রবিবার, ১৭ সেপ্টেম্বর, ২০২৩ ০০:০০ টা

চুরিতে অংশ নেয় পুরুষরা আড়ালে নেতৃত্বে নারী

আলী আজম

চুরিতে অংশ নেয় পুরুষরা আড়ালে নেতৃত্বে নারী

আবদুর রশিদ ভুইয়া একজন চাকরিজীবী। গ্রামের বাড়ি কুমিল্লা হলেও থাকেন ঢাকার পল্লবীতে। ঈদের ছুটিতে তিনি পরিবার নিয়ে গ্রামের বাড়িতে যান। এ সময় তার বড় সন্তান বাসায় ছিলেন। সেও ঈদের ছুটিতে বন্ধুদের সঙ্গে রাঙামাটি ঘুরতে যান। তখন ফাঁকা বাসায় ঝুলছিল তালা। এই সুযোগটি কাজে লাগায় একটি চোর চক্র। এই চক্রটি দিনদুপুরে চুরি করত। তারা একত্রিত হয়ে ওই বাসায় চুরি করে। লুট করে নেয় ১৭ লাখ ১ হাজার ৭০০ টাকার সোনা এবং নগদ ১৮ লাখ টাকা। এ ঘটনায় পল্লবী থানায় মামলা হয়। ওই মামলার তদন্তে আন্তজেলা চোর চক্রের সন্ধান পায় ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) মিরপুর বিভাগ। একে একে গ্রেফতার করা হয় চক্রের সাত সদস্যকে। তাদের জিজ্ঞাসাবাদে বেরিয়ে আসে চোর চক্রের আদ্যোপান্ত। তদন্ত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, গ্রেফতাররা পেশাদার চোর চক্রের সদস্য। চুরি করাই তাদের একমাত্র পেশা এবং নেশা। চুরি করেই তারা জীবিকা নির্বাহ করে। তারা আন্তজেলা চোর চক্রের সক্রিয় সদস্য। তারা বিভিন্ন জেলায় বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে তালা ঝুলানো ফাঁকা বাসা শনাক্ত করে। চক্রটি দিনদুপুরে চুরি করত। ফাঁকা বাসা পেলেই চক্রের সদস্যরা ফোনে বলত, ‘অফিস পাইছি’। এরপর তারা দ্রুত একত্রিত হয়ে বাসায় বিভিন্ন স্থানে অবস্থান নিত। এরপর চুরি শেষ করে তারা যে যার মতো করে কেটে পড়ত। তারা বিভিন্ন জেলায় চুরি করেছে এবং ধরাও পড়েছে। পরে জেল থেকে বেরিয়ে আবারও চুরিতে সক্রিয় হয়েছে। এই চক্রের সাত সদস্যকে গ্রেফতার করা হলেও চক্রের সঙ্গে মোট ৩২ জনের জড়িত থাকার তথ্য পাওয়া গেছে।

চক্রটি ৪-৫ জনের গ্রুপ করে ভাগ হয়ে চুরি করত। এক জেলায় চুরি করে দ্রুত আরেক জেলায় চলে যেত। ফলে চক্রের সদস্যদের ধরা দুষ্কর হয়ে পড়ত। চক্রটি ইতোমধ্যে ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, ফরিদপুর, মাদারীপুর, ময়মনসিংহ, টাঙ্গাইলসহ বিভিন্ন জেলায় চুরি করেছে। তাদের নামে বিভিন্ন জেলায় একাধিক মামলা রয়েছে। এই চক্রের পরিচালনাকারী হিসেবে ইয়াসমিন নামে এক নারীর তথ্য পাওয়া গেছে। ওই নারী এই চোর চক্রের পৃষ্ঠপোষক। তিনি চোর চক্রের কোনো সদস্য বিপদে পড়লে বা জেলে গেলে ছাড়িয়ে আনতেন। চোর চক্রের কাছে তিনি ইয়াসমিন খালা নামে পরিচিত। চুরি করা সব মালামাল এই খালার কাছেই রাখা হতো। আন্তজেলা চোর চক্রের এই গ্রুপটি ৬-৭ বছর ধরে সক্রিয়।

জানা গেছে, ঢাকার পল্লবী থানার সেকশন-৬, ব্লক-ডি, রোড-২, বাসা-১৭ নম্বরে থাকতেন আবদুর রশিদ। তার গ্রামের বাড়ি কুমিল্লার চৌদ্দগ্রাম থানার ছাতিয়ানিতে। চলতি বছরের ১৩ জানুয়ারি তিনি গ্রামের বাড়ি বেড়াতে যান। পরদিন ১৪ জানুয়ারি তার বড় ছেলে মো. হাসনাত রহমান হিমেল গ্রামের বাড়ি থেকে ঢাকার বাসায় আসেন। ২১ জানুয়ারি বাসায় তালা লাগিয়ে হিমেল বন্ধুদের সঙ্গে রাঙামাটি ঘুরতে যান। পরদিন ২২ জানুয়ারি গ্রামের বাড়ি কুমিল্লা থেকে ঢাকায় আসেন আবদুর রশিদ। বাসায় এসে দেখেন দরজার তালা ভাঙা। ভিতরে গিয়ে দেখেন আলমারির তালা ভাঙা ও জিনিসপত্র এলোমেলো পড়ে আছে। লুট হয় আলমারিতে থাকা স্বর্ণালংকার ও নগদ টাকা। পরে তিনি এ ঘটনায় ২৩ জানুয়ারি পল্লবী থানায় একটি মামলা করেন। ওই মামলার তদন্ত দেওয়া হয় পল্লবী থানার এসআই মুন্সী আল-আমিনকে। তিনি এই ঘটনায় সিসি ক্যামেরার ভিডিও ফুটেজ ও গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে চোর চক্রটি শনাক্তের চেষ্টা করেন। সফলতাও আসে। ২৯ জানুয়ারি ঢাকার পল্লবী থেকে মো. আল আমিন ওরফে রনিকে গ্রেফতার করেন। তার কাছ থেকে ২০ হাজার টাকা উদ্ধার করা হয়। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে রনি আবদুর রশিদের বাসায় চুরির ঘটনার সঙ্গে জড়িত থাকার কথা স্বীকার করেন। এরপর মামলাটির তদন্তের দায়িত্ব পান ডিবির মিরপুর বিভাগের এসআই মো. শহিদুল ইসলাম। তিনি এই মামলার চুলচেরা বিশ্লেষণ শুরু করেন। তিনি জানতে পারেন এই চক্রটি আন্তজেলা চোর চক্রের সদস্য। তিনিও চক্রের সদস্যদের ধরতে অভিযান শুরু করেন এবং সফল হন।

গত ৪ ফেব্রুয়ারি নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জ থানার নিমাইকাশারী এলাকায় অভিযান চালিয়ে চোর চক্রের দুই সদস্যকে গ্রেফতার করেন। তারা হলেন- মোহাম্মদ আলী ওরফে বাবু এবং আবদুল্লাহ আল মামুন। তাদের কাছ থেকে ওই বাসা থেকে চুরি হওয়া মোবাইল ফোন এবং বাসার দরজা ও আলমারির তালা ভাঙানোর কাজে ব্যবহৃত বিভিন্ন সরঞ্জাম জব্দ করা হয়। পরে তাদের তথ্যের ভিত্তিতে ৯ ফেব্রুয়ারি মানিকগঞ্জের সিংগাইর থানার রাজেন্দ্রপুর ইসলাম নগর এলাকায় অভিযান চালিয়ে চোর চক্রের আরও চার সদস্যকে গ্রেফতার করেন। তারা হলেন- মো. মাসুদ রানা, মো. মহিবুল ইসলাম ওরফে সুমন, মো. জাকির হোসেন ও মো. আইনুল হক। তাদের কাছ থেকে মোবাইল ফোন, সোনা, ঘড়ি ও ল্যাপটপ উদ্ধার করা হয়।

এ বিষয়ে ডিবির পল্লবী জোনের অতিরিক্ত উপ-কমিশনার (এডিসি) মো. রাশেদ হাসান জানান, পল্লবী থানার একটি চুরির মামলা তদন্ত করতে গিয়ে আন্তজেলা চোর চক্রের সন্ধান পাওয়া যায়। এই চক্রের সাত সদস্যকে গ্রেফতার করা হয়েছে। এই চক্রের ৩২ জনের জড়িত থাকার তথ্য পাওয়া গেছে। বাসা ঘুরে ঘুরে তারা রেকি করত। তালাবদ্ধ বাসা পেলেই সাংকেতিক শব্দ হিসেবে ‘অফিস পাইছি’ বলে চক্রের অন্য সদস্যদের জানাত। এরপর দিনদুপুরেই তারা চুরি করত। দলটি পরিচালনাকারী হিসেবে ইয়াসমিন নামে এক নারীর তথ্য পাওয়া গেছে। তাকেসহ চক্রের অন্যান্য সদস্যদের ধরতে অভিযান চলছে।

 

সর্বশেষ খবর