বৃহস্পতিবার, ২১ সেপ্টেম্বর, ২০২৩ ০০:০০ টা

অর্থনীতির ছয় চ্যালেঞ্জ

♦ বাজার নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলে মূল্যস্ফীতির চাপ আরও বাড়বে ♦ নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে দীর্ঘমেয়াদি বলছেন বিশ্লেষকরা

মানিক মুনতাসির

অর্থনীতির ছয় চ্যালেঞ্জ

ছয় ধরনের চ্যালেঞ্জের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে দেশের সামষ্টিক অর্থনীতি। এমন পরিস্থিতিতে বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ, এডিবি, ইউএসএইড, ইউকেএইড, জাতিসংঘসহ প্রায় উন্নয়ন সহযোগী সংস্থাই বাংলাদেশসহ এ ধরনের স্বল্পোন্নত দেশগুলোকে সতর্ক করে আসছিল আরও আগে থেকেই। যদিও বাংলাদেশ ২০২৬ সালের মধ্যে এ তালিকা থেকে বেরিয়ে উন্নয়নশীল দেশের কাতারে প্রবেশ করতে যাচ্ছে। বিশ্লেষকরা বলছেন, জাতীয় নির্বাচনের আগে দেশের অর্থনীতির জন্য ছয়টি বিষয় খুবই গুরুত্বপূর্ণ। অর্থবিভাগ অবশ্য এগুলোকে চ্যালেঞ্জ হিসেবেই বিবেচনায় নিয়েছে। সেগুলো হলো- স্থিতিশীল রাজনৈতিক পরিবেশ, ব্যাংক ঋণের সুদের হার বৃদ্ধি, জাতীয় নির্বাচন, বৈশ্বিক অচলাবস্থা, অব্যাহত ডলার সংকট, দেশি-বিদেশি বিনিয়োগকারীদের আস্থাহীনতা। এ ছাড়া দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলে মূল্যস্ফীতির চাপ আরও বাড়বে। যার নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে দীর্ঘমেয়াদি বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা।

অর্থবিভাগের কর্মকর্তারা মনে করেন, করোনা মহামারির পর বিপর্যস্ত অর্থনীতি দ্রুততম সময়ের মধ্যে ঘুরে দাঁড়ালেও বছর ঘোরার আগেই অস্থিতিশীল হয়ে পড়ে দেশের সামষ্টিক অর্থনীতি। টানা দুই বছরের বেশি সময় ধরে চলে আসছে ডলার সংকট। এই সংকট এখন আরও প্রকট আকার ধারণ করেছে। নিত্যপণ্যের দামে সর্বকালের রেকর্ড করেছে। যার ফলে ১১ বছরের সর্বোচ্চ পর্যায়ে উঠেছে খাদ্যে মূল্যস্ফীতি। জাতীয় নির্বাচনের বাকি আর মাত্র তিন মাস। এদিকে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির কারণে মধ্য-নিম্ন আয়ের মানুষের দুর্ভোগ বেড়েছে। ঋণ করেও সংসার চালাতে হিমশিম খাচ্ছেন অনেকেই।

দীর্ঘায়িত হচ্ছে ডলার সংকট : করোনা মহামারির পর শুরু হওয়া ডলার সংকট তীব্র থেকে আরও তীব্রতর হয়েছে। এখন খোলা বাজারে ডলার পাওয়া মুশকিল হয়ে পড়েছে। ব্যাংকিং চ্যানেলেও নির্ধারিত দামে ডলার মিলছে না। সব শ্রেণির ব্যবসায়ীরা বলছেন, বাংলাদেশ ব্যাংক নির্ধারিত রেটে এলসি খুলছে না কোনো ব্যাংক। খোদ এফবিসিসিআইর সভাপতি মাহাবুবুল আলমও এমন অভিযোগ করেছেন। ব্যাংক রেট ১০৯ টাকা হলেও কোনো কোনো ব্যাংক প্রতি ডলার ১১৪ টাকা পর্যন্ত রাখছে এলসি খুলতে। এদিকে ডলারের মূল্যবৃদ্ধির কারণে বাংলাদেশি টাকার মান কমছেই। গত এক বছরে টাকার মান প্রায় ২১ শতাংশ কমেছে। যার ফলে সার্বিক মূল্যস্ফীতির গড় প্রায় দুই অঙ্কের ঘর ছুঁইছুঁই করছে। আর খাদ্যে মূল্যস্ফীতি ১২ শতাংশের ওপরে। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি ও সংকট ঠেকাতে সরকার কিছু কিছু পণ্য জরুরি ভিত্তিতে আমদানি করছে। গতকাল ৪ কোটি ডিম আমদানির অনুমোদন দিয়েছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। অথচ করোনা মহামারির শুরুতে ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে মে মাস পর্যন্ত ডলারের দর ছিল ৮৪ দশমিক ৯৫ টাকা। জুন মাসে ওই দর কমে ৮৪ দশমিক ৮৫ টাকায় নেমে আসে। পরের বছরের জুলাই পর্যন্ত ডলারের দর ছিল ৮৪ দশমিক ৮০ টাকা।

বেড়েছে ব্যাংক সুদ : ব্যাংক আমানত ও ঋণের সুদহার নয়-ছয় শতাংশ তুলে দিয়ে তা বাড়ানো হয়েছে। বর্তমানে তা ১০ শতাংশের বেশি কার্যকর করেছে ব্যাংকগুলো। একদিকে উচ্চ মূল্যস্ফীতি অন্যদিকে আমানতের সুদের হার কমের কারণে আমানতকারীদের অনেকেই ব্যাংকে টাকা রাখতে আগ্রহ দেখাচ্ছে না। আবার সরকারি ও বেসরকারি ঋণ বাড়ায় ব্যাংকগুলোয় তারল্য ঘাটতি দেখা দিয়েছে। এই ঘাটতি মেটাতে ব্যাংকগুলো সুদের হার বাড়াচ্ছে। ব্যাংক ভেদে সুদের হারের ভিন্নতা আছে। তবে সার্বিকভাবে, আমানতের সুদহার ৬ শতাংশ বেঁধে দেওয়া ছিল। বর্তমানে ব্যাংকগুলো প্রতিযোগিতামূলক বাজারে আমানত সংগ্রহে নিজের মতো সুদহার বাড়াচ্ছে। বিশ্লেষকরা বলছেন, এমনিতেই দেশের বিনিয়োগ পরিস্থিতি মোটেও স্বস্তিদায়ক নয়। তারপর যদি সুদহার বাড়ানো হয় তাহলে বিনিয়োগ আরও বেশি বাধাগ্রস্ত হবে। বিনিয়োগকারীরা এতে আগ্রহ হারিয়ে ফেলবেন বলে মনে করেন ব্যবসায়ীরা।

বিনিয়োগকারীদের আস্থাহীনতা : প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে ২০২১ সালের মাঝামাঝিতে করোনাকালীন সময়ে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে ছয়টি বড় ধরনের চ্যালেঞ্জ চিহ্নিত করা হয়েছিল। ইতিহাসের ভয়াবহ এই সংকটে অর্থনীতির গতি স্বাভাবিক রাখতে দেশ-বিদেশি বিনিয়োগে উৎসাহ যোগাতে এবং সব জটিলতার অবসানে এ বিষয়ে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া অপরিহার্য বলে সে সময় মত দিয়েছিলেন ব্যবসায়ীরা। বিশেষজ্ঞরাও বলেছিলেন, সরকারের সামনে চ্যালেঞ্জগুলো হচ্ছে বিনিয়োগকারীদের জন্য ওয়ানস্টপ সার্ভিস (একমুখী সেবা) শতভাগ চালু করা, স্বল্প সুদের ব্যাংক ঋণ নিশ্চিত করা, অর্থনীতি পুনরুদ্ধারে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ঘোষিত প্রণোদনা প্যাকেজের সুষ্ঠু বাস্তবায়ন, ঘন ঘন বিনিয়োগ নীতি (পলিসি) পরিবর্তন, এসব ক্ষেত্রে দক্ষ জনশক্তি গড়ে তোলা এবং সবুজ (পরিবেশ বান্ধব) বিনিয়োগ বাড়ানো। এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় খুব একটা সফলতা আসেনি। যার পেছনে সবচেয়ে বড় কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে ডলার সংকট। এই সংকটের মাঝেই সুদের হার বৃদ্ধি করায় চ্যালেঞ্জটা আরও বাড়ল বলে মনে করেন এফবিসিসিআই সভাপতি।

স্থিতিশীল রাজনৈতিক পরিবেশ ও জাতীয় নির্বাচন : সংবিধান অনুযায়ী নির্ধারিত সময়ে নির্বাচন করতে হলে সময় বাকি আছে আর মাত্র তিন মাস। এরই মধ্যে রাজনৈতিক দলগুলো শুরু করেছে নির্বাচনকেন্দ্রিক নানা কর্মসূচি। তবে বিএনপি আদৌ নির্বাচনে আসবে কিনা-তা নিয়ে সংশয় রয়েছে। দলটি নির্বাচনে না এলে নির্বাচন পরবর্তী সহিংসতা হতে পারে বলে মনে করেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। ফলে সামষ্টিক অর্থনীতির স্বার্থে দেশে স্থিতিশীল রাজনৈতিক পরিবেশ থাকা খুবই জরুরি বলে মনে করেন বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ। এ ছাড়া এবারের জাতীয় নির্বাচনের প্রেক্ষাপটটা একেবারেই ভিন্ন। কেননা এর আগে দুটি নির্বাচনে বিএনপি অংশ নেয়নি। ফলে নির্বাচন পরবর্তী চরম নৈরাজ্যকর পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল। যা দেশের অর্থনীতিকে অনেক পিছিয়ে দিয়েছে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।

বৈশ্বিক অচলাবস্থা : করোনা মহামারির পর শুরু হওয়া রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধকে কেন্দ্র করে যে অচলাবস্থার সৃষ্টি হয়েছিল তা এখনো চলমান। যদিও আন্তর্জাতিক বাজারে জিনিসপত্রের দাম কমতে শুরু করেছে। কিন্তু ডলার সংকটের কারণে দেশের অভ্যন্তরে আমদানিকৃত পণ্যের পাশাপাশি দেশীয় জিনিসপত্রের বাজারে তৈরি হয়েছে অরাজকতা। যা জাতীয় নির্বাচনের আগে সামষ্টিক অর্থনীতিকে স্থিতিশীল করা সরকারের জন্য অন্যতম চ্যালেঞ্জ বলে মনে করেন ড. হোসেন জিল্লুর রহমান। তবে বৈশ্বিক পরিস্থিতি যতটা না অস্থিতিশীল তার চেয়েও বেশি আতঙ্ক রয়েছে দেশের অভ্যন্তরে। কেননা দেশে দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচনে কী হবে এ নিয়ে বৈশ্বিকভাবেও নানা আলোচনা হচ্ছে।

 

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর