বৃহস্পতিবার, ৭ সেপ্টেম্বর, ২০২৩ ০০:০০ টা

সিএনজিচালক নয় ছিনতাইকারী চক্র

আলী আজম

২০১৯ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর গভীর রাতে রাজধানীর শেরেবাংলা নগর এলাকা থেকে অজ্ঞাত ষাটোর্ধ্ব এক ব্যক্তির লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। ওই ব্যক্তির সঙ্গে তার ব্যবহৃত মোবাইল ফোনটিও পাওয়া যায়। পুলিশ নিহতের মোবাইল ফোনে আসা একটি নম্বরে ফোন করেন। ফোনটি ধরেন নিহতের বোন নিউজা বেগম। তার কাছে জানতে পারেন, ওই ব্যক্তির নাম মো. ইয়াছিন আলী মন্ডল ওরফে মুন্না। তিনি একজন সার্জিক্যাল ব্যবসায়ী। গ্রামের বাড়ি বগুড়ার সোনাতলা উপজেলার পশ্চিম করমজায়। এ ঘটনায় শেরেবাংলা নগর থানায় অজ্ঞাতদের আসামি করে মামলা করেন নিহতের ভগ্নিপতি এ কে এম আমানুল্লাহ।

পরে মামলাটির তদন্ত থানা পুলিশ হয়ে ডিবিতে আসে। সেখান থেকে মামলাটির তদন্তের দায়িত্ব পায় পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)। দীর্ঘ তদন্ত শেষে বেরিয়ে আসে ব্যবসায়ী মুন্নার খুনের রহস্য। একে একে গ্রেফতার করা হয় সিএনজিচালিত অটোরিকশার পাঁচ চালককে। তারা মূলত সিএনজি চালানোর আড়ালে সংঘবদ্ধ ছিনতাইকারী দলের সদস্য। যাত্রীদের সিএনজিতে উঠিয়ে তারা জিম্মি করত এবং সর্বস্ব কেড়ে নিত। ভুক্তভোগীর সঙ্গে থাকা টাকা, মোবাইল ফোন বা অন্যান্য মালামাল দিতে না চাইলে তাকে বেধড়ক মারধর করত। এমনকি শ্বাসরোধে হত্যা করে নির্জন কোনো জায়গায় ফেলে দিত।

জানা গেছে, রাজধানীর শ্যামলীতে মহানগর সার্জিক্যাল নামে নিহত মুন্নার একটি দোকান রয়েছে। ২০১৯ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর রাতে গ্রামের বাড়ি থেকে বাসে গাবতলীতে আসেন মুন্না। এরপর বাসায় যাওয়ার জন্য একটি সিএনজিতে (ঢাকা-দ-১১-২৪৩৮) ওঠেন। সিএনজির চালক ছিলেন মো. আসাদ শেখ। আসাদের সিএনজি অনুসরণ করে আরেকটা সিএনজি (ঢাকা-দ-১১-১৮০১)। ওই গাড়িতে ছিলেন মো. দেলোয়ার হোসেন হাওলাদার ওরফে দেলু, মো. জলিল সিকদার, মো. মিজানুর রহমান সরদার ওরফে মিজান এবং মো. কবির হোসেন। তারা সবাই সিএনজিচালক। শ্যামলী ফুট ওভারব্রিজে পৌঁছানোর পরপরই আসাদ জানায়, তার সিএনজি নষ্ট হয়ে গেছে। আসাদ সিএনজি থেকে নেমে গেট খুলে দেয়। ঠিক এই সময় চক্রের আরেকটি সিএনজি আসাদের সিএনজির পেছনে থামায়। দেলোয়ার, জলিল ও মিজান সিএনজি থেকে নেমে আসাদের সিএনজিতে ওঠে। মুন্না চিৎকার করার চেষ্টা করলে মিজান তার মুখ চেপে ধরে। মুন্নার দুই পাশে দেলোয়ার ও জলিল বসে পড়ে। এরপর আসাদ সিএনজির উভয় পাশের দরজা আটকে দিয়ে শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পাশের রোড দিয়ে যেতে থাকে। দেলোয়ার, জলিল ও মিজান তাকে মারধর করে দেড় লাখ টাকা, একটি আইফোন ও একটি সোনার চেন কেড়ে নেয়। মারধর ও মুখ চেপে ধরে রাখায় মুন্না মারা যান। পরবর্তীতে তার লাশ শেরেবাংলা বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের সামনে ফেলে যায়। কিন্তু ছিনতাইকারী চক্রটি ধরা পড়ার ভয়ে নিহত মুন্নার মোবাইল ফোনটি রেখে যান। ময়নাতদন্ত রিপোর্টে তাকে শ্বাসরোধে হত্যা করা হয়েছে বলে জানতে পারে পুলিশ। মামলার এক বছর পার হলেও কোনো রহস্য বের করতে পারছিলেন না। কিন্তু ২০২০ সালের ১১ জুলাই শেরেবাংলা নগর থানায় একই ধরনের ঘটনায় একটি মামলা হয়। মামলায় সিএনজিচালক আসাদ, দেলোয়ার, জলিল ও মিজান গ্রেফতার হন। তাদের চারজনকে ব্যবসায়ী মুন্না হত্যার বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করলে তারা হত্যার দায় স্বীকার করেন এবং তাদের সঙ্গে সিএনজিচালক কবিরও জড়িত ছিল বলে জানায়। পরে কবিরকে গ্রেফতার করা হয়।  কবিরের তথ্য অনুযায়ী ব্যবসায়ী মুন্না হত্যাকাে র সঙ্গে জড়িত সিএনজি দুটি জব্দ করে পিবিআই। মামলাটি প্রথমে তদন্ত করে শেরেবাংলা নগর থানার এসআই মো. নূরুল ইসলাম। এরপর তৎকালীন ডিবি পশ্চিম বিভাগের তেজগাঁও জোনাল টিমের এসআই মো. মুরাদুজ্জামান এবং ডিবি মিরপুর বিভাগের পল্লবী জোনাল টিমের পরিদর্শক খন্দকার হাফিজুর রহমান। পরবর্তীতে পিবিআই অর্গানাইজড ক্রাইমের পরিদর্শক মো. আমিনুল ইসলাম এবং সর্বশেষ পিবিআই অর্গানাইজড ক্রাইমের পরিদর্শক মোহাম্মদ মাজহারুল ইসলাম মামলাটির তদন্ত করেন। তদন্ত শেষে তিনি ব্যবসায়ী মুন্নার খুনের ঘটনায় পাঁচজন সিএনজিচালিত অটোরিকশা চালকের জড়িত থাকার তথ্য পান এবং চলতি বছরের ২৭ আগস্ট আদালতে চার্জশিট জমা দেন। মামলার তদন্ত কর্মকর্তা পিবিআই অর্গানাইজড ক্রাইমের পরিদর্শক মোহাম্মদ মাজহারুল ইসলাম গতকাল বলেন, তদন্তে প্রাপ্ত সাক্ষ্য-প্রমাণ এবং জব্দকৃত আলামত পর্যালোচনায় এবং নিহতের সুরতহাল, ময়নাতদন্ত ও ভিসেরা রিপোর্ট এবং ঘটনার পারিপার্শ্বিকতা পর্যালোচনা করে নিহত মুন্নাকে হত্যায় পাঁচজনের সংশ্লিষ্টতা পাওয়া যায়। তারা পাঁচজনই সিএনজির চালক এবং একটি সংঘবদ্ধ ছিনতাইকারী চক্রের সদস্য। তারা সিএনজিতে যাত্রী উঠিয়ে কৌশলে মালামাল কেড়ে নিত এবং নির্জন কোনো জায়গায় ফেলে দিত। অনেক সময় যাত্রী মালামাল না দিতে চাইলে শ্বাসরোধে হত্যা করত। দীর্ঘদিন ধরে সক্রিয় এই গ্রুপটি রাতেই ছিনতাই করত। তাদের বিরুদ্ধে ডিএমপির বিভিন্ন থানায় একাধিক মামলা রয়েছে।

সর্বশেষ খবর