শুক্রবার, ৮ সেপ্টেম্বর, ২০২৩ ০০:০০ টা

শুধু জমি কিনতেই ফারইস্টের ১১৫ কোটি টাকা লুট

মাহবুব মমতাজী

শুধু জমি কেনার নাম করে ফারইস্ট ইসলামী লাইফ ইন্স্যুরেন্সের ১১৫ কোটি টাকা আত্মসাৎ ও পাচারের তথ্য পেয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। এ অভিযোগে ওই কোম্পানির সাবেক চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম, তার স্ত্রী তাসলিমা ইসলামসহ আটজনের বিরুদ্ধে গতকাল মানি লন্ডারিং আইনে মামলা করেছে সংস্থাটি। ঢাকা সমন্বিত জেলা কার্যালয়-১-এ দুদকের উপপরিচালক শারিকা ইসলাম মামলাটি করেন।

দুদকের জনসংযোগ দফতর সূত্র জানান, ওই মামলায় অন্য আসামিরা হলেন তাসলিমার ভাই সেলিম মাহমুদ, সাবেক কোম্পানির মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক হেমায়েত উল্যাহ, সাবেক ইভিপি ইঞ্জিনিয়ার আমির ইব্রাহিম, সার্ভে রিপোর্ট প্রণয়নকারী টিপু সুলতান, ফুয়াদ আশফাকুর রহমান ও মোহাম্মদ আলম খান।

মামলার এজাহারের তথ্যানুযায়ী, ২০১৫ সালে ফারইস্ট ইসলামী লাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি লিমিটেড ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ১৯ নম্বর ওয়ার্ডের কাকরাইল মৌজায় বিভিন্ন মালিকের কাছ থেকে ৮ হাজার বর্গফুটের পুরনো ভবনসহ ৩২ শতাংশ জমি কেনে। এর মধ্যে ২৮ শতাংশ জমি ফারইস্ট ইসলামী লাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি লিমিটেডের তৎকালীন চেয়ারম্যান নজরুল ইসলামের শ্বশুর মফিজুল ইসলাম ও স্ত্রীর বড় ভাই সেলিম মাহমুদের কাছ থেকে কেনা হয়। নজরুল ইসলাম ও আসামিরা নীতিমালা ভঙ্গ করে পরস্পর যোগসাজশে ক্ষমতার অপব্যবহার করে অনিয়ম ও দুর্নীতির মাধ্যমে ভুয়া সার্ভে ফার্মের সহযোগিতায় ২৮ শতাংশ জমি প্রকৃত মূল্যের চেয়ে     কয়েক গুণ বেশি দামে ফারইস্ট ইসলামী লাইফ ইন্স্যুরেন্সের জন্য কেনেন। পরে নজরুল ইসলাম তার স্ত্রী, শ্বশুর ও স্ত্রীর ভাইয়ের জমি বিক্রি করে ১১৫ কোটি টাকা নিজেদের ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের ব্যাংক হিসাবে মানি লন্ডারিংয়ের মাধ্যমে স্থানান্তরের মাধ্যমে আত্মসাৎ করেন।

দুদকসূত্র জানান, যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডায় বিলাসবহুল বাড়ি কিনেছেন ফারইস্ট ইসলামী লাইফ ইনস্যুরেন্স কোম্পানির সাবেক চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম। বাড়িটির ঠিকানা ১১৫২২ মানাতি বে এলএন, ওয়েলিংটন, এফএল ৩৩৪৪৯। ২০১৪ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি বাড়িটি কেনা হয়েছিল ৭ লাখ ৫৪ হাজার ৩২৭ মার্কিন ডলারে। বাড়ি কিনতে কোনো ঋণ নেওয়া হয়নি, অর্থাৎ পুরো অর্থই একবারে পরিশোধ করা হয়। এ ছাড়া ছেলেমেয়ের নামে নজরুল ইসলাম একই রাজ্যে গড়ে তুলেছেন তিনটি কোম্পানি। গত বছরের ১২ সেপ্টেম্বর গ্রেফতারের পর সেই নজরুল ইসলাম এখন কারাগারে। গ্রেফতারের পরদিন তাকে আদালতে তুললে ঢাকা মহানগর হাকিম মাহবুব আহমেদ শুনানি শেষে নজরুল ইসলামের দুই দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন। বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ (আইডিআরএ) ২০২১ সালের এপ্রিলে সিরাজ খান বসাক অ্যান্ড কোম্পানিকে ফারইস্ট লাইফের ওপর নিরীক্ষা করার দায়িত্ব দেয়। তাদের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ফারইস্ট লাইফ থেকে ২ হাজার ৩৬৭ কোটি টাকা আত্মসাৎ হয়েছে। এর বাইরে অনিয়ম হয়েছে ৪৩২ কোটি টাকার। অর্থাৎ কোম্পানির শেয়ারহোল্ডার ও পলিসি হোল্ডাররা তাদের ২ হাজার ৮০০ কোটি টাকা হারিয়েছেন। নজরুল ইসলাম, এম এ খালেকসহ কোম্পানির সাবেক সব পরিচালক ও মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) হেমায়েত উল্লাহ এবং কিছু শীর্ষ পর্যায়ের কর্মকর্তা এ অর্থ আত্মসাতের ঘটনা ঘটান।

বাজারমূল্যের চেয়ে বেশি দামে জমি কেনা, বিভিন্ন ব্যাংকে থাকা ফারইস্টের মুদারাবা টার্ম ডিপোজিট রিসিপ্ট (এমটিডিআর) বন্ধক রেখে পরিচালকদের ঋণ নেওয়া এবং ক্ষতিকর বিনিয়োগ মূলত এ তিন উপায়ে টাকা আত্মসাৎ করা হয়েছে।

জানা গেছে, ২০২১ সালে ফারইস্টের পরিচালনা পর্ষদ ভেঙে দেয় বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি)। একই মাসে সিইও হেমায়েতউদ্দিনকে বরখাস্ত করে আইডিআরএ। তদন্তসংশ্লিষ্টরা বলছেন, ২০১৩ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত চার বছরে ফারইস্ট লাইফ ঢাকাসহ দেশের ১৪ স্থানে জমি কেনে। এসব জমি কেনা হয় বাজারদরের চেয়ে অনেক বেশি দামে। এর মধ্যে সাতটি জমি কেনা ও ভবন নির্মাণ এবং বালু ফেলার নামে ৬৬৫ কোটি টাকা আত্মসাৎ হয়েছে। দুদকের গতকালের মামলায় বলা হয়, সরকারি মৌজাভিত্তিক বাজারমূল্য তালিকা অনুসারে ২০১৪ সালে কাকরাইল মৌজায় জমির অযুতাংশের মূল্য ছিল ৬৫ হাজার ৬৫৬ টাকা। এ মৌজায় ৩২ শতাংশ জমির মধ্যে ২৮ শতাংশ ২০১৫ সালের ১২ মে নজরুল ইসলামের শ্বশুর মফিজুল ইসলাম ও স্ত্রীর ভাই সেলিম মাহমুদের কাছ থেকে ফারইস্টের নামে ১৭২ কোটি টাকায় কেনা হয়। এ মূল্য নির্ধারণের জন্য ‘এটিপি সার্ভে ও ভ্যালুয়েশন’ এবং ‘এফএসটি কনসালটিং ফার্ম’ নিয়োগ করা হয়। অথচ এদের রিপোর্ট ছিল সম্পূর্ণ ভুল। ফার্ম দুটির কোনো অফিস এবং অস্তিতও খুঁজে পাওয়া যায়নি।

 

সর্বশেষ খবর