মঙ্গলবার, ১৯ সেপ্টেম্বর, ২০২৩ ০০:০০ টা

সেপ্টেম্বরেই পানিশূন্য তিস্তা

♦ বর্ষা শেষ না হতেই শুকনো ♦ চাষাবাদ নিয়ে শঙ্কায় কৃষক

লালমনিরহাট প্রতিনিধি

সেপ্টেম্বরেই পানিশূন্য তিস্তা

তিস্তাজুড়ে বিস্তীর্ণ ধান খেত বাংলাদেশ প্রতিদিন

বর্ষা শেষ না হতেই পানিশূন্য হয়ে পড়ছে প্রমত্ত তিস্তা। এই সেপ্টেম্বরের তৃতীয় সপ্তাহেই তিস্তার বুকে জেগে উঠেছে অসংখ্য চর। খরস্রোতা তিস্তা শুকিয়ে এখন খাঁ খাঁ করছে। এক মাস আগেও নদীতে ছিল প্রচুর পানি। অথচ বর্ষা শেষ না হতেই নদী মরে গেছে। নদীতে বড় বড় বালুর স্তূপ জমে মূল নদীর গতিপথই হারাতে বসেছে। সরেজমিন তিস্তা দ্বিতীয় সেতু এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, একটি নালা দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে তিস্তার পানি। বিশাল তিস্তার বুকে এখন হাঁটুপানিও নেই। পানিশূন্য তিস্তা যেন কাঁদছে ডুকরে। এই তিস্তার বুকে কৃষক ফলিয়েছে নানা ফসল। নদী গবেষক ড. তুহিন ওয়াদুদ বলেন, বিজ্ঞানসম্মতভাবে তিস্তা খনন না হলে বাংলাদেশ অংশের ১৬৫ কিলোমিটারজুড়ে নদীর দুই পাড়ে বাস করা কোটি মানুষের দুর্ভোগের শেষ থাকবে না। এই সময় যে পরিমাণ পানি থাকার কথা তা না থাকায় নদীটি একেবারে মরতে বসেছে। এ নদী রক্ষা হলে বাঁচবে বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চল। নদী বিশেষজ্ঞরা বলছেন, তিস্তা যেন এখন আর কোনো নদী নয়, একটি মরা খাল। ভারতের গজলডোবার প্রবেশমুখে ও লালমনিরহাটের দোয়ানিতে ব্যারাজ নির্মাণ করে এ নদীর উচ্ছল দুর্বার গতিকে উঁচু পর্যায়ের কিছু মানুষ রোধ করে দিয়েছে। বছরের পর বছর ধরে বিভিন্ন ক্যানেলের মাধ্যমে তিস্তার স্রোত ঘুরিয়ে দিয়ে তার বুক থেকে তুলে নেওয়া হয়েছে পানি নামের জীবন। ফলে মরে গেছে তিস্তা। এই নদীর পাড়ে   দাঁড়ালে এখন যেন বাতাসে শুনতে পাওয়া যায় ক্ষীণকায় তিস্তার দীর্ঘশ্বাস আর গুমড়ে ওঠা কান্নার শব্দ। দীর্ঘ এ তিস্তার বুকজুড়ে শুধুই ধুধু বালুচর। প্রতিদিনই পানির ক্রমহ্রাসে আশা-নিরাশা ও লুকোচুরির কবলে পড়েছে একসময়ের প্রমত্ত তিস্তা। খরস্রোতা তিস্তা নদীর নাব্য এতটাই হ্রাস পেয়েছে যে, আসন্ন রবি মৌসুমে দেশের সর্ববৃহৎ সেচ প্রকল্প তিস্তা ব্যারাজের সেচ কার্যক্রম চালানোই কঠিন হয়ে পড়বে। প্রতিদিনই পানি কমছে। নদীর বুকভরা এখন বালুচর। কোথাও সামান্য পানি, আবার কোথাও দিগন্তজোড়া বালুচর।

পানি উন্নয়ন বোর্ড বলছে, তিস্তা ব্যারাজে এ মুহূর্তে পানি রয়েছে ৩৬ হাজার কিউসেক। এই সময়ে পানি থাকার কথা ৫০-৬০ হাজার কিউসেক। ব্যারাজ পয়েন্টে পানি বিপৎসীমার ১০০-১১০ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। লালমনিরহাট পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী শুনীল রায় জানান, পানি প্রতিদিনই কমছে। চলতি বছরের জুলাই-আগস্ট মাসে টানা বর্ষণ আর উজানের ঢলে ভয়ংকর আকার ধারণ করে তিস্তা নদী। ওই সময় লালমনিরহাটের হাতীবান্ধায় অবস্থিত দেশের বৃহত্তম সেচ প্রকল্প ‘তিস্তা ব্যারাজ’ রক্ষায় খুলে দেওয়া হয় ৫৪টি গেট। এতে শুধু ব্যারাজের উজানের বাসিন্দারাই নন, ভাটিতে থাকা লাখ লাখ মানুষও পানিবন্দি হয়ে পড়েন। নদী ভাঙনে বসতভিটাসহ সবকিছু হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে পড়ে প্রায় ২০ হাজার পরিবার। সূত্রমতে, তিস্তার পানি বণ্টন চুক্তি বাস্তবায়ন না হওয়ায় একদিকে যেমন বর্ষা মৌসুমে ভারত থেকে নেমে আসা ঢলে প্রতি বছর হাজার হাজার মানুষ নিঃস্ব হচ্ছেন, তেমনি শুষ্ক মৌসুমে তিস্তা ব্যারাজের ভাটিতে ভারত তাদের গজলডোবা নামের বাঁধের সাহায্যে একতরফাভাবে পানি আটকিয়ে বাংলাদেশের উত্তর জনপদের লাখ লাখ কৃষকের বোরো চাষাবাদ ব্যাহত করছে। ফলে দিনে দিনে অকার্যকর হয়ে পড়েছে দেশের বৃহত্তম তিস্তা ব্যারাজ সেচ প্রকল্পটি। এ অবস্থায় পানির ন্যায্য হিস্যা আদায় করে তিস্তা নদী বাঁচানোর আকুতি জানিয়েছেন লালমনিরহাট, নীলফামারী, রংপুর ও দিনাজপুরসহ সেচনির্ভর মানুষ।

তিস্তা বাঁচাও, নদী বাঁচাও সংগ্রাম পরিষদের লালমনিরহাটের সভাপতি ড. শফিকুল ইসলাম কানু বলেন, তিস্তার পানি বণ্টন চুক্তি না হওয়ায় শুষ্ক মৌসুমে শুকিয়ে চৌচির হয়ে পড়ে তিস্তা নদী। জেগে ওঠে অসংখ্য চর। বর্ষায় হঠাৎ করে পানির ঢল নামায় নদীর গতিপথ পরিবর্তন হয়ে বন্যার সৃষ্টি হয়। এতে বাড়িঘর গ্রাম-গঞ্জ-হাটবাজার, রাস্তাঘাট, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, পুল-কালভার্ট সব ভেঙে তছনছ হয়ে যায়। এ অবস্থায় তিস্তার মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়ন জরুরি। আমরা আন্দোলন করছি, তিস্তা খনন ও মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়ন না হওয়া পর্যন্ত আমাদের আন্দোলন চলবে।

সর্বশেষ খবর