে ২৫ ধরনের নেশাদ্রব্য

আলী আজম

ভারত ও মিয়ানমার থেকে ভয়ংকর সব মাদকের অনুপ্রবেশ ঘটছে বাংলাদেশে। জল, স্থল ও আকাশ পথে স্রোতের মতো মাদক আসছে। দেশে এ পর্যন্ত ২৫ ধরনের মাদক শনাক্ত হয়েছে। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর (ডিএনসি) বলছে, আন্তর্জাতিক মাদক চোরাচালানের রুট ‘গোল্ডেন ট্রায়াঙ্গেল’ এবং ‘গোল্ডেন ক্রিসেন্ট’-এর একেবারে কেন্দ্রে বাংলাদেশ। দেশের সীমান্ত সংলগ্ন ৩২টি জেলার ৯৬ থানার ৩৮৬টি মাদক স্পট চিহ্নিত করা হয়েছে। জাতিসংঘের মাদক নিয়ন্ত্রণ সংস্থার (ইউএনওডিসি) তথ্য বলছে, বাংলাদেশে যত মাদক ঢুকছে, এর মাত্র ১০ শতাংশ ধরা পড়ে।

ডিএনসি সূত্রে জানা গেছে, দেশে এখন পর্যন্ত ২৫ ধরনের মাদক উদ্ধার হয়েছে। দুই প্রতিবেশী দেশের সীমান্ত এলাকা থেকে আসে এসব মাদক। মাদকের প্রবেশপথ হিসেবে বাংলাদেশের সীমান্ত সংলগ্ন ৩২টি জেলাকে রেড জোন হিসেবে চিহ্নিত করে সর্বশেষ গবেষণা প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে ডিএনসি। ডিএনসির এক কর্মকর্তা বলেছেন, সম্প্রতি ডিএনসির কোর কমিটির মিটিং হয়েছে। সীমান্তের ৩২ জেলার মাদক স্পটসহ বিভিন্ন শহরে মাদকবিরোধী যৌথ অভিযান চালানোর বিষয়ে সিদ্ধান্ত হয়েছে। গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের পশ্চিম সীমান্ত দিয়ে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের হাসনাবাদ, টাকি, বসিরহাট, স্বরূপনগর, বাদুড়িয়া, উত্তর চব্বিশ পরগনা, বনগাঁ, পেট্রাপোল, হেলেঞ্চা, ভবানীপুর, রাণাঘাট, অমৃতবাজার, বিরামপুর, করিমপুর, নদিয়া, মালদহ, বালুরঘাট, আওরঙ্গবাদ, নিমতিতাসহ সীমান্তসংলগ্ন প্রায় সব এলাকা দিয়ে ১৫টি পয়েন্টে সাতক্ষীরা, যশোর, চুয়াডাঙ্গা, মেহেরপুর, রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, জয়পুরহাট ও দিনাজপুর এলাকায় মাদক ঢুকছে। ভারতের আসাম ও মেঘালয়ের বাংলাদেশ ঘেঁষা এলাকাগুলোর চারটি পয়েন্ট দিয়ে মাদক ঢুকছে কুড়িগ্রাম, শেরপুর, ময়মনসিংহ ও নেত্রকোনায়। বাংলাদেশের পূর্ব সীমান্তে ভারতের আসাম, ত্রিপুরা ও মিজোরামের চারটি পয়েন্ট দিয়ে মাদক ঢুকছে সিলেট, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, কুমিল্লা ও ফেনীতে। এ ছাড়াও ভারতের দক্ষিণ দিনাজপুর হয়ে নওগাঁর ১৭টি স্পট দিয়ে মাদক প্রবেশ করছে। প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, বাংলাদেশ পশ্চিম ও উত্তরে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য, উত্তরে আসাম, উত্তর ও উত্তর-পূর্বে মেঘালয় এবং পূর্বে ত্রিপুরা ও মিজোরাম দ্বারা বেষ্টিত। দক্ষিণ-পূর্বে মিয়ানমারের (বার্মা) সঙ্গে সীমানা রয়েছে। বাংলাদেশের ৩২টি জেলার সঙ্গে এই দুই দেশের সীমান্ত লাইন রয়েছে। এসব সীমানার ৩৮৬ স্পট দিয়ে দেদার মাদক প্রবেশ করছে। দেশে যে পরিমাণ মাদক প্রবেশ করছে এর ৮৮ শতাংশ আসছে ভারত থেকে, মিয়ানমার থেকে আসছে ৮ শতাংশ এবং ৪ শতাংশ আসছে বিভিন্ন দেশ থেকে। দেশে প্রবেশ করা মাদকের ১৭ শতাংশ ঢাকা ও এর আশপাশ এলাকায় আসছে। বাকি ৮৩ শতাংশ মাদক সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ছে। বিভিন্ন শ্রেণি পেশার ৫ হাজার ৪৭০ ব্যক্তির সাক্ষাৎকার নিয়ে এই গবেষণা প্রতিবেদন তৈরি করা হয়েছে। এর মধ্যে ৭৪ শতাংশ পুরুষ এবং ২৬ শতাংশ নারী রয়েছে। প্রতিবেদনে বলা হয়, মিয়ানমারের সঙ্গে ২৭১ কিলোমিটারের সীমান্তের সবচেয়ে সক্রিয় মাদক রুটগুলো দেশের মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। কারণ মিয়ানমার থেকে কক্সবাজার ও সংলগ্ন এলাকা দিয়ে ঢুকছে কোটি কোটি পিস ইয়াবা। বেশির ভাগ ইয়াবা তৈরি হয় মিয়ানমার-চীন সীমান্তের শান ও কাচিন প্রদেশে। মিয়ানমারের সাবাইগন, তমব্রু, মংডুর মতো ১৫টি পয়েন্ট দিয়ে টেকনাফের সেন্টমার্টিন, শাহপরীর দ্বীপ, ধুমধুমিয়া, কক্সবাজার হাইওয়ে, উখিয়া, কাটাপাহাড়, বালুখালি, বান্দরবানের ঘুমধুম, নাইক্ষ্যংছড়ি, দমদমিয়া, জেলেপাড়ার মতো অর্ধশত স্পট দিয়ে ইয়াবা ঢুকছে বাংলাদেশে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মাদকাসক্তদের সম্পর্কে সরকারিভাবে সুনির্দিষ্ট কোনো পরিসংখ্যান না থাকলেও বেসরকারিভাবে দেশে ১ কোটিরও বেশি মাদকাসক্ত রয়েছে। বছরে মাদকের পেছনে খরচ হয় আনুমানিক ৬০ হাজার কোটি টাকা। এ ব্যবসায় পৃষ্ঠপোষক, ব্যবসায়ী, বাহক ও বিক্রির নেটওয়ার্কে কাজ করে প্রায় ২ লাখ ব্যক্তি। প্রতি বছরই বাড়ছে এই সংখ্যা। বাংলাদেশ থেকে মাদকের কারণে প্রতিবছর পাচার হয়ে যায় ৪৮১ মিলিয়ন মার্কিন ডলার বা প্রায় ৫ হাজার ১৪৭ কোটি টাকা। নেশাজাতীয় দ্রব্যের বিস্তারের এই সর্বনাশা চিত্র যেভাবে আর্থিক ও শারীরিক ক্ষতি করছে, সেভাবে একটি প্রজন্মের চিন্তার জগতে বন্ধ্যত্ব সৃষ্টি করছে। উঠতি বয়সী যুবকসহ বিভিন্ন শ্রেণি পেশার মানুষ মাদকের মরণ নেশায় জড়িয়ে পড়ছে। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের (ডিএনসি) উপ-পরিচালক (নিরোধ শিক্ষা) মো. মানজুরুল ইসলাম জানান, গবেষণা প্রতিবেদনে সীমান্তের ৩২ জেলায় মাদক নিয়ন্ত্রণে বেশ কিছু সুপারিশ করা হয়েছে। সেগুলো ক্রমান্বয়ে বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। সীমান্তে মাদক কারবারি, গডফাদার ও পৃষ্ঠপোষকদের তালিকা তৈরি করা হয়েছে। তালিকা ধরে অভিযান চালিয়ে জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। এ ছাড়া সীমান্তে মাদক কেনা-বেচা ও সেবনের সঙ্গে জড়িতদের চিহ্নিত করে চিকিৎসা প্রদান ও আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে বিকল্প আত্মকর্মসংস্থানের জন্য আয়বর্ধকমূলক প্রশিক্ষণ প্রদানের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে।

সর্বশেষ খবর