সোমবার, ১৮ সেপ্টেম্বর, ২০২৩ ০০:০০ টা

স্ট্যাম্প-কোর্ট ফির তীব্র সংকট

ভোগান্তি বাড়ছে আইনজীবীদের ► বিচারপ্রার্থীদের ব্যয় বাড়ছে ► টাকা জমা দেওয়ার দুই মাসেও না পাওয়ার অভিযোগ ভেন্ডারদের

আরাফাত মুন্না

দেশের আদালতগুলোয় জুডিশিয়াল-নন জুডিশিয়াল স্ট্যাম্প ও কোর্ট ফির তীব্র সংকট দেখা দিয়েছে। এ কারণে দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে আইনজীবীদের। আর মামলার খরচও বাড়ছে বিচারপ্রার্থীদের। আইনজীবীরা বলছেন, সংকটের কারণে অতিরিক্ত দামে স্ট্যাম্প কোর্ট ফি কিনতে হচ্ছে। অনেক সময় কোর্ট ফি না পেয়ে ব্যাংকে টাকা জমা দিয়ে আদালতের অনুমতি নিয়ে মামলা দাখিল করছেন তারা। পরে আবার কোর্ট ফি সংগ্রহ করে তা আদালতে জমা দিতে হচ্ছে। এটা এখন চরম ভোগান্তির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। অন্যদিকে স্ট্যাম্প ভেন্ডারদের অভিযোগ, ব্যাংকে টাকা জমা দিয়ে দু-তিন মাসেও চাহিদা অনুযায়ী কোর্ট ফি-স্ট্যাম্প পাওয়া যাচ্ছে না। তাই অনেক সময় বাধ্য হয়েই অতিরিক্ত দামে বিক্রি করতে হচ্ছে। এ অবস্থায় বিশেষ ব্যবস্থায় জুডিশিয়াল স্ট্যাম্প ও কোর্ট ফি সরবরাহ করতে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরকে গতকাল চিঠি দিয়েছে সুপ্রিম কোর্ট প্রশাসন। সুপ্রিম কোর্টের হাই কোর্ট বিভাগের রেজিস্ট্রার (বিচার) এস কে এম তোফায়েল হাসানের স্বাক্ষর করা চিঠিতে সুপ্রিম কোর্টসহ অধস্তন সকল আদালত ও ট্রাইব্যুনালে স্ট্যাম্প, কার্টিজ পেপার, কোর্ট ফি ও ফলিওর স্বাভাবিক সরবরাহ নিশ্চিত করার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে বলা হয়েছে। জানা গেছে, ৩৪ ধরনের মামলায় কোর্ট ফি ও স্ট্যাম্প প্রয়োজন পড়ে। এ কোর্ট ফি ছাড়া মামলা বা আবেদন দাখিলের সুযোগ নেই। ২ টাকা থেকে ৫ হাজার টাকা মূল্যমানের কোর্ট ফি চালু আছে। আর দ্য সিকিউরিটি প্রিন্টিং করপোরেশন কোর্ট ফি ও স্ট্যাম্প ছাপিয়ে থাকে। ডাক বিভাগের চাহিদা অনুযায়ী তারা শুধু ছাপানোর ব্যবস্থা করে। ছাপানোর পর তা গুদামজাত না করে ৬৩টি জেলা প্রশাসনের ট্রেজারিতে পাঠানো হয়। এরপর সেখান থেকে স্ট্যাম্প ভেন্ডার ব্যবসায়ীরা ক্রয় করে থাকেন। পাশাপাশি সারা দেশের ডাকঘরগুলোতেও কিছুসংখ্যক স্ট্যাম্প ও কোর্ট ফি পাঠানো হয়। এগুলোর বেশির ভাগই রেভিনিউ স্ট্যাম্প। তবে আদালত প্রাঙ্গণে সাধারণত ভেন্ডার ব্যবসায়ীরাই কোর্ট ফি ও জুডিশিয়াল স্ট্যাম্প সরবরাহ করে থাকে। ঢাকার আদালত এলাকা থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে বাজারে ৪, ৫ ও ১০ টাকার কোর্ট ফির সংকট বেশি। এগুলো তেমন একটা পাওয়া যাচ্ছে না। পাওয়া গেলেও বিক্রি হচ্ছে বেশি দামে। ১০ টাকার কোর্ট ফি নেওয়া হচ্ছে ১২ থেকে ১৫ টাকা। বড় বড় কোর্ট ফির চালান ব্যাংকে জমা দিতে গেলে ফিরে আসতে হচ্ছে। আর ১০০ টাকার স্ট্যাম্প ১৩০ থেকে ১৫০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে বলেও অভিযোগ পাওয়া গেছে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকার আদালতের আইনজীবী অ্যাডভোকেট তুহিন হাওলাদার বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, অতিরিক্ত টাকা দিয়েও কোর্ট ফি-স্ট্যাম্প পাচ্ছি না। ফলে ব্যাংকে টাকা জমা দিয়ে কোর্ট ফি দাখিলের জন্য আদালত থেকে সময় নিতে হচ্ছে। এটা এখন এক প্রকার ভোগান্তি হয়ে দাঁড়িয়েছে। একই সঙ্গে বিচারপ্রার্থীদের মামলার খরচ বেড়ে যাচ্ছে। তিনি বলেন, কোনো একটি চক্র কোর্ট ফি ও স্ট্যাম্পের কৃত্রিম সংকট তৈরি করছে। সরকারের সংশ্লিষ্ট দফতরগুলোকে দ্রুত এ বিষয়ে নজর দিতে হবে। জানতে চাইলে ঢাকা জজ কোর্টের স্ট্যাম্প ভেন্ডার মো. নিজাম উদ্দিন বলেন, ব্যাংকে ট্রেজারি চালানের মাধ্যমে টাকা জমা দিয়ে দুই মাসেও কোর্ট ফি পাওয়া যাচ্ছে না। আমি নিজে গত ২৬ জুলাই টাকা জমা দিয়েছি। এখনো সে স্ট্যাম্প পাইনি। আগে টাকা জমা দেওয়ার দুই থেকে তিন দিনের মধ্যেই স্ট্যাম্প কোর্ট ফি বুঝে পাওয়া যেত। সুপ্রিম কোর্ট প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, আইনজীবীরা কিছুদিন ধরে কোর্ট ফির সংকটের বিষয়টি সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্ট্রার জেনারেলের নজরে এনেছেন। রেজিস্ট্রার জেনারেল মো. গোলাম রব্বানী বিষয়টি কার্যভার পালনরত প্রধান বিচারপতি মো. ওবায়দুল হাসানের নজরে আনেন। পরে প্রধান বিচারপতির নির্দেশক্রমে তিনি বিষয়টি নিয়ে অর্থ সচিব, বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ও সিকিউরিটি অ্যান্ড প্রিন্টিং প্রেসের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলেন। তারা দ্রুততম সময়ের মধ্যে এ সংকট সমাধানের আশ্বাস দিয়েছেন। জানতে চাইলে সুপ্রিম কোর্টের গণসংযোগ কর্মকর্তা মো. শফিকুল ইসলাম বলেন, যেসব জায়গায় কোর্ট ফি ও রেভিনিউ স্ট্যাম্পের সংকট রয়েছে সেখানে আপাতত এগুলো ছাড়াই মামলা গ্রহণ করা হচ্ছে। পরে শুনানির সময় সংশ্লিষ্টরা কোর্ট ফি ও রেভিনিউ স্ট্যাম্প দাখিল করবেন। আইনেও এ ব্যবস্থার কথা বলা রয়েছে। সুপ্রিম কোর্ট প্রশাসন থেকে যথাযথ কর্তৃপক্ষকে সমস্যা সম্পর্কে অবহিত করা হয়েছে। শিগগিরই এ সমস্যা কেটে যাবে। এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে আইন ও বিচার বিভাগের সচিব মো. গোলাম সারওয়ার বলেন, চাহিদা অনুযায়ী কোর্ট ফি ও রেভিনিউ স্ট্যাম্প পাওয়া যাচ্ছে না। বিষয়টি নজরে আসার পর এরই মধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংক ও জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) সংশ্লষ্টিদের অবহিত করা হয়েছে। আশা করছি শিগগিরই সমস্যা কেটে যাবে। জানা গেছে, কোর্ট ফি-স্ট্যাম্প বিক্রি করে সরকারের প্রতি বছর কয়েক হাজার কোটি টাকার রাজস্ব আদায় হয়।

এ সুযোগে একশ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ী নকল কোর্ট ফি ছাপিয়ে অল্প টাকায় বিক্রি করে। সর্বশেষ গত বছর সুপ্রিম কোর্টের উদ্যোগে সারা দেশের আদালতগুলোয় নকল কোর্ট ফি ও স্ট্যাম্প শনাক্তে ডিভাইস বসানো হয়। এরপর থেকে নকল কোর্ট ফি ও স্ট্যাম্প বিক্রি অনেকটা কমে গেছে বলে মনে করছেন অনেক আইনজীবী। তারা বলেন, নকল কোর্ট ফি ও স্ট্যাম্প বিক্রি কমে যাওয়ায় আসল কোর্ট ফি ও স্ট্যাম্পের চাহিদা বেড়েছে।

সর্বশেষ খবর