বুধবার, ৬ সেপ্টেম্বর, ২০২৩ ০০:০০ টা

বৈধ অস্ত্রের মালিকদের তথ্য নিয়ে লুকোচুরি

মাহবুব মমতাজী

বৈধ অস্ত্রের অবৈধ ব্যবহার রোধে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) অস্ত্রের মালিকদের ফিঙ্গার প্রিন্ট সংগ্রহ শুরু করে দুই বছর আগে থেকে। এর পাশাপাশি বিক্রীত অস্ত্রের লাইসেন্সের কপি, গুলির ফায়ার কার্তুজ ও বুলেটের ইমেজ সংগ্রহ করা হচ্ছিল। কিন্তু গত দেড় বছরের অস্ত্র বিক্রি এবং নতুন করে কারা কারা অস্ত্রধারী সেই তথ্য গোপন রেখেছে সংস্থাটি। অস্ত্র ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে বিক্রির হিসাব নেওয়া তারা রহস্যজনক কারণে বন্ধ রেখেছে বলে জানা গেছে।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, সিআইডির ফরেনসিক ল্যাবে অটোমেটেড ব্যালিস্টিকস আইডেন্টিফাইড সিস্টেমে (আবিস) বন্ধ রয়েছে। এ ছাড়া বৈধ অস্ত্রের ডাটাবেজ আপডেটও করা হচ্ছে না।

সিআইডির আবিসের গত বছরের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত থাকা তথ্যানুযায়ী, দেশে বৈধ অস্ত্রের সংখ্যা ছিল ৫৪ হাজার ২৭টি। ২০২১ সালের এপ্রিল থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত ঢাকায় ১১৩টি অস্ত্র বিক্রি হয়। চলতি বছর জানুয়ারিতে ১৬টি অস্ত্র বিক্রি হয়। এসবের মধ্যে তিনটি বিদেশি পিস্তল, ১১টি শটগান এবং দুটি রাইফেল রয়েছে। এগুলোর ক্রেতাদের মধ্যে রয়েছেন- ময়মনসিংহ-৮ আসনের এমপি ফখরুল ইসলাম, মেজর (অব.) এনায়েত উল্লাহ আকন্দ, কিশোরগঞ্জ সদরের ইউপি চেয়ারম্যান মামুন আল মাসুদ খান, মুক্তিযোদ্ধা সাজ্জাদ হোসেন রানা, পুলিশ পরিদর্শক জিয়াউর রহমান। সিআইডি সূত্র জানায়, ফরেনসিক ব্যালিস্টিকস গবেষণাগারে ব্যবহৃত আলামত পরীক্ষা-নিরীক্ষা, তুলনামূলক বিশ্লেষণ, গুলিবর্ষণে ব্যবহৃত আগ্নেয়াস্ত্র শনাক্ত করা এবং এ সংক্রান্ত ডাটাবেজ সংরক্ষণে আবিস হলো সর্বাধুনিক সফটওয়্যার ডিভাইস। ব্যালিস্টিক পরীক্ষা কার্যক্রমে ফায়ার আর্মস আইডেন্টিফিকেশন (আগ্নেয়াস্ত্র চিহ্নিতকরণ) একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। আগ্নেয়াস্ত্র চিহ্নিতকরণ প্রক্রিয়াকে অধিকতর বিজ্ঞানসম্মত করতে ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে রাশিয়ার প্যাপিলন কোম্পানির মাধ্যমে আবিস সিআইডিতে সংযোজন করা হয়। ২০০৮ থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত আগ্নেয়াস্ত্র সংশ্লিষ্ট মামলায় ১ হাজার ৮৩৫টি ইমেজ (আলামত) আবিসে সংরক্ষণ করা হয়। ২০২১ সালে ২৩৩টি ডাটা ইমেজ সংরক্ষণ করা হয়। ২০১১ সাল থেকে গত বছরের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত আবিস ২ হাজার ১৯৩টি গুলির ঘটনার আলামত পরীক্ষা করেছে। এ গবেষণাগারে আগের অস্ত্রের আলামতের পাশাপাশি নতুন করে বিক্রীত অস্ত্রের আলামতও সংগ্রহ করার প্রক্রিয়া চালু করা হয়েছিল। অস্ত্র বিক্রি বা বৈধ অস্ত্রধারীর সংখ্যার তথ্য লুকোচুরি নিয়ে সিআইডির ফরেনসিক বিভাগের বিশেষ পুলিশ সুপার এ কে এম এমরান ভুঞার কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমি যোগদানের পর থেকে এর কোনো কার্যক্রম দেখিনি। আর কেন বন্ধ রয়েছে সেটাও জানি না।

সিআইডির কর্মকর্তারা জনান, ২০২০-২১ সালে সাতকানিয়াসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে সাত ধাপের ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে ব্যাপক সহিংসতা হয়। এসব সহিংসতায় আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহৃত হয়। সম্প্রতি পার্বত্য অঞ্চলে গোলাগুলিতে চারজন নিহত হন। ধানমন্ডিতে ফেসবুক লাইভে নিজের পিস্তলের গুলিতে আবু মহসীন খান আত্মহত্যা করেন। চাঞ্চল্যকর এসব ঘটনার পর আগ্নেয়াস্ত্রের ব্যবহারের বিষয়টি ব্যাপক অলোচনা আসে। এরপরই সিআইডি ২০২১ সালে বৈধ অস্ত্রের অবৈধ ব্যবহার রোধে ব্যতিক্রমী তৎপরতা শুরু করে। এরই অংশ হিসেবে ওই বছরের ২৪ মার্চ সিআইডির তৎকালীন প্রধান ব্যারিস্টার মাহবুবুর রহমানের সভাপতিত্বে নয়জন আর্মস ডিলারের সঙ্গে বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। এরপর বাংলাদেশ আর্মস ইম্পোর্টার অ্যাসোসিয়েশনের কাছে ১০ বছরে (২০১১ সাল থেকে) বিক্রি হওয়া আগ্নেয়াস্ত্রের লাইসেন্সের কপি এবং সংশ্লিষ্ট আগ্নেয়াস্ত্রের টেস্টফায়ার্ড কার্তুজ ও বুলেটের (যদি থাকে) তথ্য চাওয়া হয়। বাংলাদেশের সব থানায় চিঠি দিয়ে সংশ্লিষ্ট থানা এলাকার বৈধ অস্ত্রের তথ্য চেয়ে চিঠি দেওয়া হয়। এ ছাড়া দেশের সব থানা থেকে সংশ্লিষ্ট এলাকার অস্ত্রের তথ্য আনে সিআইডি।

ফরেনসিক ল্যাবের বিশেষজ্ঞদের তথ্য মতে, ব্যালিস্টিক শাখা থেকে আগ্নেয়াস্ত্র ও গোলাবারুদ পরীক্ষা করে বিশেষজ্ঞ মতামত দেওয়া হয়। গুলির ফায়ার কার্তুজ ও বুলেটের ইমেজ সংগ্রহ করে অত্যাধুনিক সফটওয়্যার আবিসে সংরক্ষণ করা হয়। আবিস সফটওয়্যারের মাধ্যমে নির্বাচনি সহিংসতায় গোপালগঞ্জে ইউনিয়ন পরিষদ সদস্য খুনের রহস্য বের করা হয়। ওই ঘটনায় গুলির খোসা পরীক্ষায় জানা গিয়েছিল যে, বিদেশি পিস্তল থেকে গুলি করা হয়েছিল। ২০১২ সালে নিহত সৌদি কূটনীতিক খালাফ আলীর লাশ থেকে বুলেট বের করে পরীক্ষার জন্য আবিসে আনা হয়েছিল। বুলেট পরীক্ষায় তখন জানা গিয়েছিল, কোন ধরনের অস্ত্র থেকে গুলি করা হয়েছে। এ ছাড়া এমপি লিটন, হলি আর্টিজান, জাপানি নাগরিক হোসিও কোনি এবং ইতালির তাভেল্লা সিজার হত্যাকা সহ অনেক চাঞ্চল্যকর হত্যা মামলায় ব্যবহৃত অস্ত্রের সন্ধান আবিসের মাধ্যমে পাওয়া গিয়েছিল।

সর্বশেষ খবর