শুক্রবার, ১৫ সেপ্টেম্বর, ২০২৩ ০০:০০ টা

ফের সরগরম আন্ডারওয়ার্ল্ড

সক্রিয় কিশোর গ্যাং সদস্যরা, রাজধানীতে ৫২টির মধ্যে তৎপর ৩০টি

সাখাওয়াত কাওসার

ফের সরগরম আন্ডারওয়ার্ল্ড

আবারও মাথা চাড়া দিয়ে উঠছে রাজধানীর অপরাধ জগৎ। জাতীয় নির্বাচনের আগে আন্ডারওয়ার্ল্ডের পলাতক এবং কারাবন্দি শীর্ষ সন্ত্রাসীরা তাদের অবস্থান শক্তিশালী করতে তৎপর। নিজেদের অপরাধ সাম্রাজ্য ধরে রাখতে ঝুঁকছেন কিশোর গ্যাংয়ের দিকে। তাদের বিশ্বস্ত ক্যাডারদের শূন্যস্থান পূরণে কিশোর গ্যাং লিডারদের টানতে সব ধরনের চাহিদা পূরণ করে যাচ্ছে। এই প্রেক্ষাপটে শীর্ষ সন্ত্রাসীদের আনুকূল্য পেয়ে রীতিমতো বেপরোয়া হয়ে উঠছে সমাজের বখে যাওয়া কিশোররা। রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় একের পর এক রোমহর্ষক খুনখারাবির ঘটনায় কিশোর গ্যাংয়ে জড়িত থাকার বিষয়টি ভাবিয়ে তুলেছে সংশ্লিষ্টদের। গোয়েন্দারা কেবল রাজধানীতেই ৫২টি কিশোর গ্যাংয়ের অস্তিত্ব পেয়েছেন। এর মধ্যে সক্রিয় রয়েছে অন্তত : ৩০টি গ্রুপ।

এদিকে, কিশোর গ্যাংয়ের লাগাম টেনে ধরতে না পারার সমালোচনা করেছেন অপরাধ বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন- বখে যাওয়া কিশোরদের পরিবারের স্ট্যাটাস জানার পর আইন প্রয়োগকারী সংস্থার কর্মকর্তাদের অনেকে পিছু হটেন। এ কারণে এসব কিশোরই নানা অপরাধে জড়িয়ে ফেলছেন শীর্ষ সন্ত্রাসীরা। বয়সে কিশোর হওয়ার সুবাদে কঠোর শাস্তির আওতায় আনা যাচ্ছে না। আইনের ফাঁকফোকর থাকায় এর সুযোগ নিচ্ছে এসব গ্যাংয়ের লিডার এবং সদস্যরা। অনেক বড় বড় অপরাধ ঘটিয়েও বয়সের কারণে সহজেই জামিনে বের হওয়ার সুযোগ পাচ্ছে। যার ফলে জামিনে বেরিয়ে এসে এরা আবারও জড়িয়ে পড়ছে অপরাধে। তবে অভিভাবকদের উচিত তাদের সন্তানদের বিষয়ে আরও সচেতন হওয়া। একই সঙ্গে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সদস্যদের আরও কঠোর হওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন তারা।

সূত্র জানায়, ২০১৭ সালে ট্রাস্ট স্কুল অ্যান্ড কলেজের নবম শ্রেণির ছাত্র আদনান কবীর খুনের পর থেকেই কিশোর গ্যাংয়ের বিষয়টি আইন প্রয়োগকারী সংস্থার নজরে আসে। পরবর্তীতে লাগাতার অভিযানে ঢাকায় গজিয়ে ওঠা অর্ধশতাধিক কিশোর গ্যাংয়ের অন্তত ৫০০ সদস্যকে গ্রেফতার করে র‌্যাব-পুলিশ। মাঝে কিছুটা নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়লেও বর্তমানে এসব গ্যাংয়ের সদস্যরা আবারও মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছে। সম্প্রতি রাজধানীর মোহাম্মদপুরে তুষার আরমান নামের এক যুবকের কবজি কেটে ভিডিও ধারণ করে টিকটকে ছড়িয়ে দেয় কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা। র‌্যাব জানিয়েছে, এর আগেও এই গ্যাংয়ের সদস্যরা বিভিন্ন সময়ে এলাকায় আধিপত্য বিস্তার, চাঁদাবাজি, ছিনতাইয়ের উদ্দেশ্যে একই কায়দায় হামলা চালিয়ে শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ বিচ্ছিন্ন করেছে। এর আগে গত ডিসেম্বরে রাত সাড়ে আটটার দিকে রাজধানীর মোহাম্মদপুর চাঁদ উদ্যান এলাকায় মহিউদ্দিন মাহিন নামের এক যুবককে কোপায় কিশোর গ্যাংয়ের ১০-১২ জন সদস্য। হামলা থেকে বাঁচতে পাশের একটি ফ্ল্যাক্সিলোডের দোকানে ঢুকেও রক্ষা পাননি তিনি।

গোয়েন্দারা বলছেন, এই গ্যাংয়ের পৃষ্ঠপোষকতায় রয়েছেন পলাতক শীর্ষ সন্ত্রাসী নবী হোসেন। নবী হোসেনের সেকেন্ড ইন কমান্ড মনোয়ার হোসেন জীবন ওরফে লেদু হাসানের পৃষ্ঠপোষকতায় কিশোর গ্যাং গ্রুপগুলোর দেখভাল করেন শুক্কুর আলামিন এবং নূর মোহাম্মদ মোল্লা। তাদেরই পৃষ্ঠপোষকতায় আরেকটি শক্তিশালী কিশোর গ্যাংয়ের নেতৃত্ব দিচ্ছেন রনি আহমেদ। এ ছাড়া স্থানীয় এক কাউন্সিলরের পৃষ্ঠপোষকতায় রয়েছে ‘বাদল গ্যাং’।

এদিকে, গত ২২ মে রাজধানীর দারুসসালাম থানার লালকুঠি এলাকার বসুপাড়ায় স্কুলছাত্র সিয়াম খানকে প্রকাশ্যে কুপিয়ে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা। তদন্তে উঠে এসেছে, এই হত্যাকাণ্ডের পেছনে ছিল এলাকাভিত্তিক অপরাধীচক্রের তৎপরতা।

র‌্যাবের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (অপস্) কর্নেল মাহবুব আলম বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, কিশোর গ্যাং নিয়ে র‌্যাব শুরু থেকেই সিরিয়াস। এখনো এ বিষয়টিকে যথেষ্ট গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। শীর্ষ সন্ত্রাসীদের নাম ব্যবহার করে অনেক কিশোর গ্যাং তৎপরতা চালাচ্ছে এমন খবর পাচ্ছি। তবে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখার স্বার্থে প্রয়োজনীয় সবকিছুই করবে র‌্যাব।

জানা গেছে, সম্প্রতি রাজধানীর গুলশান-১ এর গুলশান শপিং কমপ্লেক্স ঘিরে ব্যবসায়ী ও মালিকপক্ষের দ্বন্দ্বে ব্যবহৃত হচ্ছেন পলাতক শীর্ষ সন্ত্রাসী ও আওয়ামী লীগ নেতা মিল্কী হত্যা মামলার অন্যতম আসামি সাখাওয়াত হোসেন চঞ্চল। তার সেকেন্ড ইন কমান্ড দুলাল ও অন্যতম সহযোগী কানি সোহেল কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যদের নিয়ে ওই এলাকায় মহড়া দিতে দেখা যায়। সম্প্রতি পুলিশের উপস্থিতিতেও অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেছে। গোয়েন্দারা বলছেন, চঞ্চলের পৃষ্ঠপোষকতায় গুলশান ও বাড্ডায় সক্রিয় রয়েছে অন্তত তিনটি কিশোর গ্যাং। তাদের সমন্বয় করছেন কানি সোহেল, মান্নান, মানিক, মোরসালিন বাবু ও গোদারিঘাটের সাইদ। তিতুমীর কলেজের ছাত্রদের দেখভাল করেন লালন ও মফিজ। সূত্র আরও বলছে, পলাতক শীর্ষ সন্ত্রাসী তানভীরুল ইসলাম জয় দীর্ঘদিন অন্তরালে থাকলেও বর্তমানে সক্রিয় হওয়ার চেষ্টা করছেন। তারও নজর কিশোর গ্যাংয়ের দিকে। বিষয়টির সমন্বয় করছেন, মালয়েশিয়ায় অবস্থানরত মগবাজারের রবিন, বাড্ডার মাহবুব এবং ডালিম।

জানা গেছে, কিশোর গ্যাংয়ের তৎপরতার পেছনে পলাতক এবং কারাবন্দি শীর্ষ সন্ত্রাসী হলেও স্থানীয় রাজনৈতিক দলের ছত্রছায়ায় তারা অপরাধ কর্মকাণ্ড চালিয়ে যাচ্ছে। গ্যাংয়ের সদস্যদের মধ্যে রয়েছে মহল্লা-বস্তির ছিঁচকে সন্ত্রাসী থেকে ধনাঢ্য পরিবারের দুলালরা। বেশ কিছু গ্যাং সদস্যের কাছে এরই মধ্যে পৌঁছে গেছে দেশি-বিদেশি অস্ত্র। মাঝেমধ্যেই গ্যাংয়ের সদস্যরা নিজেদের ক্ষমতা দেখাতে অন্য এলাকাতে গিয়েও মহড়া দিচ্ছে বলে খবর রয়েছে গোয়েন্দাদের কাছে।

ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) সূত্র বলছে, খোদ রাজধানীতেই ৫২টি সক্রিয় ‘কিশোর গ্যাং’ রয়েছে। যাদের মোট সদস্য সংখ্যা প্রায় ৭০০। এসব গ্যাংয়ের একটি তালিকা তৈরি করেছে ডিএমপি। তালিকা বিশ্লেষণে দেখা যায়, ডিএমপির আটটি অপরাধ বিভাগের মধ্যে সবচেয়ে বেশি কিশোর গ্যাং মিরপুর বিভাগে। এই বিভাগে ১৩টি কিশোর গ্যাংয়ে ১৭২ জন সক্রিয় সদস্য রয়েছে। এ ছাড়া উত্তরা বিভাগে ছয়টি, গুলশানে সাতটি, তেজগাঁওয়ে সাতটি, রমনায় সাতটি, মতিঝিলে চারটি, লালবাগে দুটি ও ওয়ারী বিভাগে ছয়টি সক্রিয় কিশোর গ্যাং রয়েছে।

পুলিশ সদর দফতরের উপমহাপরিদর্শক (অপারেশনস) আনোয়ার হোসেন বলেন, কিশোর গ্যাং নিয়ে কাজ করতে পুলিশ সদর দফতর থেকে বিশেষ নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। ইতোমধ্যে তারা কাজও শুরু করেছেন। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, শীর্ষ সন্ত্রাসীরা কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যদের ব্যবহার করার চেষ্টা করছে এমন খবরও এসেছে। তবে আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই। পুলিশ বিষয়টি শক্তভাবে মোকাবিলা করবে। একাধিক সূত্র বলছে, বর্তমানে পর্তুগালে থাকা ভাসানটেকের শীর্ষ সন্ত্রাসী ইব্রাহীমের সিনিয়র ক্যাডার মামা সেলিম, মনির হোসেন বাচ্চু, মিজান, সাগর ও দুলালের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ করছেন অন্তত চারটি কিশোর গ্যাং। এদের মাধ্যমেই নিয়ন্ত্রণ করছেন মাদক সিন্ডিকেট। ইব্রাহীমের সঙ্গে রয়েছেন, পল্লবী ‘ঢ’ ব্লকের মামুন। বর্তমানে মালয়েশিয়ায় অবস্থান করা মামুন তার ভারতে পালিয়ে থাকা বড় ভাই জামিল ওরফে জামিলুর এবং মশিউর রহমান মশুর মাধ্যমে অস্ত্রের ব্যবসা করছেন। পিছিয়ে নেই কারাবন্দী শীর্ষ সন্ত্রাসী কিলার আব্বাস ও। তার ঘনিষ্ঠ সহযোগী হাবিবুর রহমান রাব্বি, রূপক ও হাফিজের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ করছেন অন্তত তিনটি কিশোর গ্যাং। তাদের মাধ্যমেই নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে রূপসী পল্লী, রাকীন সিটি ও নাভানা এলাকার ডিশ-ইন্টারনেট ব্যবসা।

এ ছাড়া, দুবাইয়ে পলাতক শীর্ষ সন্ত্রাসী জিসান আহমেদ বাড্ডা, রামপুরা ও খিলগাঁও এলাকায় অন্তত সাতটি কিশোর গ্যাং নিয়ন্ত্রণ করছেন। তার এক সময়ের সহযোগী বাড্ডার কান্নি সোহেল বর্তমানে পলাতক ভয়ঙ্কর অপরাধী বাড্ডার চঞ্চলের হয়ে কিশোর গ্যাং গোছাচ্ছেন। তাকে সহায়তা করছেন ভাগ্নে তুষার।

গোপীবাগের ইতালি প্রবাসী নাসির কিছুদিন আগে দেশে ফিরে যুবলীগের শীর্ষ নেতৃত্বের সঙ্গে কয়েক দফা মিটিং করে এলাকায় নিজের অবস্থানের জানান দিয়েছেন। টানিয়েছেন বিশালাকৃতির বিলবোর্ড। তার হয়ে কিশোর গ্যাংয়ের দেখভাল করছেন ফুয়াদ ফয়সল জন। ধানমন্ডি, হাজারীবাগ এলাকায় কারাবন্দি সানজিদুল ইসলাম ইমন ওরফে ক্যাপ্টেন ইমনের হয়ে কিশোর গ্যাংয়ের দেখভাল করছেন ইসমাইল হোসেন তপু। মতিঝিল এলাকায় ইকতিয়ার আহমেদের হয়ে কিশোর গ্যাং গোছাচ্ছেন হাসান মাহমুদুল হাসান ও রায়হানুর রহমান। খিলগাঁও এলাকায় নিজেদের আধিপত্য ধরে রাখতে পলাতক শীর্ষ সন্ত্রাসী প্রকাশ ও বিকাশ দায়িত্ব দিয়ে রেখেছেন বোঁচা সাইফুলকে। এ ছাড়া স্থানীয় রাজনৈতিক প্রভাবশালীদের পৃষ্ঠপোষকতায় ধলপুর, সায়েদাবাদ, গোলাপবাগ এলাকায় ভয়ঙ্কর হয়ে উঠছে সজীব আহমেদ নামের এক কিশোর গ্যাং লিডার। ওই এলাকার পরিবহন চাঁদাবাজি, জমি দখলের কাজ করাচ্ছেন সজীব গ্যাং সদস্যদের ব্যবহার করে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, কিশোর হওয়ার কারণে দণ্ডবিধিতে পুলিশ এদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নিতে পারে না। ১৮ বছরের কম বয়সী কেউ অপরাধ করলে তাকে দণ্ডবিধিতে কোনো বিচারকার্য সম্পাদন করা যাবে না। তাদের আটক করে শিশু-কিশোর সংশোধনাগারে পাঠাতে হয়। অথচ ঢাকার শিশু আদালতের বিচারিক কার্যক্রমের নথি অনুযায়ী গত ১৭ বছরে রাজধানীতে কিশোর গ্যাং কালচার ও সিনিয়র-জুনিয়র দ্বন্দ্বে ৯২টি খুনের ঘটনা ঘটেছে। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক নূর মোহাম্মদ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, পরিবারে ধর্মীয়ও এবং সামাজিক মূল্যবোধ বজায় রাখার অনুশীলনের অভ্যাস গড়ে তোলা জরুরি। এক্ষেত্রে পরিবার এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের এগিয়ে আসতে হবে। একই সঙ্গে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সদস্যদের আইনের সঠিক প্রয়োগ এক্ষেত্রে বড় ভূমিকা রাখতে পারে। নইলে চরম মূল্য দিতে হবে দেশকেই।

সর্বশেষ খবর