শিরোনাম
সোমবার, ১১ সেপ্টেম্বর, ২০২৩ ০০:০০ টা
সুজনের আলোচনায় বক্তারা

সহিংসতা নয়, সমঝোতার পথ খোঁজাই সমাধান

নিজস্ব প্রতিবেদক

নির্বাচনী সরকার ব্যবস্থা নিয়ে দুই দলই অনড় অবস্থানে। বিরোধের জায়গা জিরো সাম গেমে পরিণত হয়েছে। দুই দলের অনড় অবস্থান দেশকে সংঘাত ও অস্থিতিশীলতার দিকে ঠেলে দিচ্ছে। সংলাপ-সমঝোতার পথ একেবারে রুদ্ধ হয়নি। জাতীয় স্বার্থকে প্রাধান্য দিয়ে দুই পক্ষের দ্রুত আলোচনার টেবিলে বসা প্রয়োজন বলে মনে করছেন আলোচকরা। গতকাল ‘সমঝোতা নাকি সহিংসতা : কোন পথে আমরা?’ শীর্ষক সভায় আলোচকেরা এসব কথা বলেন। অনলাইনে এই সভার আয়োজন করে সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন)।

সূচনা বক্তব্যে সুজন সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার বলেন, সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা অনুযায়ী আগামী ১ নভেম্বর ২০২৩ থেকে ২৯ জানুয়ারি ২০২৪-এর মধ্যে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা রয়েছে। সবার চাওয়া এই নির্বাচন হবে সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও প্রতিযোগিতামূলক। কিন্তু বিরাজমান রাজনৈতিক বাস্তবতা প্রতিযোগিতামূলক নির্বাচনের জন্য অনুকূল না।

বদিউল আলম বলেন, সামনে নির্বাচন আসছে। দুই দলই নির্বাচনী সরকার ব্যবস্থা নিয়ে যার যার অবস্থানে অনড়। বিরোধের জায়গা জিরো সাম গেমে পরিণত হয়েছে। নির্বাচনকালীন সরকারব্যবস্থা কেমন হবে, সে বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে কোনো সমঝোতা হয়নি। যার পরিণতি হতে পারে জাতির জন্য চরম অমঙ্গলকর। নির্বাচন নিয়ে ইতোমধ্যে তৈরি হওয়া উত্তাপ-উত্তেজনা ভয়াবহ সহিংসতার দিকে ধাবিত করতে পারে। তাই আমরা রাজনৈতিক দলগুলোকে আলোচনার টেবিলে বসার আহ্বান জানাই।’

সুজন সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদারের সঞ্চালনায় অনুষ্ঠিত এই গোলটেবিল বৈঠকে সাবেক নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) ড. এম সাখাওয়াত হোসেন, মানবজমিনের প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী, সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী শাহদীন মালিক, স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ ড. তোফায়েল আহমেদ, ঢাকা-১৭ আসনের সংসদ সদস্য মোহাম্মদ আলী আরাফাত, গাইবান্ধা-১ আসনের সংসদ সদস্য শামীম হায়দার পাটোয়ারী, সাবেক সংসদ সদস্য বিএনপির আন্তর্জাতিক বিষয়ক সহ-সম্পাদক রুমিন ফারহানা, গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকি, অধ্যাপক রোবায়েত ফেরদৌস, সুজন-এর প্রধান কেন্দ্রীয় সমন্বয়কারী দিলীপ কুমার সরকারসহ অন্যান্যরা উপস্থিত ছিলেন।

মতিউর রহমান চৌধুরী বলেন, রাজনৈতিক দলগুলো সবাই ক্ষমতায় যেতে ব্যস্ত। তারা অন্য কিছু চিন্তা করতে পারে না। দুই পক্ষের কেউই সমঝোতায় যেতে যায় না। তারা চায় কেবল তাদেরটাই হোক। তৃতীয় পক্ষ ছাড়া এদেরকে কখনো আলাপে বসানো যায় না। বাংলাদেশ এখন সুপার পাওয়ারের লড়াই চলছে। এর পরিণতি দেশকে কোথায় নিয়ে যাবে কেউ বলতে পারে না। এ অবস্থায় রাজনীতিবিদদেরকেই দেশের রাজনীতি ঠিক করতে হবে।

এম সাখাওয়াত হোসেন বলেন, জাতীয় পরিচয় নিবন্ধন বিলে বলা হয়েছে, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কাছ থেকে তথ্য নিয়ে ভোটার তালিকা করতে হবে। এটি একটি সিরিয়াস ধারা। পুরোপুরি সংবিধান পরিপন্থী এটি নিয়ে পরবর্তী পর্যায়ে বড় রকমের গন্ডগোল হবে। তিনি বলেন, গণপ্রতিনিধিত্ব অধ্যাদেশের ৯১(ক) ধারায় সংশোধনী এনে নির্বাচনের ওপর কমিশনের সার্বিক নিয়ন্ত্রণ দুর্বল করা হয়েছে। মুখ দিয়ে বলবেন, ইসিকে শক্তিশালী করতে হবে। আর তার অঙ্গ কাটতে শুরু করলেন। শাহদীন মালিক বলনে, আগে রাজনৈতিক দলগুলো জনগণের ভালো করার কিছু উদ্দেশ্য ছিল। কিন্তু এখন রাজনীতির মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতাকে ব্যবহার করে নিজেদের অর্থ বৃদ্ধি করা। বিভিন্ন দল বিভিন্ন দফা দিচ্ছে কিন্তু জনগণকে ২০ টাকা দিয়ে চাল খাওয়ানোর কথা কেউ বলেনি। কেউ বলেনি বেকারের জন্য ভাতার ব্যবস্থা করবে। তোফায়েল আহমেদ বলেন, আমার মনে হয় বর্তমান পরিস্থিতিতে নির্বাচন কমিশন সুপ্রিম কোর্টের মাধ্যমে রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে নির্দেশনা পাঠাতে পারে। দলগুলো নিজেদের মধ্যে আলাপ-আলোচনা করে ঠিক করুক কোন পদ্ধতিতে তারা নির্বাচন করবে। এরপর তা কমিশনকে জানাক, কমিশন সে অনুযায়ী নির্বাচন করবে। মোহাম্মদ আরাফাত বলেন, সব সমস্যার সমাধান একদিনে করা যাবে না।

 সব সমস্যার সমাধান একসঙ্গে করতে গেলে জগাখিচুড়ি হয়ে যাবে। আবার একটি দলের পক্ষেও সব সমাধান করা সম্ভব নয়। এ জন্য সবাইকে একসঙ্গে হয়ে সমাধান করতে হবে। আমরা একটি জায়গা থেকে শুরু করতে পারি, যেমন নির্বাচনী প্রক্রিয়া। নির্বাচনী প্রক্রিয়াকে শক্ত ভিত্তির ওপর দাঁড় করাতে হলে কী কী করা যেতে পারে তার সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব নিয়ে আলাপ শুরু করা যেতে পারে। কিছু বিষয়ে একমত হওয়া যে আমরা এই বিষয়গুলোতে হাত দেব না। শামীম হায়দার পাটোয়ারী বলেন, সমঝোতা যে চাই প্রথমে এটি নিয়ে সমঝোতা হওয়া দরকার। নির্বাচনী ব্যবস্থা একদিনে ভাঙেনি, ধারাবাহিকভাবে ভেঙেছে। ত্রিদলীয় জোটের রূপরেখা তিন দিনের মধ্যে ভেঙে ফেলা হয়ছিল। তাই মূল কাজ হচ্ছে প্রতিষ্ঠানগুলো শক্তিশালী হওয়া। সবাইকে একমত হতে হবে যে আমরা প্রতিষ্ঠানে হাত দেব না। আগামী কয়েক মাসে প্রচুর রক্তপাতের আশঙ্কা করছেন বলে জানান বিএনপির সাবেক সংসদ সদস্য রুমিন ফারহানা। আলাপ-আলোচনার লক্ষণ দেখতে পাচ্ছেন না বলেন তিনি। আন্দোলনের মধ্য দিয়ে রাজপথে দাবি আদায় করতে হবে বলে জানান। তিনি বলেন, ‘২০১৮ সালের নির্বাচনের আগে সুন্দর পরিবেশে আলোচনা হয়েছিল। কেমন নির্বাচন হয়েছে সবাই দেখেছে। তাই আলোচনার ওপর বিশ্বাসও থাকতে হবে।’ জোনায়েদ সাকি বলেন, বিরোধী দলের আন্দোলনে গুণগত পরিবর্তন ঘটেছে। বর্তমানে আন্দোলনের কেন্দ্রীয় লক্ষ্য হলো একটি নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্ত প্রণয়ন করা। রাষ্ট্র ব্যবস্থার গুণগত সংস্কার করে বাংলাদেশের ভবিষ্যতের জন্য সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব নিয়ে এগোচ্ছে। রোবায়েত ফেরদৌস বলেন, ক্ষমতার ঝুঁকি হচ্ছে স্বৈরাচারী হওয়া। এ জন্য ক্ষমতাকে চেক অ্যান্ড ব্যালেন্সের মধ্যে রাখতে হয়। জবাদিহিতা নিশ্চিত করতে হয়। সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ নিয়ে কথা হয়। ৭০ অনুচ্ছেদ কোনো লিগ্যাল ব্যাপার নয়। সংসদের বাইরেও কোনো নেতা কি তার দলের সমালোচনা করতে পারে? আমরা কোনোদিন দেখিনি। তাই ৭০ অনুচ্ছেদ আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতিরই প্রতিফলন। সংকট নিরসনে জাতীয় সনদ : সভায় সুজনের পক্ষ থেকে বর্তমান রাজনৈতিক সংকট থেকে উত্তরণের লক্ষ্যে ১৭ দফার জাতীয় সনদের প্রস্তাব তুলে ধরা হয়। সুজনের কেন্দ্রীয় সমন্বয়কারী দিলীপ কুমার সরকার এটি পড়ে শোনান। জাতীয় সনদে সম্ভাব্য ঐকমত্যের মধ্যে রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে পরিবর্তন, কার্যকর জাতীয় সংসদ, স্বাধীন বিচার বিভাগ, সাংবিধানিক সংস্কার, গণতান্ত্রিক ও স্বচ্ছ রাজনৈতিক দল, স্বাধীন বিধিবদ্ধ প্রতিষ্ঠান, দুর্নীতিবিরোধী সর্বাত্মক অভিযান, প্রশাসনিক সংস্কার, বিকেন্দ্রীকরণ ও স্থানীয় সরকার, গণমাধ্যমের স্বাধীনতা, শক্তিশালী নাগরিক সমাজ, মানবাধিকার সংরক্ষণের মতো বিষয় রয়েছে। সুজন সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার বলেন, এই বিষয়গুলো প্রাথমিক বিষয় হিসেবে ধরে নিয়ে আলাপ-আলোচনা হতে পারে। ঐকমত্য সৃষ্টির মাধ্যমে ‘জাতীয় সনদ’ প্রণয়ন ও স্বাক্ষর করা সম্ভব হলে রাজনীতিতে একটি নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্ত প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পথ সুগম হবে। তবে রাজনৈতিক বন্দোবস্ত বাস্তবায়নের জন্য প্রয়োজন সুষ্ঠু নির্বাচন।

 

 

সর্বশেষ খবর