বুধবার, ২০ সেপ্টেম্বর, ২০২৩ ০০:০০ টা

অভিযানের পর আলু বিক্রি বন্ধ

মুন্সীগঞ্জ প্রতিনিধি ও নিজস্ব প্রতিবেদক, রাজশাহী

অভিযানের পর আলু বিক্রি বন্ধ

ভোক্তা অধিকারের অভিযানের পর থেকে মুন্সীগঞ্জের হিমাগারগুলোতে মজুদ রাখা আলু বিক্রি বন্ধ করে দিয়েছে মজুদদাররা। গতকাল জেলার বিভিন্ন হিমাগারে ঘুরে এমন তথ্য পাওয়া গেছে। অভিযোগ রয়েছে, সরকারি বেঁধে দেওয়া দামে আলু বিক্রি করবেন এমন সিদ্ধান্ত নিয়ে বিক্রি বন্ধে করে দেয় আলু মজুদদার সিন্ডিকেট। এতে পুরো দেশের আলুর সংকট তৈরি হয়েছে বলে দাবি ভোক্তাদের। ফলে অন্যান্য সবজির দাম বেড়েছে কয়েকগুণ। শহরের খুচরা বাজার ঘুরে দেখা গেছে, বাজারে আলুর তীব্র সংকট তৈরি হয়েছে। আলু মজুদদার সিন্ডিকেট অধিক মুনাফার লোভে সরকারি নির্দেশনা অমান্য করে বিক্রি বন্ধ করে দেওয়ায় বাজারে এ সংকট তৈরি হয়েছে। এতে অন্যান্য সবজির দাম কেজিতে ১০ থেকে ১৫ টাকা বৃদ্ধি পেয়েছে। আর চরম হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়েছেন ভোক্তারা। আলু মজুদদার সিন্ডিকেটের সঙ্গে বিএনপি ছাড়া সরকারদলীয় আওয়ামী লীগের একাধিক নেতা-কর্মী জড়িত রয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। বিলকিস ও সবুজসহ একাধিক ক্রেতা জানান, মুন্সীগঞ্জ আলুপ্রধান এ জেলায় সব সময়ই কম দামে আলু পাওয়া যেত। কিন্তু এবার আলু মজুদদার সিন্ডিকেটের কারণে বাজারে থেকে ৫০ টাকা কেজি ধরে আলু কিনতে হচ্ছে। আমাদের মতো মধ্যবিত্ত পরিবারের এক কেজি আলু কিনতেই যদি ৫০ টাকা চলে যায় তাহলে অন্যান্য সবজি কী করে কিনব। তাই দ্রুত এসব মজুদদার সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানান তারা। এ ছাড়া জেলার বিভিন্ন বাজার ঘুরে একাধিক খুচরা ব্যবসায়ী ও ক্রেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, আলুর কৃত্রিম সংকট তৈরি করে অসাধু মজুদদার ব্যবসায়ীরা অধিক মুনাফার লোভে মানুষকে জিম্মি করে রেখেছে। না হলে যে আলু সর্বোচ্চ ২০ থেকে ২৫ টাকায় কেনা যেত সেই আলু এখন ৫০ টাকা কিনতে হচ্ছে। তবে এখন আর ৫০ টাকায়ও কেনা সম্ভব না, কারণ অসাধু ব্যবসায়ীরা খুচরা বাজারে আলু বিক্রি বন্ধ করে দিয়েছে। এতে আলুর তীব্র সংকট তৈরি হয়েছে। উল্লেখ্য, ১৬ সেপ্টেম্বর ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতরের মহাপরিচালক এ এইচ এম সফিকুজ্জামান হিমাগারের আলু ২৬-২৭ টাকা দরে বিক্রি করতে হবে এমন নির্দেশনা দেওয়ার পর থেকে তিন দিন ধরে দেশের বিভিন্ন জেলায় খুচরা বাজারে আলু বিক্রি বন্ধ করে দেয় আলু মজুদদার সিন্ডিকেটের সদস্যরা।

রাজশাহীর হিমাগারগুলো আলু সিন্ডিকেটের দখলে : রাজশাহীর হিমাগারগুলোতে এখনো বিপুল পরিমাণ আলু মজুদ আছে। কিন্তু এর প্রভাব বাজারে নেই। ভোক্তাদের অভিযোগ, আরও বেশি দামের আশায় হিমাগার থেকে চাহিদামতো আলু বাজারে ছাড়ছে না ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট। ফলে আলু উৎপাদনে উদ্বৃত্ত জেলা রাজশাহীতেও এখন খুচরা বাজারে ক্রেতাদের আলু কিনতে হচ্ছে ৫০ টাকা কেজি দরে। হিমাগার ফটক থেকে আড়ত ও পাইকারের মোকাম ঘুরে খুচরা বাজারে পৌঁছতেই কেজিতে দ্বিগুণ হয়ে যাচ্ছে আলুর দাম। এদিকে, আলুর দাম নিয়ন্ত্রণে হিমাগার ছাড়া পাইকারি ও খুচরা বাজারে অভিযান শুরু করেছে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতর। গত বুধবার রাজশাহীর পবা উপজেলার বায়া বাজারের দুটি আড়ত ও দুটি হিমাগারে অভিযান চালিয়েছে ভোক্তা অধিকার রাজশাহী বিভাগীয় কার্যালয়ের আলাদা টিম। এ সময় হিমাগারের আলু ছাড়ের মূল্য চালানি রসিদ না থাকায় বায়া বাজারের আড়তদার মুকুল হোসেনকে ৫ হাজার টাকা ও হযরত আলীকে ৩ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়েছে। সেই সঙ্গে হিমাগার মালিকদের দ্রুত সময়ে বাজারে আলু ছাড়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। অধিদফতরের রাজশাহী বিভাগীয় কার্যালয়ের উপপরিচালক মোহাম্মদ সেলিম বলেন, ‘প্রথমে আমরা খুচরা আলু বিক্রেতাদের কাছে কেনার রসিদ দেখতে চাইলে তারা দেখাতে পারেনি। পরে আমরা আড়তে গিয়ে আলু ছাড়ের রসিদ দেখতে চাইলে তারাও দেখাতে পারেনি।’

আড়তদাররা ভোক্তা অধিকার অধিদফতরকে জানান, হিমাগার থেকে তাদের আলু ছাড়ের রসিদ দেওয়া হয় না। মোহাম্মদ সেলিম আরও বলেন, নওহাটার ‘হিমালয়’ কোল্ড স্টোরেজের সংরক্ষণ ক্ষমতা ১ লাখ ১০ হাজার বস্তা। ইতোমধ্যে তারা ৬০ হাজার বস্তা আলু ছেড়েছে। বাকি ৫০ হাজার বস্তা মজুদ আছে। রহমান কোল্ড স্টোরেজের সংরক্ষণ ক্ষমতা ৩ লাখ বস্তা। তারা ১ লাখ ৭৯ হাজার বস্তা আলু ছেড়েছে। এ কোল্ড স্টোরেজে এখনো ১ লাখ ৩১ হাজার বস্তা আলু মজুদ আছে।

তিনি বলেন, হিমাগার মালিকরা জানিয়েছেন আলু হিমাগারে থাকলেও এর মালিক বিভিন্ন ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট। যারা লাভের আশায় আলু কিনে মজুদ করে রেখেছে। আমরা তাদের তালিকা চেয়েছি।

ভোক্তা অধিকারের কর্মকর্তারা জানান, দেশের অন্যতম আলু উৎপাদনকারী জেলা রাজশাহী। এক মৌসুমে শুধু রাজশাহীতেই ১৬ লাখ মেট্রিক টনের বেশি আলু উৎপাদন হয়। এর মধ্যে রাজশাহীর ৩৬টি হিমাগারের সংরক্ষণ ক্ষমতা ৮০ লাখ বস্তা, যার পরিমাণ ৮ লাখ টনের বেশি। বর্তমানে রাজশাহীর হিমাগারগুলোতে ৪ লাখ টনের বেশি আলু মজুদ আছে। যদিও এর একটা অংশ বীজ আলু হিসেবে সংরক্ষণ করা হয়েছে, যা আবাদ মৌসুমে হিমাগার থেকে ছাড়া হবে। হিমাগারগুলোতে বিপুল পরিমাণ মজুদ থাকতে স্থানীয় বাজারে আলুর কেজি ৫০ টাকা হওয়া উচিত নয় বলে মনে করেন তারা।

জানা গেছে, গত আলু সংগ্রহ মৌসুমে বড় বড় কয়েকটি ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট মাঠ থেকে ১৮ থেকে ২০ টাকা কেজি দরে আলু কিনে হিমাগারে সংরক্ষণ করে। হিমাগারে ৫৫ কেজি থেকে ৬০ কেজির এক বস্তা আলু সংরক্ষণে এক মৌসুমের ভাড়া লাগে ১২০ থেকে ১৩৫ টাকা। সেই হিসাবে এক কেজি আলু সংরক্ষণে হিমাগার ভাড়া লাগে ২ টাকা ২৫ পয়সা থেকে ২ টাকা ৫০ পয়সা। এর সঙ্গে শতকরা ১০ ভাগ মুনাফা যোগ ও পরিবহন ভাড়াসহ হাত বদল হয়েও আলুর কেজি ৩০ থেকে ৩৫ টাকার বেশি হওয়ার কারণ নেই। কিন্তু আলুর কেজি ৫০ টাকা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না বলে মনে করেন ক্রেতারা।

রাজশাহীর এক হিমাগার মালিক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, হিমাগার থেকে বর্তমানে অল্প অল্প করে আলু বাজারে ছাড়া হচ্ছে। ব্যবসায়ীরা প্রতিদিন বাজারে আলুর দামের খোঁজ-খবর রাখছেন। অনেকেই আলু উত্তোলন করে দেশের বিভিন্ন জেলায় চালান করছেন। রাজশাহীর মোহনপুরের মোরসালিন নামে এক আলুচাষি বলেন, হিমাগার থেকে ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট আলু ছাড়ছে না আরও বেশি দামের আশায়। একইভাবে পাইকারি ব্যবসায়ীরাও আলু কিনে আড়তে মজুদ রাখছেন। এতে ভোক্তার ওপর দামের বোঝা দিন দিন বাড়ছে।

সর্বশেষ খবর