বুধবার, ১৩ সেপ্টেম্বর, ২০২৩ ০০:০০ টা

শিক্ষার বেহাল দশা

♦ সৃজনশীল পদ্ধতি বোঝেন না শিক্ষকরাই ♦ বাইরে থেকে প্রশ্ন কিনে নেন পরীক্ষা! ♦ পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণ নেই শিক্ষকদের ♦ সৃজনশীল হতে পারছে না ছাত্র-ছাত্রীরা ♦ মাউশির একাডেমিক সুপারভিশন প্রতিবেদন

আকতারুজ্জামান

শিক্ষার বেহাল দশা

মুখস্থনির্ভর পড়াশোনার পরিবর্তে শিক্ষার্থীদের প্রকৃত মেধা যাচাই করার লক্ষ্যে গত ২০০৮ থেকে সৃজনশীল প্রশ্নপদ্ধতি চালু করা হয়েছিল। এরপর কেটে গেছে ১৫ বছর। কিন্তু সৃজনশীল পদ্ধতি সফল করা যায়নি। দীর্ঘদিন চলা এ শিক্ষাপদ্ধতি পুরোপুরি বুঝে উঠতে পারেননি শিক্ষকরাই, বোঝাতে পারছেন না ছাত্র-ছাত্রীদেরও। স্কুলগুলো ছাত্র-ছাত্রীদের পরীক্ষা নিচ্ছে বাইরের কোনো সমিতি বা প্রতিষ্ঠান থেকে প্রশ্নপত্র কিনে। কেউবা প্রশ্নপত্র প্রণয়ন করছেন অন্য কোনো প্রতিষ্ঠানের সহায়তা নিয়ে। কম্পিউটার প্রশিক্ষণ, আইসিটি প্রশিক্ষণ, সৃজনশীল প্রশিক্ষণ, কারিকুলামসহ বিভিন্ন বিষয়ে প্রশিক্ষণ নেই অনেক শিক্ষকের- যার নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে শিক্ষায়। মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা (মাউশি) অধিদফতরের একাডেমিক সুপারভিশনের প্রতিবেদনে এসব তথ্য উঠে এসেছে। সৃজনশীলে শিক্ষকদের অযোগ্যতা, অনভিজ্ঞতাসহ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের নানা সংকট শিক্ষার বেহাল দশার চিত্রই তুলে এনেছে বলে মনে করছেন শিক্ষাবিদরা। তারা বলছেন, ব্যর্থ হয়েছে সরকারের সৃজনশীল পদ্ধতি, আর নতুন কারিকুলামে ধ্বংস হতে বসেছে শিক্ষা। মাউশির অধিদফতরের পরিকল্পনা ও উন্নয়ন উইংয়ের অ্যাকসেস অ্যান্ড কোয়ালিটি অ্যাস্যুরেন্স ইউনিট (একিউএইউ) একাডেমিক সুপারভিশনের প্রতিবেদন তৈরি করেছে। তথ্য বলছে, মাউশির ৯টি আঞ্চলিক কার্যালয়ের ১২ হাজার ৬২৬ বিশ্ববিদ্যালয় গত জানুয়ারিতে পরিদর্শন করা হয়েছে। এর মধ্যে সুপারভিশন করা হয়েছে ৫ হাজার ৯৫২টি বিদ্যালয়। সুপারভিশনকৃত বিদ্যালয়ের তথ্য দিয়েই প্রতিবেদন তৈরি করা হয়েছে।

তথ্যমতে, সৃজনশীল পদ্ধতিতে জ্ঞান, অনুধাবন, প্রয়োগ, তুলনা, বিশ্লেষণ, সংশ্লেষণ ও মূল্যায়নের ওপর জোর দেওয়া হয়। এ পদ্ধতিতে সব থেকে কার্যকর ভূমিকা পালন করেন বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা। ছাত্র-ছাত্রীদের সামগ্রিক ও মানসিক ভারসাম্যপূর্ণ বিকাশের স্বার্থে শিক্ষকরাই সৃজনশীল প্রশ্ন প্রণয়ন করবেন। কিন্তু তথ্য বলছে, মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা (মাউশি) অধিদফতরের একাডেমিক সুপারভিশন করা ৫ হাজার ৯১৫ বিদ্যালয়ের মধ্যে ২ হাজার ৩২০টি বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা সৃজনশীলে প্রশ্নই প্রণয়ন করতে পারেন না। এদের মধ্যে ৯২৬টি বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা অন্য বিদ্যালয়ের শিক্ষকের সহযোগিতায় সৃজনশীলে প্রশ্ন প্রণয়ন করেন। আর ১ হাজার ৩৯৪টি বিদ্যালয় বাইরে থেকে প্রশ্ন কিনে সৃজনশীল পরীক্ষা নেন।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, নিজেরা সৃজনশীল পদ্ধতিতে প্রশ্ন প্রণয়ন করে পরীক্ষা নেওয়ার হার সিলেটে বেশি, যা ৮৬ দশমিক ৯ শতাংশ। আর রাজশাহী বিভাগের মাত্র ৩৮ দশমিক ৮১ শতাংশ বিদ্যালয় নিজেরা প্রশ্ন করে সৃজনশীলে পরীক্ষা নিয়ে থাকে। অন্য বিদ্যালয়ের সহায়তায় সৃজনশীল প্রশ্ন করার ক্ষেত্রে এগিয়ে আছে বরিশাল বিভাগের বিদ্যালয়গুলো। বাইরে থেকে প্রশ্ন কিনে বেশি পরীক্ষা নিয়ে থাকে রাজশাহী বিভাগের বিদ্যালয়গুলো। প্রতিবেদন বলছে, সৃজনশীল পদ্ধতি নিশ্চিত করতে হলে বাইরে থেকে প্রশ্নপত্র কিনে পরীক্ষা নেওয়া পুরোপুরি নিষিদ্ধ করতে হবে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ড. ছিদ্দিকুর রহমান গতকাল প্রতিবেদককে বলেন, ১৫ বছরেও শিক্ষকরাই সৃজনশীল হতে পারেননি। শিক্ষক সৃজনশীল না হলে ছাত্র-ছাত্রীদের তারা সৃজনশীল করবেন কীভাবে? দীর্ঘ সময় ধরে চলা এ সৃজনশীল পদ্ধতি ব্যর্থ হয়েছে। এ পদ্ধতিতে শিক্ষকদেরই অযোগ্যতা, অদক্ষতা রয়েছে। এখন তারা প্রশ্ন করেন বাইরে থেকে প্রশ্ন কিনে, যা আমাদের শিক্ষার দৈন্যদশা দেখিয়ে দিয়েছে। এ শিক্ষাবিদ বলেন, যেসব অযোগ্য-অদক্ষ শিক্ষকদের মাধ্যমে সৃজনশীল সফল করা যায়নি তাদের দিয়েই নতুন কারিকুলাম চালু করা হলো! তিনি বলেন, সৃজনশীল পদ্ধতি ব্যর্থ হয়েছে আর এসব অদক্ষ শিক্ষক দিয়ে নতুন কারিকুলাম চালু করার ফলে নতুন কারিকুলাম ধ্বংস হতে বসেছে। প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, সুপারভিশন করা বিদ্যালয়ের মধ্যে ১ হাজার ৬৮৬-তে কোনো বিজ্ঞানাগার নেই। বিজ্ঞানাগার থাকলেও ৫৫৫টি ব্যবহার করা হয় না। ৩ হাজার ৪০৮টি বিদ্যালয়ে আইসিটি বা কম্পিউটার ল্যাব নেই। আর ২৯৪টি বিদ্যালয়ে কম্পিউটার ল্যাব থাকলেও তা ব্যবহার করা হয় না। প্রতিবেদনে বলা হয়, ৩ হাজার ৩৮টি বিদ্যালয়ে স্থায়ী মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুম নেই। এ ছাড়া বিজ্ঞানাগার নেই ১ হাজার ৬৮৬টিতে, লাইব্রেরি নেই ৮৯৬টিতে। প্রতিবেদন বলছে, জাতীয় লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী শিক্ষার মান বৃদ্ধি করতে হলে শিক্ষকদের পেশাগত মানোন্নয়ন অপরিহার্য। বিশ্বায়নের সঙ্গে সমান তালে চলার জন্য প্রয়োজন প্রশিক্ষণ। আর শিক্ষকদের পেশাগত উন্নয়নের জন্য প্রশিক্ষণের কোনো বিকল্প নেই। সুপারভিশনকৃত বিদ্যালয়ের মধ্যে মোট কর্মরত শিক্ষক সংখ্যা ৫৯ হাজার ৪৮৮ জন। কিন্তু এসব শিক্ষকের মধ্যে বিএড ডিগ্রি নেই ১৫ হাজার ৭৪৯ শিক্ষকের। এ ছাড়া পিবিএম প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত নন ২২ হাজার ১৬২ শিক্ষক, আইসিটি প্রশিক্ষণ নেই ৩২ হাজার ৩ শিক্ষকের, কম্পিউটার বিষয়ে প্রশিক্ষণ নেই ৩৬ হাজার ৫৮৪ জনের, কারিকুলাম বিষয়ে প্রশিক্ষণ নেই ২৫ হাজার ৩৮৩ জনের আর সৃজনশীল বিষয়ে প্রশিক্ষণ নেই ২৫ হাজার ৩৮০ শিক্ষকের। এসব বিষয়ে প্রশিক্ষণ না থাকা শিক্ষকরাই ক্লাসে পড়াচ্ছেন ছাত্র-ছাত্রীদের। প্রশিক্ষণ না থাকার ফলে শিক্ষকরা অনেক বিষয় নিজেরাও বোঝেন না, শিক্ষার্থীদেরও বোঝাতে ব্যর্থ হচ্ছেন। ছাত্র-ছাত্রীরা শিখন উদ্দেশ্য অর্জন করছে কি না তা যাচাই হয় ধারাবাহিক মূল্যায়নের মাধ্যমে। কিন্তু অনেক বিদ্যালয়েই এ ধারাবাহিক মূল্যায়ন রেকর্ড সংরক্ষণ করা হচ্ছে না বলে উল্লেখ করা হয় প্রতিবেদনে। সব মিলে মাউশির এই একাডেমিক সুপারভিশনের তথ্য বলছে, রংপুর অঞ্চল, চট্টগ্রাম অঞ্চল ও কুমিল্লা অঞ্চলের সুপারভিশনের হার সন্তোষজনক নয়। সব অঞ্চলের বিদ্যালয়ে কার্যকরভাবে একাডেমিক সুপারভিশনের হার বৃদ্ধির সুপারিশ করা হয়েছে প্রতিবেদনে। প্রতিবেদনের সার-সংক্ষেপে আরও বলা হয়েছে, সুপারভিশনকৃত বিদ্যালয়ের মধ্যে সীমানা প্রাচীর নেই ৪ হাজার ২৯১টি বিদ্যালয়ে। অপরিষ্কার বিদ্যালয়ের সংখ্যা ৯৮২টি। ১৫০ বিদ্যালয়ের টয়লেট ব্যবহার অযোগ্য। তিনটি বিদ্যালয়ে টয়লেট নেই। পানীয় জলের অপর্যাপ্ত ব্যবস্থা রয়েছে ১১১টিতে।

উচ্চশিক্ষা কমিশন হলো না, ক্ষমতাও বাড়ল না

এই রকম আরও টপিক

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর