শিরোনাম
সোমবার, ১১ সেপ্টেম্বর, ২০২৩ ০০:০০ টা

পপি চাষের স্বর্গভূমি ব্ল্যাক ট্রায়াঙ্গেল

♦ হাজার হাজার একর জমিতে হচ্ছে চাষ ♦ পাচার বাংলাদেশসহ বিভিন্ন দেশে

মুহাম্মদ সেলিম, চট্টগ্রাম

পপি চাষের স্বর্গভূমি ব্ল্যাক ট্রায়াঙ্গেল

মরণনেশা হেরোইন ও আফিম তৈরির অন্যতম উপাদান ‘পপি’ চাষের স্বর্গভূমিতে পরিণত হয়েছে বাংলাদেশ-ভারত-মিয়ানমারের ত্রিদেশীয় সীমান্ত এলাকা ‘ব্ল্যাক ট্রায়াঙ্গেল’। প্রায় ৩০ হাজার বর্গকিলোমিটারের দুর্গম এলাকায় প্রতি বছর হাজার হাজার একর জমিতে চাষ হচ্ছে পপির। এ অঞ্চলে উৎপাদিত হেরোইন-আফিম পরবর্তীতে পাচার হচ্ছে বাংলাদেশসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে। দেশের সীমান্ত এলাকার অপরাধ নিয়ে গবেষণা করছেন মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের চট্টগ্রাম বিভাগীয় গোয়েন্দা কার্যালয়ের উপ-পরিচালক হুমায়ন কবির খোন্দকার। তিনি বলেন, ‘শুধু ইয়াবা কিংবা ক্রিস্টাল ম্যাথের প্রধান রুট নয়, দুই দশক ধরে বাংলাদেশের আফিমের উৎসেও পরিণত হয়েছে ব্ল্যাক ট্রায়াঙ্গেল। ব্ল্যাক ট্রায়াঙ্গেলের সক্রিয় বিচ্ছিন্নবাদী গ্রুপগুলো বান্দরবান ও রাঙামাটি জেলার দুর্গম সীমান্ত এলাকার স্থানীয়দের পপি চাষে উদ্বুদ্ধ করে। পপি থেকে উৎপাদিত আফিম পাচারে নিশ্চিয়তা দেয়। ব্ল্যাক ট্রায়াঙ্গেলে বিচ্ছিন্নবাদীদের নিয়ন্ত্রণ বেড়ে যাওয়ায় আফিম উৎপাদনও বেড়ে গেছে, যা পাচার হচ্ছে বাংলাদেশসহ বিভিন্ন দেশে।’ তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশের সীমান্ত এলাকায় যৌথ অভিযানে পপি খেত ধ্বংস করা হচ্ছে নিয়মিত। দেশেও বিভিন্ন জায়গায় উদ্ধার হচ্ছে। কিন্তু মিয়ানমারে পপি খেত ধ্বংস, আফিম-হোরোইন উদ্ধার তৎপরতা একেবারের শূন্যের কোটায়।’

নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিজিবির এক কর্মকর্তা বলেন, ‘বাংলাদেশ অংশে নিয়মিত অভিযান চালিয়ে পপি খেত ধ্বংস করা হয়। কিন্তু মিয়ানমার অংশের পপি খেত সব সময় অরক্ষিত থাকছে। ফলে মিয়ানমার অংশ থেকে উৎপাদিত হেরোইন ও আফিম প্রবেশ করছে দেশে।’ চলতি বছর জাতিসংঘের প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়- আফগানিস্তানের পরই বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম আফিম উৎপাদনকারী দেশ হচ্ছে মিয়ানমার। মিয়ানমারে উৎপন্ন আফিমের অর্থনৈতিক মূল্য বছরে ২০০ কোটি ডলার। গত ৯ বছরের মধ্যে মিয়ানমারে আফিম উৎপাদন সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছেছে। ২০২২ সালে মিয়ানমারে আফিম উৎপাদন হয় ৭৯৫ মে. টন। ২০২১ সালে যা ছিল ৪২৩ মে. টন। বাংলাদেশ মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের কর্মকর্তাদের মতে- মিয়ানমারে যত আফিম উৎপাদন হয় তার বেশির ভাগই আসে চীন ও রাখাইন রাজ্য থেকে, যা আলোচিত ব্ল্যাক ট্রায়াঙ্গেলের অংশ।

অনুসন্ধানে জানা যায়, দক্ষিণ এশিয়ার নতুন অপরাধ ক্ষেত্রে পরিণত হওয়া বাংলাদেশ-ভারত এবং মিয়ানমারের ত্রিদেশীয় দুর্গম পাহাড়ি ব্ল্যাক ট্রায়াঙ্গেলে ব্যাপক হারে উৎপাদন হচ্ছে হেরোইন ও আফিম তৈরির উপকরণ পপি। ভারতের মিজোরাম রাজ্য, বাংলাদেশের বান্দরবান ও রাঙামাটি এবং মিয়ানমারের চীন ও রাখাইন রাজ্যের ৩০ হাজার বর্গকিলোমিটারের ‘ব্ল্যাক ট্রায়াঙ্গেলের বেশির ভাগই হচ্ছে দুর্গম পাহাড়ি এলাকায়। অস্ত্র ও মাদক পাচারের স্বর্গরাজ্যে পরিণত হওয়া অঞ্চলটিতে প্রতি বছরই হাজার হাজার একর পাহাড়ি ভূমিতে চাষ হচ্ছে পপির। এর মধ্যে মিয়ানমারের পশ্চিমাঞ্চলের চীন পাহাড়, আরাকান পর্বত শ্রেণি, মাইয়ু পাহাড়, বাংলাদেশ-মিজোরাম রাজ্যের দুর্গম সীমান্ত এবং সীমান্ত সংলগ্ন চীন ও রাখাইন রাজ্য এবং বঙ্গোপসাগর উপকূলীয় এলাকায় ব্যাপক হারে পপি চাষ হচ্ছে। বাংলাদেশ অংশে রাঙামাটি, বান্দরবান এবং টেকনাফের কিছু এলাকায় পপি চাষ হচ্ছে। বাংলাদেশ এবং ভারতের আইনপ্রয়োগকারী সংস্থা নিজেদের নিয়ন্ত্রিত এলাকায় অভিযান চালিয়ে পপি গাছ ধ্বংস করছে। মিয়ানমার অংশে কোনো অভিযান না হওয়ায় পপি চাষিরা থাকছে ‘সুরক্ষিত’। প্রতি বছর অক্টোবর থেকে নভেম্বর মাসের মধ্যে দুর্গম ব্ল্যাক ট্রায়াঙ্গেলে পপি বীজ বুনে মাদক কারবারিরা। জানুয়ারি থেকে মার্চের মধ্যেই পপি পরিপূর্ণ রূপ ধারণ করে। প্রতি একর পপি জমি থেকে ৮ থেকে ১২ কেজি আফিম উৎপাদন হয়। এ অঞ্চলে উৎপাদিত আফিম ‘ফার্মগেটে’ বাংলাদেশ অংশে প্রতি কেজি ২৬০ থেকে ২৮০ ডলার, মিয়ানমার ও মিজোরাম অংশে ২৮০ থেকে ৩০০ ডলার বিক্রি হয়। গত কয়েক বছরে বাংলাদেশে বান্দরবান, রাঙামাটিসহ কিছু কিছু এলাকায় যৌথ অভিযান চালিয়ে শত শত একর পপি চাষ ধ্বংস করেছে আইনপ্রয়োগকারী সংস্থার সদস্যরা। এর মধ্যে চলতি বছরই বান্দরবানের থানচি, রুমা, আলীকদম, রোয়াংছড়ি উপজেলার দুর্গম পাহাড়ি এলাকায় ধ্বংস করা হয়েছে ৮৭ একর জমির পপি গাছ। এর মধ্যে ২৩ ফেব্রুয়ারি থানচি উপজেলার ২ নম্বর তিন্দু ইউনিয়নের ১ নম্বর কোঅং খুমি পাড়ায় ধ্বংস করা হয় ৪৫ একর পপি খেত। ১৬ ফেব্রুয়ারি থানচিতে পৃথক অভিযানে ধ্বংস করা হয় সাড়ে ৩০ একক পপি খেত। ২ ফেব্রুয়ারি থানচির তিন্দু ইউনিয়নের পাইরিং ¤্রান্ডে এলাকায় ধ্বংস করা হয় সাত একর পপি খেত। ২৪ জানুয়ারি একই এলাকার কাইকা খুচিপাড়ায় ধ্বংস করা হয় পাঁচ একর পপি খেত। এছাড়া ২০২০ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারি বান্দরবান জেলার তেন্দুমুখ এলাকায় ধ্বংস করা হয় ১ একর পপি খেত।

 

 

 

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর