শিরোনাম
শনিবার, ২ সেপ্টেম্বর, ২০২৩ ০০:০০ টা

তদন্তে উঠে এলো দুই প্রজন্মের আত্মহত্যার ইতিহাস

আলী আজম

তদন্তে উঠে এলো দুই প্রজন্মের আত্মহত্যার ইতিহাস

হাফিজুর রহমান চাঁন মিয়া একজন কৃষক। তিন মেয়ে ও এক ছেলের পিতা তিনি। নিজ জমিতে শাক-সবজি চাষ করতেন। সেগুলো বাজারে নিয়ে বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করতেন। এ ছাড়া সংসারে আর কোনো মাধ্যমে টাকা আয়ের উৎস ছিল না। ফলে টানাপোড়নের সংসারে হাফিজুর প্রায়ই হতাশা ও দুশ্চিন্তায় ভুগতেন। তিনি প্রতিদিন ফজরের নামাজ পড়ে হাঁটতে বের হতেন এবং বাসায় ফিরে সবজি বাগানে কাজ করতেন। ২০২০ সালের ৪ আগস্ট ভোরে ফজরের নামাজের সময় গাজীপুর সদর থানার পোড়াবাড়ীর বাসা থেকে বের হয়ে রহস্যজনকভাবে নিখোঁজ হন। অনেক খোঁজ করেও সন্ধান না পাওয়ায় তার পরিবার সদর থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেন। ১৩ আগস্ট সন্ধ্যায় সদর থানার পোড়াবাড়ী সাকিনা সরকারি বাগানের ভিতর থেকে তার ঝুলন্ত লাশ উদ্ধার করে পুলিশ।

১৪ আগস্ট নিহতের মেয়ে সাদিয়া সুলতানা অজ্ঞাতদের আসামি করে সদর থানায় একটি হত্যা মামলা করেন। এতে তিনি উল্লেখ করেন, ৪ আগস্ট থেকে ১৩ আগস্টের মধ্যে যে কোনো সময় অজ্ঞাত খুনিরা তার ৫৬ বছর বয়সী বাবা হাফিজুর রহমানকে বাগানের মধ্যে নিয়ে মারধর করে এবং শ্বাসরোধে হত্যা করে। সদর থানা পুলিশের তদন্তে এ ঘটনায় হত্যার কোনো আলামত না পেয়ে আদালতে চূড়ান্ত রিপোর্ট দেন। মামলার বাদী সাদিয়ার নারাজির আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে মামলাটি পিবিআইকে তদন্তের নির্দেশ দেন আদালত। পিবিআই তদন্তে জানতে পারে কৃষক হাফিজুরকে হত্যা করা হয়নি তিনি হতাশা ও দুশ্চিন্তায় আত্মহত্যা করেছেন। তারা তদন্তে আরও জানতে পারে এর আগেও হাফিজুরের বাবা আবদুস সাহিদ হতাশা ও দুশ্চিন্তা থেকে গলায় ফাঁস নিয়ে আত্মহত্যা করেছিলেন। মামলার নথিপত্র ঘেঁটে জানা গেছে, মামলাটি প্রথমে তদন্ত করেন গাজীপুর সদর থানার এসআই মো. সারোয়ার হোসেন। তিনি ১৪ আগস্ট থেকে ২৩ আগস্ট পর্যন্ত মামলা তদন্ত করেন। এরপর মামলাটি তদন্ত করেন একই থানার এসআই বশির আহম্মেদ। তিনি ভিসেরা ও ময়নাতদন্ত রিপোর্টসহ সার্বিক বিষয়ে পর্যালোচনা করেন। হাফিজুরকে হত্যা করা হয়েছে এমন কোনো আলামত না পেয়ে ২০২১ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি আদালতে চূড়ান্ত রিপোর্ট দাখিল করেন। কিন্তু মামলার বাদী সাদিয়া পুলিশের এ রিপোর্টে নারাজি দিয়ে বলেন, পুলিশ সার্বিকভাবে তদন্ত না করে চূড়ান্ত রিপোর্ট দিয়েছে। পরে মামলার বাদীর আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ২০২২ সালের ২২ আগস্ট আদালত পিবিআইকে মামলাটি তদন্তের নির্দেশ দেন। ১৫ সেপ্টেম্বর পিবিআই গাজীপুর জেলার এসআই শংকর কুমার সরকার মামলাটির তদন্ত শুরু করেন। তিনি ঘটনাস্থল পরিদর্শন এবং মামলার বাদীর কাছ থেকে বিস্তারিত জেনে নেন। তিনি আটজন সাক্ষীকে জিজ্ঞাসাবাদ করেন। তদন্তে জানতে পারেন, হাফিজুর রহমানের বাবা বিভিন্ন হতাশা ও দুশ্চিন্তা থেকে গলায় ফাঁস নিয়ে আত্মহত্যা করেছিলেন। এরপর থেকেই হাফিজুরের পরিবারে আত্মহত্যার প্রবণতা প্রকাশ পায়। হাফিজুরের সঙ্গে জমি কিংবা অন্য কোনো কারণে শত্রুতা ছিল না। তবে হাফিজুর বিভিন্ন সময় হতাশাগ্রস্ত ও দুশ্চিন্তায় থাকতেন বলে মামলার বাদী ও তার পরিবারের লোকজন জানায়। হাফিজুর রহমানের মা হাজেরা খাতুন ও তার ভাই মো. হারেজ মিয়া জানান, ঘটনার তিন মাস আগে হাফিজুর হতাশাগ্রস্ত ও দুশ্চিন্তার কারণে একবার আত্মহত্যা করতে গিয়েছিলেন কিন্তু সবাই দেখে ফেলায় তিনি আত্মহত্যা করতে পারেননি। এ ছাড়া ঘটনার দুই দিন আগে হাফিজুরের মায়ের কাছে গিয়ে বলেন, মা আমাকে মাফ করে দিও, আমার আর বাঁচতে ইচ্ছা করে না। তখন তার মা বলেন, তোর কী হয়েছে এ রকম পাগলামি করতাছিস, বাড়ি যা। বউ বাচ্চাদের দিকে তাকিয়ে কাজকাম কর, উল্টাপাল্টা চিন্তা করবি না। এরপর তার লাশ পোড়াবাড়ী বনবিভাগের সরকারি বাগানে পাওয়া যায়। সার্বিক তদন্তে জানা যায়, আর্থিক অভাব অনটনসহ সাংসারিক বিভিন্ন বিষয়াদি নিয়ে হতাশাগ্রস্ত ও দুশ্চিন্তা থেকে হাফিজুর রহমান আত্মহত্যা করেন। পিবিআই গাজীপুর জেলার পুলিশ সুপার (এসপি) মোহাম্মদ মাকছুদের রহমান বলেন, মামলাটি সার্বিক তদন্ত, প্রাপ্ত সাক্ষ্য প্রমাণে, নিহত হাফিজুরের সুরতহাল প্রতিবেদন, ময়নাতদন্ত ও ভিসেরা রিপোর্ট এবং ঘটনার পারিপার্শ্বিকতা পর্যালোচনা করে হত্যা প্রমাণিত হয়নি। এ কারণে ২০২৩ সালের ১৫ জুন আদালতে ফাইনাল রিপোর্ট প্রদান করেছি।

সর্বশেষ খবর