সোমবার, ১১ সেপ্টেম্বর, ২০২৩ ০০:০০ টা

ছয় বছরের শিশুকে হত্যার নেপথ্যে ১৫ হাজার টাকা

মাহবুব মমতাজী

ছয় বছরের শিশু মেহেদী হাসান। ঢাকার সাভারের সামাইর-বিরুলিয়া সড়কে জিএম গার্মেন্টসের উত্তর পাশে একটি ঝোপে থাকা ব্যাগের ভিতরে ওই শিশুর লাশ পাওয়া যায়। পরে লাশটি ময়নাতদন্তের জন্য রাজধানীর শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ মর্গে নেওয়া হয়। এ ঘটনা ২০২০ সালের ১২ অক্টোবরের। এর প্রায় আড়াই বছর পর শিশু হত্যার রহস্য উদঘাটন করেছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। হত্যার নেপথ্যে ছিল মাত্র ১৫ হাজার টাকা। লাশটি উদ্ধারের পরদিনই সাভার মডেল থানায় একটি মামলা হয়। সিআইডির তদন্ত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, গোলাম কবীর ও পারুল আক্তার দম্পতি সাভারে একটি গার্মেন্টসে চাকরি করতেন। তাদের শিশু সন্তান মেহেদীকে নিয়ে তারা কাকাবো সাকিন এলাকার আবদুল করিমের বাড়িতে ভাড়া থাকতেন। জসিম (২০) নামে এক যুবক ভাড়া থাকতেন তাদের পাশের ঘরে। করোনা মহামারির সময় সাধারণ ছুটি ঘোষণার বাইরে কর্মস্থলে অনুপস্থিত থাকায় জসিমের চাকরি চলে যায়। তখন তিনি বিভিন্ন স্থানে কাজের সন্ধান করছিলেন। অবসরে জসিম তার বন্ধু আরমানের (২৩) সঙ্গে আড্ডা দিয়ে সময় কাটাতেন। এ সময় জসিমের তালাকপ্রাপ্ত বড় বোন আনিসা খাতুন (২৮) তার ভাড়া বাসায় বেড়াতে আসেন। ওই বাড়িতেই আনিসা বসবাস করতে থাকেন। গোলাম কবীর ও পারুল কর্মস্থলে চলে গেলে তাদের দুই ছেলে পারভেজ হাসান (১২) ও মেহেদী হাসান (৬) বাসাতেই থাকত। তাদের বাড়িওয়ালার পরিবার এবং জসিমের বড় বোন আনিসা মাঝে মাঝে দেখাশোনা করতেন। ২০২০ সালের ১২ অক্টোবর সকাল পৌনে ৮টায় অন্যদিনের মতো গোলাম কবীর ও পারুল নিজ নিজ কর্মস্থলে চলে যান। এরপর তাদের বড় ছেলে প্রাইভেট পড়তে চলে যায়। এ সময় ছোট ছেলে মেহেদী ঘরে বসে টিভি দেখছিল। সকাল ৯টায় পারভেজ প্রাইভেট পড়া শেষে বাসায় ফিরে এসে ছোট ভাই মেহেদী হাসানকে বাসায় দেখতে না পেয়ে বিষয়টি তার মা পারুলকে মোবাইল ফোনে জানায়। খবর পেয়ে পারুল বিষয়টি স্বামীকে জানান। উভয়ই গার্মেন্টস থেকে দ্রুত বাসায় চলে আসেন। ছোট ছেলে মেহেদী হাসানকে তারা বিভিন্ন স্থানে খোঁজাখুঁজি করতে থাকেন। এক পর্যায়ে ওইদিন বিকাল পৌনে ৬টায় তাদের বাড়িওয়ালার ছেলে জিহাদের (১৭) ফোনে অজ্ঞাত মোবাইল নম্বর থেকে মুক্তিপণ দাবি করে একটি মেসেজ আসে।  মেসেজে বলা হয়- ‘মেহেদী হাসানকে আটক করা হয়েছে এবং তাকে পেতে হলে ১৫ হাজার টাকা দিতে হবে।’ ওই মেসেজে একটি বিকাশ নম্বরও দেওয়া ছিল। সেই নম্বরে টাকা পাঠাতে বলা হয়। গোলাম কবীর ছোট ছেলের কোনো ক্ষতি হওয়ার আশঙ্কায় ওই বিকাশ নম্বরে মুক্তিপণের পুরো ১৫ হাজার টাকা পাঠিয়ে দেন। এরপরও তিনি ছেলের সন্ধান পাননি।

মামলার তদন্ত কর্মকর্তা সিআইডির পুলিশ পরিদর্শক দিলরুবা পারভীন জানান, মেহেদী হাসান নিখোঁজ হওয়ার পর জসিমকে বাসায় দেখতে না পেয়ে তার ব্যাপারে বোন আনিসা খাতুনকে জিজ্ঞাসা করলে সে অসংলগ্ন কথাবার্তা বলেন। এটি গোলাম কবীর ও পারুলের মনে সন্দেহের উদ্রেক করে। তারা স্থানীয় লোকজনকে সঙ্গে নিয়ে জসিমের খোঁজ করতে থাকেন। খোঁজাখুঁজির একপর্যায়ে ওইদিন রাত ১১টায় সাভারের খাগান বাসস্ট্যান্ডে জসিমকে দেখতে পান। তাকে ডাক দিলে তিনি দৌড়ে পালানোর চেষ্টা করেন। স্থানীয়রা তাকে ধরে ফেলে এবং মেহেদীর বিষয়ে জিজ্ঞেস করে। তিনি সন্তোষজনক জবাব দিতে না পারায় তাকে পুলিশে দেওয়া হয়।

সিআইডি বলছে, পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে জসিম জানায়, ঘটনার দিন মেহেদী একা একা বাসায় বসে টিভি দেখছিল। এ সময় জসিম, তার বন্ধু আরমান ও বোন আনিসা খাতুন মিলে পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী স্যান্ডো গেঞ্জি দিয়ে গলায় ফাঁস দিয়ে তাকে হত্যা করে। পরে মাল্টিপ্লাগের তার দিয়ে হাত-ভাঁজ করে বেঁধে একটি সাদা প্লাস্টিকের বস্তার ভিতর ভরে ফেলে। বস্তাটি একটি স্কুল ব্যাগের ভিতর ভরে ব্যাগের মুখ কালো তার দিয়ে বেঁধে ফেলে। এরপর জিএম গার্মেন্টসের উত্তর পাশে ঝোপের ভিতর ব্যাগটি ফেলে দেয়।

সিআইডির অতিরিক্ত বিশেষ পুলিশ সুপার আজাদ রহমান এ প্রতিবেদককে জানান, প্রথমে জসিম ও তার বোন আনিসাকে গ্রেফতার করে আদালতে সোপর্দ করা হয়। সাভার মডেল থানা পুলিশ তদন্ত শেষে জসিমের বন্ধু আরমান ও আনিসাকে অব্যাহতি দিয়ে শুধু জসিমের বিরুদ্ধে চার্জশিট দেয়। পরবর্তীতে মামলাটি সিআইডিতে এলে তদন্ত করে দেখা গেছে চাকরি না থাকার কারণে জসিমের আর্থিক সংকট যাচ্ছিল। সে ও তার বন্ধু আরমান মেহেদীকে অপহরণ করে মুক্তিপণ আদায়ের জন্য পরিকল্পনা করে। গোলাম কবীর ও পারুল কর্মস্থলে চলে গেলে পরিকল্পনা অনুযায়ী জসিম ঘরে যায়। সেখান থেকে মেহেদীকে তার নিজের ঘরে নিয়ে আসে সেখানে তার বোন আনিসা ছিল। কিছুক্ষণ পরেই তার বন্ধু আরমানও সেখানে চলে আসে। তখন তারা মুক্তিপণের জন্য মেহেদীকে শ্বাসরোধে হত্যার পর লাশ গুম করার সিদ্ধান্ত নেয়। জসিম, আরমান ও আনিসা পরস্পরে লাশ ব্যাগবন্দি করে ঝোপের ভিতর ফেলে দেয়। ওই তিনজনের বিরুদ্ধে দ্রুতই আদালতে চার্জশিট দেওয়া হবে।

 

 

সর্বশেষ খবর