বৃহস্পতিবার, ১৪ সেপ্টেম্বর, ২০২৩ ০০:০০ টা

পাট এখন কৃষকের গলার ফাঁস

♦ সোনালি আঁশে হারাচ্ছে জৌলুস ♦ পাট চাষে আগ্রহ কমছে কৃষকের ♦ গুনতে হচ্ছে লোকসান, কমছে রপ্তানি

জিন্নাতুন নূর

পাট এখন কৃষকের গলার ফাঁস

সোনালি আঁশ খ্যাত পাট এখন কৃষকের ‘গলার ফাঁসে’ পরিণত হয়েছে। পাটশিল্প ক্রমেই জৌলুস হারাচ্ছে। এ শিল্প ঘিরে বিগত বছরগুলোয় যে সম্ভাবনা তৈরি হয়েছিল তা রপ্তানিকারকদের কাছে দিন দিন ফিকে হয়ে আসছে। লোকসানের কারণে এরই মধ্যে বিভিন্ন জেলার কৃষক পাট চাষে আগ্রহ হারাচ্ছেন। বাংলাদেশ প্রতিদিনকে কৃষক জানান, পর্যাপ্ত বৃষ্টি না হওয়ায় সেচ খরচ বৃদ্ধি, উৎপাদন খরচ না ওঠা এবং উপকরণের মূল্যবৃদ্ধিসহ নানা কারণে পাট চাষের পরিমাণ এ বছর কমেছে। ভালো দাম না পেয়ে বিভিন্ন জেলার কৃষক চরম হতাশ। আশঙ্কার বিষয় হচ্ছে, আন্তর্জাতিক বাজারে পাটপণ্যের চাহিদা কমে যাওয়ায় পাটশিল্পের রপ্তানি আয়ও কমে গেছে।

পাটজাত পণ্যকে ২০২৩ সালের ‘বর্ষ পণ্য’ ঘোষণা করে সরকার। লক্ষ্য ছিল অভ্যন্তরীণ বাজার ব্যবস্থাপনার উন্নতি করে ইউরোপসহ বিভিন্ন দেশে পাটজাত পণ্যের রপ্তানি বাড়ানো। কিন্তু এ বছরই পাটের মান ও দামে অখুশি কৃষক। চলতি বছর পাটের যে মান তাতে রপ্তানিতে আরও নেতিবাচক কিছু ঘটবে বলে শঙ্কা করা হচ্ছে। পাটের সুতা ও টুইন থেকে রপ্তানি আয়ও কমেছে। পাট অধিদফতরের তথ্যে, ২০১৭-১৮ সালে মোট কাঁচা পাট উৎপাদন হয়েছিল ৯২ লাখ বেল। আর ২০২১-২২ সালে তা কমে দাঁড়িয়েছে ৭১ লাখ বেল। কাঁচা পাট রপ্তানি ২০১৭-১৮ সালে ছিল ১৪ লাখ বেল আর ২০২১-২২ সালে ৮ লাখ বেল। বর্তমানে বিভিন্ন দেশের ক্রেতা পাটের পরিবর্তে কটন ও সিল্ক দিয়ে তৈরি পণ্য কিনছেন। বহির্বিশ্বে পাটপণ্যের চাহিদা ২৫ থেকে ৩০ শতাংশ কমেছে। দামও আগের মতো নেই। বিশেষজ্ঞরা বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, বিশ্বে একসময় আমাদের পাটের বড় বাজার ছিল। ভারতসহ অন্যান্য দেশের হাতে এখন এ বাজার। পাটের বাজার ধরতে হলে দেশের প্রায় আড়াই শ বেসরকারি পাটকলকে এগিয়ে আসতে হবে। এসব পাটকল পরিকল্পনা করে যেসব দেশে পাটপণ্যের চাহিদা আছে সেখানে পণ্য রপ্তানি করতে পারে।

চাষে আগ্রহ হারাচ্ছেন কৃষক : জয়পুরহাট প্রতিনিধির দেওয়া তথ্যে, জেলার কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগ আশঙ্কা করছে, এবারও গত মৌসুমের মতো উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হবে না। পর্যাপ্ত বৃষ্টি না হওয়ায় সেচ খরচ বৃদ্ধি, উৎপাদন খরচ না ওঠা, উপকরণের মূল্যবৃদ্ধিসহ নানা কারণে জেলায় পাট চাষের পরিমাণ কমেছে। কৃষিসংশ্লিষ্টরা বলছেন, অনেক কৃষক এবার সবজি আবাদসহ অন্যান্য ফসলের দিকে ঝুঁকে পড়েছেন। সব মিলে দিন দিন পাট চাষে আগ্রহ হারাচ্ছেন জেলার কৃষক। জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর জানিয়েছে, চলতি মৌসুমে জেলায় ৩ হাজার ৫৭০ হেক্টর জমিতে পাট চাষের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিল। কিন্তু আবাদ হয়েছে ৩ হাজার ১১৮ হেক্টরে। অর্থাৎ লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ৪৫২ হেক্টর জমিতে পাটের আবাদ কম হয়েছে। জয়পুরহাট সদর উপজেলার নিজামপুর গ্রামের কৃষক সোলায়মান আলী এবার ৩৩ কাঠা অর্থাৎ ৫৫ শতক জমিতে পাট চাষ করেছেন। তিনি বলেন, ‘এ মৌসুমে পাট চাষে খরচ বেশি হয়েছে। প্রতি বছরের মতো এবার ১ বিঘা জমিতে হালচাষ, শ্রমিক মজুরি, সার-সেচসহ অন্যান্য খরচ বাবদ ১৬-১৭ হাজার টাকা খরচ হয়েছে। আর এ বছর উপযুক্ত আবহাওয়া তুলনামূলক কম থাকায় চাষ ভালো হয়নি। তা ছাড়া পাটের বাজারদরও কম। কিছু পাট ১ হাজার ৬০০ টাকা দরে বিক্রি করেছি। এ দরে বিক্রি করে পাট চাষ করা যাবে না। কারণ প্রতি বিঘায় এবার ৮ থেকে ৯ মণ পাট হবে। এর দাম আসবে ১৫-১৬ হাজার টাকা। এতে এক থেকে দেড় হাজার টাকা লোকসান গুনতে হবে।’ পাট ব্যবসায়ী জাহাঙ্গীর আলম বলেন, ‘গতবারের তুলনায় এবার পাটের বাজারদর অনেক কম। এর কারণ মিলারদের পাটে চাহিদা না থাকা। তারা কিনতে চাচ্ছেন না। সুতার চাহিদা ও দাম ভালো পেলে পাট কিনতে আগ্রহ দেখান। এখন যেসব পাট কেনা হচ্ছে সব স্টকে থাকছে। কারখানায় খুবই কম পাট যাচ্ছে।’ পাট অধিদফতরের জেলা কার্যালয়ের মুখ্য পরিদর্শক আবদুল হালিম বলেন, গত বছর অনেক পাট ব্যবসায়ী পাট কেনার পর মজুদ করেছেন। এ বছর পাটের দাম কম তাই ব্যবসায়ীরা পাট কম কিনছেন।

দাম নিয়ে দুশ্চিন্তায় কৃষক : পাট উৎপাদনে ফরিদপুর জেলা বরাবরের মতো এবারও শীর্ষ অবস্থানে রয়েছে। তবে এ বছর প্রকৃতির বিরূপ আচরণে অনেকটাই ফিকে হয় গেছে কৃষকের মুখের হাসি। মৌসুমের শুরুতেই অতিবৃষ্টির কারণে একদিকে যেমন পাট চাষে বিঘ্ন ঘটেছে, অন্যদিকে পাটের আঁশ ছাড়ানো মৌসুমেও পানির অভাবে সময়মতো পাট জাগ দিতে না পারায় কাক্সিক্ষত ফলন ব্যাহত হচ্ছে। অল্প পানিতে পাট জাগ দেওয়ার কারণে পাটের রং নষ্ট হয়ে যাওয়ায় বাজারে পাটের দামও কম পাওয়া যাচ্ছে। তীব্র দাবদাহে শ্রমিক সংকটে শ্রমিকের মজুরিও বৃদ্ধি পেয়েছে। বর্তমানে একজন শ্রমিককে দুই বেলা খাবার দিয়ে ৭০০ থেকে ৮০০ টাকা দৈনিক মজুরি দিতে হচ্ছে। এ ছাড়া সার, সেচ, কীটনাশকের দাম বৃদ্ধি পাওয়ায় পটের উৎপাদন খরচ বেড়েছে কয়েক গুণ। কিন্তু সে অনুপাতে পাটের দাম পাচ্ছেন না কৃষক। এ বছর প্রতি মন ভালো মানের পাট বিক্রি হচ্ছে ২ হাজার ৭০০ থেকে ২ হাজার ৮০০ টাকা দরে। যেখানে এ পাট গত বছরের শুরুতেই কৃষক বিক্রি করেছিলেন ৩ হাজার ৪০০ টাকা করে। আর একটু নিম্নমানের রং নষ্ট হওয়া পাটের গত বছর যেখানে দাম ছিল ২ হাজার ২০০ থেকে ২ হাজার ৭০০ টাকা; সেই পাট এ বছর কৃষক বিক্রি করছেন ১ হাজার ৮০০ থেকে ২ হাজার টাকা মন। ফরিদপুরের সবচেয়ে বড় পাটের মোকাম কানাইপুর সাপ্তাহিক হাটে গিয়ে দেখা যায় কৃষক পাট নিয়ে এলেও ব্যবসায়ীরা পাট কিনতে তেমন আগ্রহ দেখাচ্ছেন না। যার কারণে অভাবের তাড়নায় কম দামে পাট বিক্রি করে যাচ্ছেন কৃষক।

পাট কৃষকের গলার ফাঁস : দেশের অন্যতম পাট উৎপাদনকারী জেলা পাবনায় ভালো ফলনের পরও দাম কম থাকায় দুশ্চিন্তায় কৃষক। সরকারি ও বেসরকারি পাটকলগুলো বন্ধ হয়ে যাওয়ায় সঠিক দাম পাওয়া নিয়ে দুশ্চিন্তা ও হতাশায় পড়েছেন তারা। পাবনা সদরের ইসলামপুর গ্রামের কৃষক আবদুল আওয়াল বলেন, ‘এই যে পচা পানিতে সারা দিন পাট জাগ দেওয়া থেকে ধোয়ার কাজ করছি, এ শ্রমই বৃথা। কেবল খরচই হয়তো এ থেকে উঠবে। যারা পাটের সব কাজই লেবার নিয়ে করাচ্ছেন তাদের বরং লোকসান হবে।’ পাবনা সদরের গয়েশপুর গ্রামের আবদুল বারী জানান, গত বছর মনপ্রতি ২ হাজার ৫০০ থেকে ৩ হাজার টাকায় কৃষক পাট বিক্রি করলেও বর্তমানে এক থেকে দেড় হাজার টাকা কমে ২ হাজারের নিচে নেমে এসেছে। একসময়ের সোনালি আঁশ এখন কৃষকের গলার ফাঁসে পরিণত হয়েছে।

কমছে রপ্তানি আয় : ২০২০-২১ অর্থবছরে আগের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে ১১৬ কোটি ১৫ লাখ (১ দশমিক ১৬ বিলিয়ন) ডলারের পাট ও পাটজাত পণ্য রপ্তানি করে পণ্য রপ্তানি তালিকায় চামড়াকে পেছনে ফেলে দ্বিতীয় স্থানে উঠে আসে এ খাত। এর আগে ২০১৯-২০ অর্থবছরের চেয়ে পাটের রপ্তানি বেড়েছিল ৩১ দশমিক ৬৩ শতাংশ। এমনটি দেখে ২০২১-২২ অর্থবছরে পাট খাত থেকে রপ্তানি আয়ের লক্ষ্য বাড়িয়ে ধরা হয়েছিল ১৪২ কোটি ডলার। কিন্তু বছর না ঘুরতেই এক ধাক্কায় পঞ্চম স্থানে নেমে এসেছে পাট খাত। ২০২১-২২ অর্থবছরে এ খাত থেকে ১১২ কোটি ৭৬ লাখ ডলারের বিদেশি মুদ্রা দেশে আসে। লক্ষ্যের চেয়ে আয় কমে যায় ২০ দশমিক ৬০ শতাংশ। চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরে অবস্থা আরও খারাপ। এ অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে (জুলাই-ডিসেম্বর) ৪৮ কোটি ৫৯ লাখ ডলারের পাট ও পাটজাত পণ্য রপ্তানি করেছেন রপ্তানিকারকরা; যা গত অর্থবছরের এই সময়ের চেয়ে ১৭ দশমিক ৬৫ শতাংশ কম। আর লক্ষ্যের চেয়ে ১৯ শতাংশের বেশি কম। এ সময় কাঁচা পাট রপ্তানি কমেছে প্রায় ১১ শতাংশ। পাট ও পাটসুতা দিয়ে হাতে তৈরি বিভিন্ন পণ্য রপ্তানি করে আয় হয়েছে ১০ কোটি ৯৩ লাখ ৪০ হাজার ডলার। এতে প্রবৃদ্ধি কমেছে ১৩ দশমিক ৩৪ শতাংশ। পাটকল মালিক ও রপ্তানিকারকরা বলছেন, আন্তর্জাতিক বাজারে পাটপণ্যের চাহিদা কমে গেছে। বেড়ে গেছে পলি ফাইবারের চাহিদা। এজন্য পাটপণ্যের দাম ২৫ থেকে ৩০ শতাংশ কমে গেছে। ফলে রপ্তানিতেও ধস নেমেছে। বিশ্ববাজারে পাটপণ্যের চাহিদা না বাড়লে দামও বাড়বে না বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।

পাটকল নিয়েও শঙ্কা : সরকার ২০২০ সালের ২ জুলাই দেশের ২৬টি রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকল বন্ধ করে দেয়। কল বন্ধের দুই মাসের মধ্যে কারখানা শ্রমিকসহ অন্যদের সব পাওনা পরিশোধের অঙ্গীকার করলেও এখনো অনেক শ্রমিক এরিয়ারসহ তাদের বকেয়া পাওনা বুঝে পাননি। বাংলাদেশ জুট মিলস করপোরেশনের (বিজেএমসি) মহাব্যবস্থাপক (প্রশাসন ও সা. সেবা) মো. নাসিমুল ইসলাম বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘আমাদের মিলগুলো এখন বন্ধ আছে। এগুলো আমরা বেসরকারি খাতে দিয়ে দিচ্ছি। আমাদের নিয়ন্ত্রণে থাকা ২৫টি পাটকলের সবকটিতে এখন উৎপাদন বন্ধ। ২৫টি পাটকলের মধ্যে আমরা ১৯টি লিজে দেওয়ার কার্যক্রম গ্রহণ করেছি। যার ১৬টি লিজের পর্যায়ে চলে গেছে। তিনটি লিজ প্রক্রিয়ায় আবার চালু করব। আর বাকি পাঁচটি পাটকলের ব্যাপারে কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। আমাদের বন্ধ হয়ে যাওয়া পাটকলগুলোর শ্রমিকদের পাওনা মোটামুটি পরিশোধ করা হয়েছে। কিছু মিলে মামলাসংক্রান্ত জটিলতা আছে।’ দেশের পাট ও পাটজাত পণ্যের মোট রপ্তানির ২০ শতাংশের মতো হয় বিশ্বের অন্যতম বড় জুট মিল আকিজ জুট মিলস থেকে। কিন্তু কারখানাটিতে কয়েক মাস ধরে অস্থিরতা চলছে। বিদেশি ক্রয়াদেশ না থাকা এবং উৎপাদন খরচ বৃদ্ধির কারণে উৎপাদন কমিয়ে দেওয়া হয়েছে।

(প্রতিবেদনটি তৈরিতে সহায়তা করেছেন পাবনা প্রতিনিধি সৈকত আফরোজ আসাদ, জয়পুরহাট প্রতিনিধি মো. শামীম কাদির ও ফরিদপুর প্রতিনিধি কামরুজ্জামান সোহেল)

এই রকম আরও টপিক

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর