সারা দেশে বিদ্যুৎতাড়িত বা বিদ্যুৎস্পৃষ্টজনিত দুর্ঘটনায় ক্ষয়ক্ষতি ও মানুষের মৃত্যুঝুঁকি বাড়ছে। সাধারণত বৈদ্যুতিক শর্ট সার্কিট থেকে সৃষ্ট অগ্নিকাণ্ড বা বৈদ্যুতিক তারের সংস্পর্শে এসে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে এই দুর্ঘটনাগুলো ঘটছে। ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদফতরের তথ্যে, দেশে প্রতি বছর ২১ হাজারেরও বেশি অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। এসব অগ্নিকাণ্ডের প্রায় ৪০ শতাংশই বৈদ্যুতিক শর্ট সার্কিটের কারণে ঘটে। ২০২২ সালে মোট দুর্ঘটনার শতকরা প্রায় ৩৮ দশমিক ৪৮ শতাংশই বৈদ্যুতিক
গোলযোগের কারণে ঘটেছে। সংশ্লিষ্টরা আরও জানান, দগ্ধ হয়ে প্রাণহানির প্রায় অর্ধেকই বৈদ্যুতিক কারণে সৃষ্ট দুর্ঘটনায় ঘটে। রাজধানীর বড় বড় মার্কেট ও বস্তিগুলোতেও সৃষ্ট অগ্নিকাণ্ডের জন্য বিভিন্ন সময়ে গঠিত তদন্ত কমিটি বৈদ্যুতিক গোলযোগকে দায়ী করেছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এ ধরনের দুর্ঘটনায় শুধু মানুষের মৃত্যুই ঘটছে না, বৈদ্যুতিক দুর্ঘটনার শিকার ব্যক্তির অঙ্গহানির পাশাপাশি ক্ষতি হচ্ছে বিপুল অর্থ-সম্পদেরও। এ জন্য দুর্ঘটনা রোধে বিল্ডিং কোড মেনে ভবন নির্মাণ এবং শীতাতপ যন্ত্রসহ (এসি) অন্যান্য বৈদ্যুতিক যন্ত্রপাতির নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণ করার ওপর তারা জোর দেন। ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদফতরের তথ্যে, ২০২২ সালে দেশে বৈদ্যুতিক গোলযোগ থেকে মোট ৯ হাজার ২৭৫টি অগ্নিকাণ্ড ঘটে। এতে মোট ১৩৩ কোটি ৬৭ লাখ ৪৮ হজার ৪৯৭ টাকার আর্থিক ক্ষতি হয়। বৈদ্যুতিক গোলযোগ থেকে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনাগুলো সাধারণত অফিস, মার্কেট ও ঘনবসতিপূর্ণ এলাকাতে বেশি ঘটে। আর বাসাবাড়ি ও কর্মস্থলে বৈদ্যুতিক যন্ত্রপাতি ব্যবহারে অসাবধানতা, বিদ্যুতের ওভারলোডিং, শর্ট সার্কিট এবং অসচেতনতা এ ধরনের দুর্ঘটনার পেছনে অন্যতম কারণ। ২০০৩ সালের অগ্নিনির্বাপণ আইন অনুযায়ী- ছয়তলার ওপর কোনো ভবন অথবা কোনো শিল্প-কারখানা, বাণিজ্যিক কারখানা, অফিস নির্মাণ করতে হলে এর অগ্নি সুরক্ষা ব্যবস্থা করতে হবে। দেশে যেহেতু ২০০৩-এর আগে এ সংশ্লিষ্ট কোনো আইন ছিল না এ জন্য কেউ ভবন নির্মাণের সময় ফায়ার সেফটি মানেননি। অর্থাৎ ২০০৩-এর আগে যে বহুতল ভবন নির্মাণ করা হয়েছিল সেগুলো ফায়ার সেফটি ছাড়াই নির্মাণ করা হয়। আবার বাংলাদেশ ন্যাশনাল বিল্ডিং কোড-এ অগ্নি সুরক্ষার বিষয়ে বিস্তারিত দেওয়া আছে। আর এটিও তৈরি হয় ২০০৬ সালে। অর্থাৎ ব্রিটিশ আমলের পর থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত পুরান ঢাকা ও নতুন ঢাকার ভবনগুলো অগ্নি সুরক্ষা ব্যবস্থা মেনে তৈরি করা হয়নি। বিশেষজ্ঞরা বলেন, গ্রাহকরা অনেক সময় যে সকেট, মাল্টিপ্লাগ ও এসি ব্যবহার করছেন সেগুলো তারা কম দামে কেনেন। নিম্নমানের এই পণ্য ব্যবহারের জন্য শর্ট সার্কিট, এসি বিস্ফোরণের মতো দুর্ঘটনা প্রায়ই ঘটছে। এখন নতুন নতুন শিল্পকারখানা তৈরি করা হচ্ছে আর সেখানে নতুন প্রযুক্তি ব্যবহার হচ্ছে যা কি না বিদ্যুতের মাধ্যমে পরিচালিত হয়। সেখানেও এ ধরনের দুর্ঘটনাগুলোর ঝুঁকি তৈরি হবে। এ ছাড়া বৈদ্যুতিক ছেঁড়া তার থেকে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়েও বিভিন্ন সময় দুর্ঘটনার ঘটনা ঘটছে। ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদফতরের পরিচালক (অপারেশন ও মেইনটেন্যান্স) লেফটেন্যান্ট কর্নেল মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম চৌধুরী বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ঢাকাসহ সারা দেশে বৈদ্যুতিক গোলযোগ থেকে দুর্ঘটনার ঝুঁকি ক্রমেই বৃদ্ধি পাচ্ছে। সধারণত ফায়ার সেফটি প্ল্যান বাস্তবায়ন না করলে বিদ্যুৎ অফিস থেকে কোনো সংযোগ দেওয়ার কথা না। কিন্তু বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই ব্যবহারকারীরা ফায়ার সেফটি প্ল্যান ছাড়াই বিদ্যুৎ সংযোগ নিচ্ছেন। মুন্সীগঞ্জের গজারিয়ায় বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে গত সেপ্টেম্বরে দুই শ্রমিকের মৃত্যু হয়। উপজেলার হোসেন্দি ভবানীপুর এলাকায় এ ঘটনা ঘটে। বেলাল হোসেন ও আবদুর রহিম মিয়া নামের দুই শ্রমিক নদীর ঘাটে গোসলে নামেন। তখন ঘাটে বৈদ্যুতিক পাম্পের মাধ্যমে পানি তোলা হচ্ছিল। এক পর্যায়ে পাম্পের বিদ্যুৎ সংযোগের তার ছিঁড়ে পানিতে পড়লে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে দুই শ্রমিকের মৃত্যু হয়। ৩০ আগস্ট রাজবাড়ীর পাংশায় বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে মো. রাফি শেখ নামে চতুর্থ শ্রেণির এক শিক্ষার্থীর মৃত্যু হয়। রাফির পরিবারের সদস্যরা জানান, মোবাইল চার্জে লাগানোর সময় বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে তার মৃত্যু হয়। এ ছাড়া জুলাই মাসের শেষে মুন্সীগঞ্জের লৌহজং উপজেলায় বৈদ্যুতিক শর্ট সার্কিট থেকে ঘরে আগুন লেগে দেবর-ভাবির মৃত্যু হয়। উপজেলার বৌলতলী ইউনিয়নের কাজিপাড়া গ্রামে এ ঘটনা ঘটে। ফায়ার সার্ভিস কর্তৃপক্ষ বলছে, গতকাল রাজধানীর মোহাম্মদপুর কৃষি মার্কেটে যে আগুন লেগেছে তা শর্ট সার্কিট থেকে লেগেছে কি না সেটি খতিয়ে দেখা হচ্ছে। ঝুঁকিপূর্ণ মার্কেটটিতে অতিরিক্ত ভোল্টেজের বিদ্যুৎ ব্যবহার করা হচ্ছিল। অতিরিক্ত বিদ্যুতের কারণে তার লোড না নেওয়ার বৈদ্যুতিক শর্ট সার্কিটের সৃষ্টি হয়েছে কি না তা খতিয়ে দেখা হবে। শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের জাতীয় সমন্বয়ক সামন্ত লাল সেন বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, সাধারণ পোড়া রোগীর তুলনায় বৈদ্যুতিক কারণে সৃষ্ট অগ্নিকাণ্ড বা বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে পোড়া রোগীর ক্ষত অনেক বেশি।