সোমবার, ১৮ সেপ্টেম্বর, ২০২৩ ০০:০০ টা

ঢাকার বাইরে বাড়ছেই মৃত্যু

► ডেঙ্গুতে চট্টগ্রাম বরিশাল ফরিদপুরে আক্রান্ত ও মৃত্যু বেশি ► অপ্রয়োজনে কাউকে ঢাকায় স্থানান্তর না করার নির্দেশ

জয়শ্রী ভাদুড়ী, রেজা মুজাম্মেল, রাহাত খান ও কামরুজ্জামান সোহেল

ঢাকার বাইরে বাড়ছেই মৃত্যু

ডেঙ্গুজ্বরের থাবায় কাঁপছে দেশ। অতীতের সব রেকর্ড ভেঙে ৮০০ ছাড়িয়েছে মৃত্যু। প্রথমবারের মতো ঢাকার বাইরে এত মৃত্যুর ঘটনা ঘটছে। সারা দেশে ছড়িয়ে পড়েছে প্রাণঘাতী ডেঙ্গু। ঢাকার বাইরে মারা গেছেন ২৫৮ জন। এর মধ্যে চট্টগ্রাম, বরিশাল, ফরিদপুরে আক্রান্ত ও মৃত্যুহার আশঙ্কাজনক হারে বেড়েছে। এ পরিস্থিতিতে সারা দেশ থেকে ঢাকায় আসছেন ডেঙ্গু রোগী। ঢাকায় প্রতিদিন প্রায় ১ হাজার রোগী হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছেন। এর মধ্যে অন্যান্য বিভাগ কিংবা জেলাতে রোগীর পরিস্থিতি জটিল হলে ঢাকায় রেফার্ড করা হচ্ছে। তাতে রোগীর চাপ দ্বিগুণ হচ্ছে। গতকাল ডেঙ্গু আক্রান্ত কোনো রোগীকে ঢাকায় স্থানান্তর না করার নির্দেশনা দিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদফতর।

ডেঙ্গু পরিস্থিতি নিয়ে স্বাস্থ্য অধিদফতরে ব্রিফিংয়ে অতিরিক্ত মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আহমেদুল কবির বলেন, আমাদের চিকিৎসা ব্যবস্থায় যে হেলথ কেয়ার ম্যানেজার আছেন, তাদের সঙ্গে আমরা মিটিং করেছি। আমাদের সিভিল সার্জন, ডিভিশনাল ডিরেক্টর, সর্বস্তরের হাসপাতালের পরিচালকদের সঙ্গে আমরা মিটিং করেছি। আমরা কোনো রোগীকে অপ্রয়োজনে ঢাকায় স্থানান্তর না করার নির্দেশনা দিয়েছি।

তিনি বলেন, এখানে দুই তিনটি বিষয় খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ডেঙ্গু চিকিৎসায় মূল বিষয়টি হচ্ছে ফ্লুইড ম্যানেজমেন্ট।

ফ্লুইড ম্যানেজমেন্ট বলতে যখন রোগীর প্রেসার কমে যাচ্ছে, তখন যথাযথ সময়ে আইভি ফ্লুইড দেওয়া। আইভি ফ্লুইড দেওয়ার জন্য অনেক যন্ত্রপাতি বা বড় কোনো ধরনের হাসপাতালের প্রয়োজন নেই। বরং প্রান্তিক পর্যায়ে শকে আছেন যে রোগী, তার শক ম্যানেজ না করে যদি ঢাকায় পাঠানো হয়, তাহলে যাত্রাপথের এই লম্বা সময়ে নিশ্চিতভাবে এই রোগীকে আমরা হারাব। সুতরাং কোনো অবস্থাতেই খারাপ রোগী হোক, শকের রোগী হোক, যেখানে আছে সেখানেই যদি চিকিৎসা নেওয়া হয় এবং তাহলে রোগীর বিপর্যয় হবে না।

স্বাস্থ্য অধিদফতর সূত্রে জানা যায়, গতকাল ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়েছেন ৩ হাজার ১২২ জন। এর মধ্যে ঢাকার হাসপাতালে ভর্তি আছেন ৮৪৯ জন ও ঢাকার বাইরের হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ২ হাজার ২৭৩ জন। গতকাল মারা গেছেন ১৮ জন। এর মধ্যে ঢাকার বাইরে মারা গেছেন ছয়জন। এ পর্যন্ত ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়েছেন ১ লাখ ৬৭ হাজার ৬৮৪ জন। এর মধ্যে ঢাকার বাইরের হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন ৯৪ হাজার ৪৫১ জন। এ বছর ডেঙ্গুর থাবায় প্রাণ হারিয়েছেন ৮২২ জন। এর মধ্যে ঢাকার বাইরের হাসপাতালে মারা গেছেন ২৫৮ জন। তবে রেফার্ড হয়ে ঢাকার বিভিন্ন হাসপাতালে আসা অনেক রোগী ডেঙ্গুতে মারা  গেছেন। যারা ঢাকার বাইরে আক্রান্ত হয়েছেন। চট্টগ্রামে সেপ্টেম্বরের ১৬ দিনেই ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন ১৩ জন। আগস্ট মাসে ২৮ জন এবং জুলাই মাসে মারা যান ১৬ জন। চলতি বছরেই মারা যান ৬৬ জন। তাছাড়া চলতি বছরে মোট আক্রান্ত হন ৭ হাজার ৮২০ জন। গতকাল একদিনেই একজনের মৃত্যু ও ১৪৩ জন আক্রান্ত হন।

এভাবে চট্টগ্রামে প্রতিদিনই ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে মারা যাচ্ছেন। প্রতিদিনই নতুন করে আক্রান্তও হচ্ছেন। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ডেঙ্গু রোগে আক্রান্ত হয়ে ঢাকার পর চট্টগ্রামেই বেশি মারা যাচ্ছে। তবে কেন মারা যাচ্ছে এ নিয়ে নির্দিষ্ট কোনো গবেষণা হয়নি। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, চট্টগ্রাম বড় শহর। এখানে দ্রুত নগরায়ণ হচ্ছে। নির্মিত হচ্ছে বহুতল ভবন। নির্মাণসামগ্রী রাখার জায়গাগুলো এডিস মশা প্রজননের উর্বর ক্ষেত্র। চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালের মেডিসিন বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা. আবদুল্লাহ আবু সাঈদ বলেন, অনেক রোগী জ¦রকে অবহেলা করে বিলম্বে হাসপাতালে আসে। যখন হাসপাতালে আসে, তখন রোগীর প্রেসার কমে শক সিন্ড্রোম চলে আসে। ফলে রোগী দ্রুত খারাপ হয়ে যায়। তাছাড়া ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীর কিডনি জটিলতা, প্রেসার সমস্যা, ক্যান্সার, হৃদরোগসহ অন্যান্য রোগ থাকলেও রোগী দ্রুত সংকটাপন্ন হয়ে যায়। এসব কারণে ডেঙ্গু আক্রান্ত হওয়ার পর রোগী মারা যাচ্ছেন।

বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ট্রপিক্যাল অ্যান্ড ইনফেকশাস ডিজিজের মেডিসিন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. মো. মামুনুর রশীদ বলেন, চট্টগ্রামে কেন ডেঙ্গুতে বেশি আক্রান্ত ও মারা যাচ্ছে- এ নিয়ে পৃথক গবেষণার দরকার। এমন কোনো গবেষণা এখনো হয়নি। তবে এ বছর একযোগে ১২৬টি দেশে ডেঙ্গুর সংক্রমণ চলছে। দেশে ২০১৯ সাল থেকেই ডেঙ্গু সংক্রমণের হার বাড়ছে। এর ঢেউ চট্টগ্রামেও পড়েছে। তাছাড়া এ বছরের আবহাওয়া এডিস মশা ডিম পাড়ার অনুকূল। এ বছর ডেঙ্গু বেশি আক্রান্ত হওয়ার এটিও একটি কারণ। 

বরিশাল বিভাগে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে গত ২৪ ঘণ্টায় আরও তিনজনের মৃত্যু হয়েছে। এ নিয়ে চলতি মৌসুমে বরিশাল বিভাগে ৭৫ জন রোগীর মৃত্যু হলো। গতকালের রিপোর্ট অনুযায়ী বিভাগে চিকিৎসাধীন ছিলেন ১ হাজার ২২৫ জন ডেঙ্গু রোগী। বরিশাল বিভাগের মধ্যে ডেঙ্গুতে সর্বাধিক ৪৮ জনের মৃত্যু হয়েছে বরিশাল শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। গত শনিবার বিভাগের বিভিন্ন সরকারি হাসপাতাল ও স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চিকিৎসাধীন ছিলেন ১ হাজার ২২৫ জন রোগী। বরিশালে ডেঙ্গুতে মৃত্যু বাড়ার কারণ হিসেবে বিভাগীয় স্বাস্থ্য পরিচালক (ভারপাপ্ত) ডা. শ্যামল কৃষ্ণ মন্ডল বলেন, তৃণমূল পর্যায়ে এডিস লার্ভা ছড়িয়ে পড়েছে। দুই মাস আগে পিরোজপুরে নেছারাবাদে এবং পটুয়াখালীর দুমকীতে পরীক্ষায় এডিসের লার্ভা পাওয়া গেছে। বরিশাল বিভাগে ডেঙ্গু পরিস্থিতি উদ্বেগজনক। ফরিদপুরে ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বাড়ছে ভয়াবহ আকারে। জেলার হাসপাতালগুলোতে ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীদের সংখ্যা এতটাই বেড়েছে যে, ঠাঁই মিলছে না হাসপাতালে। ফলে বাধ্য হয়েই ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীরা হাসপাতালের মেঝে কিংবা খোলা আকাশের নিচে থাকতে বাধ্য হচ্ছেন। শহরের চেয়ে গ্রাম থেকেই বেশি রোগী ভর্তি হচ্ছেন হাসপাতালগুলোতে। ফরিদপুর জেলা ছাড়াও মাদারীপুর, গোপালগঞ্জ, শরীয়তপুর, রাজবাড়ী, মাগুরা, ঝিনাইদহ থেকেও ডেঙ্গুতে আক্রান্ত রোগীরা ফরিদপুর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ও সদর হাসপাতালে এসে ভর্তি হচ্ছেন। গত দুই দিনে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন সাতজন। এ নিয়ে ফরিদপুরের বিভিন্ন হাসপাতাল ডেঙ্গুতে ৩০ জনের মৃত্যু হয়েছে। গত ২৪ ঘণ্টায় ফরিদপুরের বিভিন্ন হাসপাতালে নতুন করে ৩২০ জন রোগী ভর্তি হয়েছেন। ডেঙ্গুর ভয়াবহ আকার ধারণ করায় ফরিদপুরের সব সরকারি হাসপাতালে পৃথক ডেঙ্গু ইউনিট খোলা হয়েছে বলে জানিয়েছেন জেলার সিভিল সার্জন ডা. ছিদ্দীকুর রহমান। ফরিদপুর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ডা. এনামুল হক জানান, ফরিদপুরে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা প্রতিদিনই বাড়ছে। এ পর্যন্ত যারা ডেঙ্গুতে মারা গেছেন তাদের মধ্যে নারীদের সংখ্যাই বেশি এবং তাদের বয়স পঞ্চাশের বেশি। ফরিদপুর জেলা সিভিল সার্জন অফিস সূত্রে জানা যায়, এ পর্যন্ত ৮ হাজার ৪৪৬ জন ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন। এর মধ্যে মৃত্যু হয়েছে ৩০ জনের।

সর্বশেষ খবর