বৃহস্পতিবার, ২১ সেপ্টেম্বর, ২০২৩ ০০:০০ টা

আরও তিক্ত হচ্ছে ভারত কানাডা সম্পর্ক

সতর্ক অবস্থানে যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা বিশ্ব

প্রতিদিন ডেস্ক

খালিস্তানি তৎপরতা এবং কানাডায় বসবাসকারী শিখ নেতা হরদীপ সিং নিজ্জর হত্যাকাণ্ডকে কেন্দ্র করে ভারত এবং কানাডার সম্পর্ক আরও তিক্ততার দিকে যাচ্ছে। বিষয়টি নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা বিশ্ব চিন্তিত হয়ে পড়েছে এবং এ নিয়ে যাতে তাদের মধ্যে বিভক্তি ছড়িয়ে না পড়ে, সেদিকে কঠোরভাবে নজর রাখা হচ্ছে। প্রতিক্রিয়া প্রকাশের ব্যাপারেও তারা সতর্কতা অবলম্বন করছে। বিবিসি, রয়টার্স, আলজাজিরা, এনডিটিভি।

তিক্ততার জের ধরে এরই মধ্যে কানাডা তার দেশ থেকে ভারতীয় একজন কূটনীতিককে বহিষ্কার করেছে। পাল্টা পদক্ষেপ হিসেবে ভারতও দিল্লিতে নিযুক্ত কানাডার এক কূটনীতিককে বহিষ্কার করেছে। বিষয়টি এখানেই থেমে যায়নি। শিখ নেতা হরদীপ সিং নিজ্জরকে হত্যার জন্য ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থাকে দায়ী করে কানাডা রীতিমতো আন্তর্জাতিক প্রচারণায় সরব হয়ে উঠেছে। কানাডার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, হরদীপ হত্যার বিষয়টি মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ও যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী ঋষি সুনাকের কাছে উত্থাপন করেছেন কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো।

কানাডা সরকারের এক জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা জানান, কানাডা ও যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা সংস্থা হরদীপের হত্যা-রহস্যের তদন্তে একসঙ্গে কাজ করেছে। তিনি বলেছেন, যৌথ তদন্তে উঠে এসেছে তাকে হত্যায় ভারতীয় এজেন্টদের জড়িত থাকার বিষয়টি। তিনি বলেন, ‘কানাডার কাছে যে তথ্যপ্রমাণ আছে, তা সময়মতো প্রকাশ করা হবে।’ এদিকে যুক্তরাষ্ট্রও জানিয়েছে, তারা কানাডার তদন্তে সহায়তা করেছে। মার্কিন পররাষ্ট্র দফতরের এক জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা উল্লেখ করেছেন, এ বিষয়ে কানাডার কর্মকর্তাদের সঙ্গে তাদের ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ রয়েছে। তারা এ অভিযোগ নিয়ে বেশ উদ্বিগ্ন। তারা মনে করেন, বিষয়টি নিয়ে পূর্ণ ও স্পষ্ট তদন্ত হওয়া গুরুত্বপূর্ণ। তারা ভারত সরকারকে এ তদন্তে সহযোগিতা করার জন্য অনুরোধ করবেন। অপরদিকে ভারতের অভিযোগ, হরদীপ খালিস্তান আন্দোলনের একজন নেতা। ভারতের উত্তরাঞ্চল ও পাকিস্তানের কিছু অংশ নিয়ে স্বাধীন শিখ রাষ্ট্র ‘খালিস্তান’ গঠনের আন্দোলনকারীরা ভারতের চোখে বিচ্ছিন্নতাবাদী হিসেবে বিবেচিত। ভারতের দৃষ্টিতে ‘সন্ত্রাসী সংগঠন’ খালিস্তান টাইগার ফোর্সের (কেটিএফ) মূল পরিকল্পনাকারী হরদীপ। এ ছাড়া ভারতে নিষিদ্ধ শিখ ফর জাস্টিস (এসএফজে) নামে আরেকটি সংগঠনের সঙ্গেও হরদীপ যুক্ত ছিলেন বলে নয়াদিল্লির অভিযোগ। কানাডাকে ইঙ্গিত করে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বিবৃতিতে অভিযোগ করা হয়েছে, অপ্রমাণিত অভিযোগের মূল লক্ষ্য খালিস্তানি চরমপন্থি ও সন্ত্রাসবাদীদের দিক থেকে চোখ ফেরানো। কানাডা দীর্ঘ সময় ধরে ভারতের নিরাপত্তার প্রতি হুমকিস্বরূপ খালিস্তানি (শিখদের) সন্ত্রাসী ও চরমপন্থিদের আশ্রয় দিয়ে আসছে। তারা ভারতের সার্বভৌমত্ব ও অখণ্ডতাকে হুমকির মুখে ফেলেছে। অথচ কানাডা সরকার নিষ্ক্রিয়। বিষয়টি যথেষ্ট উদ্বেগের।

খবরে বলা হয়, যুক্তরাষ্ট্রের মিত্র দুটি দেশের মধ্যে অভূতপূর্ব এ ঘটনায় নড়েচড়ে বসেছে পশ্চিমা বিশ্ব। শিখ আন্দোলন ঘিরে ভারত ও কানাডার মধ্যে অবনতিশীল সম্পর্ক আরও তলানিতে পৌঁছাতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে। পশ্চিমা কূনীতিকদের আশঙ্কা, ভারত-কানাডার বিরোধ আন্তর্জাতিক সম্পর্কের অন্যান্য ক্ষেত্রে ছড়িয়ে পড়তে পারে বা এক্ষেত্রে নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। এ কারণে চিন্তিত পশ্চিমা মন্ত্রী-কর্মকর্তারা সক্রিয় হয়ে উঠেছেন। কারণ যুক্তরাষ্ট্রসহ অন্য পশ্চিমা শক্তিগুলো যা চায় তা হলো, অটোয়া-নয়াদিল্লির মধ্যে চলমান বিরোধের জেরে যেন ভারতের সঙ্গে তাদের বিভক্তি বা দূরত্ব তৈরি না হয়। কেননা, ভূরাজনৈতিক দাবার বোর্ডে ভারত এখন একটি গুরুত্বপূর্ণ খেলোয়াড়। ভারত শুধু একটি ক্রমবর্ধমান শক্তিই নয়, তারা বিশ্বের সবচেয়ে জনবহুল দেশ। তারা বিশ্বের পঞ্চম বৃহত্তম অর্থনীতির দেশ। তা ছাড়া পশ্চিমারা ভারতকে চীনের বিরুদ্ধে একটি সম্ভাব্য শক্তিশালী প্রতিরক্ষাপ্রাচীর হিসেবে বিবেচনা করে আসছে। ফলে ভারত-কানাডার বিরোধ পশ্চিমা কূটনীতিকদের মধ্যে নানা উদ্বেগ-শঙ্কার জন্ম দিয়েছে। এর মধ্যে একটি হচ্ছে, ভারত-কানাডা বিরোধে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের কোনো একটি পক্ষে অবস্থান নেওয়ার ঝুঁকির দিকটি। খবরে আরও বলা হয়, পশ্চিমা কূটনীতিকরা কোনোভাবেই চাইবেন না, কমনওয়েলথভুক্ত দুটি দেশের বিরোধের জেরে উত্তর বনাম দক্ষিণের একটি লড়াই বেধে যাক, ট্রান্স-আটলান্টিক শক্তির সঙ্গে উন্নয়নশীল বিশ্বের একটা দ্বন্দ্ব তৈরি হোক। বিশ্লেষকরা বলছে, এ বাস্তবতায় কানাডার মিত্ররা অটোয়ার প্রতি সতর্কতার সঙ্গে সমর্থন বজায় রেখেছে। হোয়াইট হাউস বলেছে, যুক্তরাষ্ট্র এ হত্যার অভিযোগের বিষয়ে গভীরভাবে উদ্বিগ্ন। এ নিয়ে কানাডার তদন্ত এগিয়ে নেওয়া, দোষীদের বিচারের মুখোমুখি করাটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। বিশ্লেষকরা আরও বলছেন, যুক্তরাজ্য ও অস্ট্রেলিয়ায় শিখ সম্প্রদায়ের একটা বৃহৎ জনগোষ্ঠী রয়েছে। ফলে অটোয়া-নয়াদিল্লির বিরোধ যুক্তরাজ্য ও অস্ট্রেলিয়ায় অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে প্রভাব ফেলতে পারে। যুক্তরাজ্যের পররাষ্ট্র মন্ত্রী জেমস ক্লিভারলি বলেছেন, কানাডা যে গুরুতর অভিযোগ তুলেছে, তা অত্যন্ত মনোযোগ দিয়ে শুনবে তার দেশ। ক্লিভারলি বিবিসিকে বলেছেন, তিনি গত সোমবারই অভিযোগটি নিয়ে কানাডার পররাষ্ট্র মন্ত্রী মেলানি জোলির সঙ্গে কথা বলেছেন। কানাডা যা বলছে, তাকে অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে নিয়েছে যুক্তরাজ্য।

ভারতের সঙ্গে যুক্তরাজ্য তার বাণিজ্য আলোচনা স্থগিত করবে কি না, এ বিষয়ে কিছু বলতে অস্বীকৃতি জানান ক্লিভারলি। তবে তিনি বলেছেন, ভবিষ্যতে কোনো পদক্ষেপের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে যুক্তরাজ্য সরকার কানাডার তদন্ত শেষ হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করবে। উল্লেখ্য, গত ১৮ জুন কানাডার ভ্যাঙ্কুভারের এক শহরতলিতে হরদীপকে (৪৫) গুলি করে হত্যা করা হয়। এটি কানাডার শিখ অধ্যুষিত এলাকা। ভারতের পাঞ্জাব রাজ্যের পর কানাডাতেই শিখ সম্প্রদায়ের সবচেয়ে বেশি মানুষ থাকেন।

সর্বশেষ খবর