বৃহস্পতিবার, ৭ সেপ্টেম্বর, ২০২৩ ০০:০০ টা

জটিলতা কাটছে ভূমি জরিপ বিরোধ নিষ্পত্তিতে

আরাফাত মুন্না

জটিলতা কাটছে ভূমি জরিপ বিরোধ নিষ্পত্তিতে

ভূমি জরিপ বিরোধ নিষ্পত্তিতে আইন হওয়ার দেড় যুগ পর ৫৪ জেলায় প্রথমবারের মতো আপিল ট্রাইব্যুনাল গঠন করল সরকার। এর ফলে বিদ্যমান ল্যান্ড সার্ভে ট্রাইব্যুনালে নিষ্পত্তি হওয়া মামলার রায় বা আদেশের বিরুদ্ধে সংক্ষুব্ধ ব্যক্তির আপিল করার সুযোগ তৈরি হয়েছে। পাশাপাশি ঢাকাসহ আরও ১৩ জেলায় নতুন ট্রাইব্যুনালও গঠন করা হয়েছে। সম্প্রতি এ সংক্রান্ত পৃথক দুটি প্রজ্ঞাপন জারি করেছে আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয়।

আগে ট্রাইব্যুনালের রায়ে সংক্ষুব্ধ হলে হাই কোর্টে রিট করার বিকল্প ছিল না, বিচারপ্রার্থীদের জন্য এটা ছিল চরম ভোগান্তির। এখন সেই ভোগান্তি কমবে বলেই মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। তারা বলেন, এখন বিচারপ্রার্থীরা রায়ে সংক্ষুব্ধ হলে নিজ নিজ জেলায়ই আপিল করতে পারবেন। তাদের আর কষ্ট করে দূর দূরান্ত থেকে ঢাকায় আসতে হবে না। এতে সময় যেমন বাঁচবে, বাঁচবে টাকাও।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে আইন ও বিচার  বিভাগের সিনিয়র সচিব মো. গোলাম সারওয়ার বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, জরিপের সময় জমির দাগ-খতিয়ানে ভুল-ত্রুটি হয়ে থাকে। এসব সমস্যা সমাধানের জন্য রেকর্ড সংশোধনের প্রয়োজন। এতদিন এসব ট্রাইব্যুনালের রায়ে সংক্ষুব্ধদের আপিল করার জায়গা ছিল না। এখন আপিল ট্রাইব্যুনাল হওয়ায় সেই জটিলতা কেটেছে। ২০০৪ সালে আইন সংশোধন করে ল্যান্ড সার্ভে ট্রাইব্যুনাল ও ল্যান্ড সার্ভে আপিল ট্রাইব্যুনাল গঠনের বিধান করা হয়েছিল। আইনে তখন আপিল নিষ্পত্তির জন্য হাই কোর্টের বিচারক বা সাবেক বিচারককে নিয়ে ল্যান্ড সার্ভে আপিল ট্রাইব্যুনাল গঠনের বিধান রাখা হয়। কিন্তু আমলাতান্ত্রিক জটিলতাসহ নানা কারণে ভূমি জরিপ আপিল ট্রাইব্যুনাল আর স্থাপন করা হয়নি। এর ফলে ভূমি জরিপ ট্রাইব্যুনালের রায়, ডিক্রি এবং আদেশে কেউ সংক্ষুব্ধ হলে তার প্রতিকার পেতে বিচারপ্রার্থীদের হাই কোর্টে রিট করতে হতো।

২০১৫ সালে এমন এক রিটের শুনানিকালে হাই কোর্ট দেশে কোনো ল্যান্ড সার্ভে আপিল ট্রাইব্যুনাল না থাকার বিষয়টি লক্ষ্য করেন। পরে ওই বছরের ৩ মার্চ স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে রুল জারি করেন। রুলের চূড়ান্ত শুনানি শেষে হাই কোর্ট ২০২০ সালের ১২ অক্টোবর দেওয়া রায়ে তিন মাসের মধ্যে ভূমি জরিপ আপিল ট্রাইব্যুনাল স্থাপনের নির্দেশ দেয়। এরপর আইন সংশোধনের উদ্যোগ নেয় সরকার। পরে গত জুলাইয়ে সংসদে ‘রাষ্ট্রীয় অধিগ্রহণ ও প্রজাস্বত্ব আইন সংশোধন’ করে জেলা জজদের ল্যান্ড সার্ভে আপিল ট্রাইব্যুনালের মামলা নিষ্পত্তির ক্ষমতা দেওয়া হয়। এর আলোকে গত ২৩ আগস্ট ৫৪টি আপিল ট্রাইব্যুনাল গঠনের বিষয়ে গেজেট প্রকাশ করা হয়। এ ছাড়া ১৩টি জেলায় নতুন ল্যান্ড সার্ভে ট্রাইব্যুনাল গঠন করা হয়েছে। রাষ্ট্রপতির পৃথক আদেশক্রমে এগুলো গঠন করা হয়। তবে ১০ জেলায় ভূমি জরিপ সম্পন্ন না হওয়া এসব জেলায় কোনো ট্রাইব্যুনাল গঠন করা হয়নি।

জানতে চাইলে সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী ব্যারিস্টার এবিএম আলতাফ হোসেন বলেন, ভূমি জরিপের জটিলতা নিয়ে ট্রাইব্যুনালের রায়ে সংক্ষুব্ধ হলে বিচারপ্রার্থীদের আগে হাই কোর্টে রিট করতে হতো। এটা তাদের জন্য অনেক দুর্ভোগের ছিল। কিন্তু এখন জেলা ও দায়রা জজদের ক্ষমতা দিয়ে আপিল ট্রাইব্যুনাল গঠন করায় সেই দুর্ভোগ কমবে। তিনি বলেন, এখনো একটি বিষয়ে শঙ্কা রয়ে গেছে। সেটা হলো, জেলা জজদের কাছে এমনিতেই অন্য সব ধরনের মামলা থাকে, সে ক্ষেত্রে এই আপিল ট্রাইব্যুনালে তারা কতটুকু সময় দিতে পারবেন, সেটাই দেখার বিষয়। সুপ্রিম কোর্টের তথ্য অনুযায়ী, গত মার্চ পর্যন্ত দেশের ৪১টি ল্যান্ড সার্ভে ট্রাইব্যুনালে বিচারাধীন মামলার সংখ্যা ছিল ৩ লাখ ৭০ হাজার ৬১৮টি। এর মধ্যে পাঁচ বছরের বেশি সময় ধরে বিচারাধীন রয়েছে ১ লাখ ৭১ হাজার ১৬৯টি মামলা। উচ্চ আদালতের মাধ্যমে স্থগিত রয়েছে ১৬৫টি মামলার কার্যক্রম।

জেলাভিত্তিক মামলার তথ্য পর্যালোচনায় দেখা যায়, সবচেয়ে বেশি ভূমি-সংক্রান্ত মামলা রয়েছে যথাক্রমে কিশোরগঞ্জে ৩৮ হাজার ৮২৩, ময়মনসিংহে ২৬ হাজার ৯৩৯, টাঙ্গাইলে ১৮ হাজার ৭১, নেত্রকোনায় ১৫ হাজার ৫৩০, খুলনায় ১৫ হাজার ১৬২, ঢাকায় ১৩ হাজার ১৯৮, নারায়ণগঞ্জে ১২ হাজার ৯৪১, জামালপুরে ১১ হাজার ৪৩৫, নোয়াখালীতে ১১ হাজার ১৮৭, চাঁদপুরে ১০ হাজার ৪৫৫, সাতক্ষীরায় ১০ হাজার ৪৮৬ ও গোপালগঞ্জে ৯ হাজার ৭৫৯টি। স্বাধীনতার পর প্রথম ভূমি জরিপ (বিএসআর) শুরু হয় ১৯৮৪ সালে। এই জরিপ এখনো শেষ হয়নি। যেসব এলাকায় শেষ হয়েছে, সেখানে দেখা দিয়েছে নানা ত্রুটি-বিচ্যুতি। মাঠ কর্মকর্তাদের দুর্নীতি, দায়িত্বে অবহেলা ও অসতর্কতায় ভুলে ভরা ভূমি জরিপের খেসারত গুনতে হচ্ছে জমির মালিকদের। জরিপের পর্চা আর মানচিত্রে ভুল আর ভুল। কোনো কোনো ক্ষেত্রে শত বছর ধরে ভোগদখল করে এলেও মালিকের নামের পরিবর্তে জরিপে দেখানো হয়েছে অন্যের নাম। এমন প্রেক্ষাপটে ২০০৪ সালে সরকার ১৯৫৩ সালের ‘রাষ্ট্রীয় অধিগ্রহণ ও প্রজাস্বত্ব আইন’ সংশোধন করে ল্যান্ড সার্ভে ট্রাইব্যুনাল এবং ল্যান্ড সার্ভে আপিল ট্রাইব্যুনাল গঠনের বিধান সংযোজন করে। ২০১২ সাল থেকে পর্যায়ক্রমে ৪১ জেলায় ভূমি জরিপ ট্রাইব্যুনাল গঠন করা হয়। সর্বশেষ ১৩টিসহ বর্তমানে ল্যান্ড সার্ভে ট্রাইব্যুনালের সংখ্যা হলো ৫৪টি।

সর্বশেষ খবর