রবিবার, ১০ সেপ্টেম্বর, ২০২৩ ০০:০০ টা

বিক্রি হয়ে যাচ্ছে নদী

শামীম আহমেদ

বিক্রি হয়ে যাচ্ছে নদী

বাগেরহাটে বলেশ্বর ও বরিশালের গৌরনদীর পালরদী নদীর তীর অবৈধ দখল করে গড়ে উঠেছে স্থাপনা -বাংলাদেশ প্রতিদিন

জনসংখ্যা ও শিল্পায়ন বৃদ্ধিতে কমছে আবাদি জমি। বাড়ছে জমির চাহিদা ও দাম। সেই সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে নদনদী, খাল দখল। ভরাট করে খোদ নদী প্লট করে বিক্রি করে দেওয়া হচ্ছে। দোকান তুলে আদায় করা হচ্ছে ভাড়া। কেউ নদী ভরাট করে তুলছেন অট্টালিকা। কোথাও বাঁধ দিয়ে নদীর প্রবাহ বন্ধ করে মাছ চাষ করছেন প্রভাবশালীরা। এ ছাড়া প্রতিনিয়ত নদী দখল করে উঠছে নতুন নতুন স্থাপনা। ফলে দেশের ধমনি হিসেবে পরিচিত নদীগুলোর মৃত্যু ঠেকানোই যাচ্ছে না। এরই মধ্যে দেশের মানচিত্র থেকে হারিয়ে গেছে ৫ শতাধিক নদনদী। এতে আগ্রাসি হচ্ছে বন্যা পরিস্থিতি। সেচ সংকটে ঝুঁকির মুখে কৃষি।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ক্ষমতায় এসে ‘নদী বাঁচলে দেশ বাঁচবে’- এই বক্তব্য সামনে রেখে নদী উদ্ধারে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়ায় ২০১৯ সালে জোরেশোরে শুরু হয় নদী উদ্ধার অভিযান। পরবর্তীতে অজ্ঞাত কারণে অভিযানের গতি কমে যায়। বর্তমানে একদিকে চলছে ঢিমেতালে উদ্ধার অভিযান, অন্যদিকে চলছে পুনর্দখল। উদ্ধার-পুনর্দখলের খেলায় গত চার বছরে শুধু রাজধানী ঘিরে থাকা তুরাগ, বুড়িগঙ্গা, বালু ও শীতলক্ষ্যা নদী চারটি উদ্ধার সম্পন্ন করতে পারেননি সংশ্লিষ্টরা।

রিভার অ্যান্ড ডেল্টা রিসার্চ সেন্টারের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ এজাজ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, আমরা জরিপ করে স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে দেশে ১ হাজার ২৭৪টি নদীর হদিস পেয়েছি। নদীগুলোর নামসহ তালিকাও প্রকাশ করেছি। নদী রক্ষা কমিশন গত মাসে ৯০৭টি নদীর খসড়া হিসাব প্রকাশ করেছে। অর্থাৎ ৩৬৭টি নদীর খোঁজই মেলেনি। যেসব নদীর তালিকা প্রকাশ করা হয়েছে, সেগুলোর বড় অংশই এখন মৃত। দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি না দিলে নদী দখল থামবে না। তিনি বলেন, নদী রক্ষা কমিশন ২০১৮ সালে ৫৭ হাজার নদী দখলদারের তালিকা করার পর নদী উদ্ধারে কিছু পদক্ষেপ দেখেছি। কিছুদিন পরই তা থেমে যায়। আমরা বিভিন্ন অঞ্চল পরিদর্শন করে দেখেছি, তালিকা প্রকাশের পর নদী দখলের হার আরও বেড়েছে। ফলে দখলদারদের তালিকাটিও এখন আংশিক।

আমাদের নিজস্ব প্রতিবেদক ও প্রতিনিধিদের পাঠানো প্রতিবেদনে ফুটে উঠেছে নদী দখলের নগ্ন চিত্র। সিরাজগঞ্জের গাড়াদহ নদীর দুই পাশ দখল করে দোকান ঘর নির্মাণ করে ভাড়া আদায় করছেন প্রভাবশালীরা। ফলে সংকুচিত হয়ে গেছে নদী। সলঙ্গা বাজারের থাই গ্লাসের দোকানদার আতাউর রহমান জানান, তিনি নদী দখল করেননি। ঘরটি তিনি আবদুস সালাম নামে এক ব্যক্তি থেকে মাসিক সাড়ে ৮ হাজার টাকায় ভাড়া নিয়েছেন। আবদুল মমিন জানান, অন্যদের নদী দখল করতে দেখে তিনিও দুটি দোকান নির্মাণ করে মাইকের ব্যবসা করছেন। পানি উন্নয়ন বোর্ড উচ্ছেদ করলে চলে যাবেন। একই বাজারের জিন্নাহ জানান, আওয়ামী লীগ নেতা ফণিভুষণ পোদ্দার থেকে তিনি মাসিক ২ হাজার টাকায় দোকানটি ভাড়া নিয়েছেন। অন্যদিকে বিহঙ্গ ট্রেডার্সের মালিক রিপল জানান, পানি উন্নয়ন বোর্ডের কাছ থেকে তার শ্বশুর জায়াগা কিনে নিয়েছেন। এ ব্যাপারে পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মাহবুবুর রহমান বলেন, গাড়াদহ নদী সম্পর্কে আমার তেমন ধারণা নেই। দখল করছে কি না তাও জানা নেই। খোঁজ নিয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেব।

বরিশালের গৌরনদীর পালরদী নদীর দুই তীর দখল করে গড়ে তোলা হয়েছে অসংখ্য স্থাপনা, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। ফলে সরু হয়ে গেছে নদী। টরকীর চর এলাকায় পালরদী নদীর তীর ও নদীর মধ্যে বিস্তীর্ণ এলাকা দখল করে পৌর যুবদলের সভাপতি জাকির হোসেন শরীফ নির্মাণ করেছেন শরীফ স’মিল, ওয়ার্ড বিএনপির সাবেক সহসভাপতি শাহ আলম গড়ে তুলেছেন খান স’মিল, আওয়ামী লীগ নেতা রাজ্জাক হাওলাদার নির্মাণ করেছেন বিসমিল্লাহ অয়েল মিল। প্রভাবশালী ব্যবসায়ী খালেক মুন্সি নির্মাণ করেছেন ডাল মিল। ইব্রাহিম চৌকিদার, জামাল মিয়া (প্রয়াত), বিএনপি নেতা দুলু রায়, আলমগীর মেম্বার (প্রয়াত), ফজলু মেম্বার, রকমান ফকিরসহ অর্ধশতাধিক প্রভাবশালী ব্যক্তি গড়ে তুলেছেন শতাধিক অবৈধ স্থাপনা। গৌরনদী বন্দরসংলগ্ন নদীর অবৈধ দখলকারী রুহুল আমীন বলেন, তিনি নদী ভরাট করেননি, নদীতে জেগে ওঠা চরে দোকান নির্মাণ করেছেন। পৌর যুবদলের সভাপতি ও পৌর কাউন্সিলর জাকির শরীফ বলেন, তিনি নদীর তীর দখল করেননি। তিনি ও তার ব্যবসায়িক অংশীদার মোবারেক হোসেন ক্রয়সূত্রে স’মিলের মালিক। ডাল মিলের মালিক খালেক মুন্সির ছেলে ফরহাদ হোসেন মুন্সি বলেন, তারা ক্রয়সূত্রে ডাল মিলের মালিক। মিলের পাশে ডাল রোদে শুকানোর জন্য শুধু একটি পাকা ফ্লোর নির্মাণ করেছেন। ফ্লোরের ১০-১৫ হাত জায়গা নদীর ভিতরে হতে পারে। গৌরনদী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সাঈদ মাহবুব খান জানান, নদীর তীরে গড়ে ওঠা অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদের কয়েকটি মামলা জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে বিচারাধীন রয়েছে। জেলা প্রশাসনের আদেশ পেলেই অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করা হবে।

বরগুনার খাকদন নদীর দুই পাড় দখল করে বসতবাড়ি ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে। নদীটির দক্ষিণ পাড়ে প্রেস ক্লাব সড়কের উত্তর প্রান্তে থাকা ডিসি-এসপির লঞ্চঘাট দখল করে বাড়ি করেছেন তাদেরই কর্মচারীরা। কেউ কেউ সেই বাড়ি বিক্রিও করে গেছেন। অবৈধভাবে দখল করা খাকদন নদী থেকে দখলদারদের উচ্ছেদের পরিবর্তে দখলকারীদের লাখ লাখ টাকার বিনিময়ে ইজারা দিয়েছে সহকারী কমিশনার (ভূমি) অফিস। বর্তমানে পূর্বদিকে বুড়ীশ্বরের মোহনা পর্যন্ত দখল ও ভরাটের কারণে নদীর কোনো অস্তিত্ব নেই। অন্যদিকে বিষখালী নদী দখল করে পাথরঘাটা আর বামনা উপজেলা অংশে করা হয়েছে ইটভাটা।

নারায়ণগঞ্জের প্রাণ শীতলক্ষ্যা নদীতে ২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে ২০২১ সালের ১৭ জুন পর্যন্ত অভিযান চালিয়ে ২ হাজার ৪৭৫টি অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করা হয়। এরপর ম্যাজিস্ট্রেট না থাকায় প্রায় দেড় বছর উচ্ছেদ অভিযান বন্ধ থাকার সুযোগে ফের দখল হয়ে যায় নদীতীর। চলতি বছরের মার্চে ম্যাজিস্ট্রেট নিয়োগের পর আবারও ৭ শতাধিক অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করা হয়। তবে নারায়ণগঞ্জের বন্দর এলাকায় গড়ে ওঠা বেশ কিছু ডকইয়ার্ড ও বসতবাড়ির কারণে ওয়াকওয়ে ও সীমানা নির্ধারণী পিলার স্থাপন করা যাচ্ছে না বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।

বগুড়ায় করতোয়া ও মুন্সীগঞ্জে নদীর তীরে স্থাপনা

বগুড়ার বুক চিরে প্রবাহিত করতোয়া নদীর দুই পাড় অবৈধভাবে দখল করে গড়ে উঠেছে ছোট-বড় ভবন ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। দোকান থেকে আদায় হচ্ছে ভাড়া। কোথাও কোথাও আবার নদীর মধ্যেই সীমানাপ্রাচীর দিয়ে দখল করে ভবন তৈরি করছেন স্থানীয় প্রভাবশালীরা। বর্তমানে নদীর তীরবর্তী ২৮টিরও বেশি স্পট দখল করে বহুতল ভবন নির্মাণ চললেও দেখার কেউ নেই বলে অভিযোগ স্থানীয়দের। দূষণ, দখল, ভরাট ও বাঁধ দিয়ে মাছ চাষের কারণে নদীটি এখন মৃতপ্রায়। বগুড়া জেলা প্রশাসক মো. সাইফুল ইসলাম বলেন, জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে করতোয়া নদীর দুই পাড়ে অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদে অনেকবার অভিযান চালানো হয়েছে। ইতোমধ্যে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে অবৈধ দখলদারদের তালিকা তৈরি করা হয়েছে। তালিকা অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

মুন্সীগঞ্জ জেলার মধ্য দিয়ে পদ্মা সেতু, ঢাকা-মাওয়া এক্সপ্রেসওয়ে, ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক চলে যাওয়ায় জমির দাম বেড়েছে বহুগুণ। এ সুযোগে শুরু হয়েছে জেলার পদ্মা, মেঘনা ও ধলেশ্বরী নদীর পাড় দখলের মহোৎসব। জেলা শহরের সন্নিকটে মুক্তারপুর পুরান ফেরিঘাট এলাকায় এবং এর পূর্ব ও পশ্চিম দিকে প্রায় দেড় কিলোমিটার নদীর পাড় দখল করে নানা স্থাপনা গড়ে উঠেছে। ধলেশ্বরী পাড়ে নদী ভরাট করে অবৈধভাবে গড়ে উঠেছে বিভিন্ন শিল্প-কারখানা। শহরের নয়াগাঁও থেকে পঞ্চসার ইউনিয়নের ফিরিঙ্গি বাজার পর্যন্ত প্রায় ৩ কিলোমিটারের মধ্যে নদীর জমিতে শতাধিক ব্যবসা প্রতিষ্ঠান চোখে পড়েছে। জেলা শহরের উত্তর ইসলামপুর এলাকায় কালীদাস সাগর নামে পরিচিত নদীর পাড়ে প্রথমে অল্প অল্প করে আবর্জনা ফেলে পরে বালু দিয়ে ভরাট করেছে প্রভাবশালী মহল। গজারিয়া এলাকায় মেঘনা পাড় দখল করে গড়ে উঠেছে বিভিন্ন রিসোর্ট ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। এ ছাড়া ভয়াবহ দখলের কবলে সাভারের বংশী নদী, তুরাগ, ধলেশ্বরীসহ বিভিন্ন খাল, চট্টগ্রামের কর্ণফুলী নদী।

এদিকে জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দেশের কৃষি ও গ্রামীণ অর্থনীতি এসব নদনদী, খাল-বিল, হাওর-বাঁওড় ও অন্যান্য জলাশয়ের ওপর নির্ভরশীল। বাংলাদেশের কৃষি ও গ্রামীণ অর্থনীতি টিকিয়ে রাখতে নদনদী দখল রোধের পাশাপাশি নিয়মিত খননের মাধ্যমে নাব্য ধরে রাখতে হবে। নদী কমিশনের চেয়ারম্যান মনজুর আহমেদ চৌধুরী বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, নদী দখলদাররা অনেক প্রভাবশালী। নদী রক্ষার দায়িত্বে থাকা সরকারি সংস্থাগুলোর অনেকে কমিশনের পরামর্শ শুনছে না। আবার নদী দখলমুক্ত করতে গিয়ে স্থানীয় প্রশাসনের অনেক কর্মকর্তা উল্টো বিপদে পড়ছেন। ক্যারিয়ারের ভয়ে প্রশাসন ঠিকভাবে কাজ করতে পারছে না। অনেক সরকারি প্রতিষ্ঠানও নদী দখল করেছে। এদের একসঙ্গে উৎখাতের শক্তি কমিশনের নেই। তাই ধারাবাহিকভাবে করছেন।

এই রকম আরও টপিক

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর