শুক্রবার, ২২ সেপ্টেম্বর, ২০২৩ ০০:০০ টা

আলু-ডিম নিয়ে হার্ডলাইনে সরকার

দাম না কমলে আমদানির সুপারিশ, আরও ৬ কোটি ডিম আসছে বিদেশ থেকে

রুকনুজ্জামান অঞ্জন

আলু-ডিম নিয়ে হার্ডলাইনে সরকার

আলু ও ডিমের দাম যৌক্তিক পর্যায়ে আনতে হার্ডলাইনে যাচ্ছে সরকার। পরিস্থিতি সামাল দেওয়া না গেলে ডিমের পর এবার আলু আমদানির উদ্যোগ নেওয়া হতে পারে। এক সপ্তাহ পেরিয়ে গেলেও সরকার নির্ধারিত দামে এই দুটি পণ্য বিক্রি হচ্ছে না। উল্টো হিমাগার মালিক ও পোলট্রি ব্যবসায়ীরা পণ্য দুটির সরবরাহ কমিয়ে দিয়েছেন। প্রথম দফায় ৪ কোটি ডিম আমদানির অনুমতির পর গতকাল আরও ছয়টি প্রতিষ্ঠানকে ৬ কোটি ডিম আমদানির অনুমতি দেওয়া হয়েছে। আলুর দাম না কমায় এবার সবজিজাতীয় এই পণ্যটিও আমদানির বিষয়ে চিন্তাভাবনা করছে সরকার।

কৃষিমন্ত্রী ড. আবদুর রাজ্জাক বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, আলু কোনো আমদানি পণ্য নয়। এ ধরনের উদ্যোগ নেওয়ার পক্ষপাতিও নই আমরা। তবে দাম যদি না কমে তাহলে বিষয়টি ভাবতে হবে। আমরা এখনো কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণ করিনি। এটা (আলু আমদানি) নিয়ে চিন্তাভাবনা হচ্ছে। আলুর দাম কমিয়ে আনতে এরই মধ্যে মুন্সীগঞ্জসহ উত্তরবঙ্গের বিভিন্ন জেলার হিমাগারগুলোতে অভিযান চালাচ্ছে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতরসহ স্থানীয় প্রশাসন। তারপরও খুচরা পর্যায়ে দাম কমেনি। আগের মতো এখনো ৫০ টাকা কেজি দরেই বিক্রি হচ্ছে আলু। ডিম বিক্রি হচ্ছে ১৫০ টাকা ডজন। অথচ সরকার আলুর সর্বোচ্চ খুচরা মূল্য প্রতি কেজি ৩৫-৩৬ টাকা এবং প্রতিটি ডিম ১২ টাকা নির্ধারণ করে দিয়েছে।

ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতরের মহাপরিচালক এ এইচ এম সফিকুজ্জামান বলেন, সরকার মূল্য নির্ধারণ করে দিলেও তা কার্যকর হয়নি। আমরা আরও দু-তিন দিন দেখব। এর পরও যদি আলুর দাম না কমে, তবে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে আমদানির সুপারিশ পাঠাব। মুন্সীগঞ্জের পর উত্তরবঙ্গের কয়েকটি জেলা ঘুরে এসেছেন ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতরের মহাপরিচালক। ঢাকায় ফিরে গতকাল বিকালে বাংলাদেশ প্রতিদিনকে তিনি বলেন, উত্তরবঙ্গের বগুড়া, নীলফামারীসহ কয়েকটি জেলায় ঘুরেছি। প্রতিটি গুদামে আমরা পর্যাপ্ত আলু দেখেছি। এসব আলু নির্ধারিত দামে বিক্রির উদ্যোগ নিতে জেলা প্রশাসকদের প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। এরপরও হিমাগার মালিকরা যদি আলু না ছাড়েন তবে তা গুদামে পচবে।

একের দোষ অন্যের ঘাড়ে : অভিযানের পর হিমাগার থেকে আলুর সরবরাহ কমিয়ে দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে। রাজধানী ঢাকা ছাড়াও চট্টগ্রাম ও বরিশালের বাজার পরিদর্শন করে বাংলাদেশ প্রতিদিনের প্রতিনিধিরা এ তথ্য দিয়েছেন। চট্টগ্রামের প্রতিনিধি ইমরান এমি জানান, চাক্তাই, খাতুনগঞ্জ, চকবাজার এলাকায় আলুর সরবরাহ সংকট দেখা দিয়েছে। বহদ্দারহাট-বাদুড়তলা ব্যবসায়ী কল্যাণ সমিতির সাধারণ সম্পাদক জাকির হোসেন বলেন, সরবরাহ না থাকার কারণে খুচরা ব্যবসায়ীরা আলু বিক্রি করছেন না। যাদের কাছে আলু আছে তারা বেশি দাম রাখছেন। বরিশাল প্রতিনিধি রাহাত খান জানান, শহরের আড়তে প্রতিদিন হাজার মণ আলু বিক্রি হলেও গতকাল ৬০ থেকে ৭০ মণ বিক্রি হয়েছে। হিমাগার মালিকরা সরবরাহ কমানোর বিষয়টি অস্বীকার করছেন। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক মুন্সীগঞ্জের এক ব্যবসায়ী জানান, সরকারের ঘোষণার পর তারা দাম কমিয়েছেন। বর্তমানে সাদা আলু ৫০ কেজির প্রতি বস্তা ১ হাজার ৭০০ টাকা এবং লাল আলু ১ হাজার ৬৫০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। দাম নির্ধারণের আগে প্রতি বস্তা ১ হাজার ৯০০ টাকায় বিক্রি হতো। অর্থাৎ প্রতি বস্তায় দাম কমেছে ২০০ থেকে আড়াই শ টাকা। এটি খুচরা পর্যায়ে কার্যকর হচ্ছে না। হিমাগার মালিক, পাইকার আর খুচরা বিক্রেতা একে অন্যের ঘাড়ে দোষ চাপিয়ে পার পেতে চাইছেন।

সিন্ডিকেটে কৃত্রিম সংকট : বাংলাদেশ মূলত আলু রপ্তানির দেশ। মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, রাশিয়াসহ বেশ কয়েকটি দেশে বাংলাদেশের আলু রপ্তানি হয়। মালয়েশিয়ার একটি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সম্প্রতি আলু রপ্তানির জন্য চুক্তিও করেছে কৃষি মন্ত্রণালয়। ব্রাউন রুট ডিজিসের কারণে বেশ কয়েক বছর বাংলাদেশ থকে আলু না নিলেও সম্প্রতি রোগটি নির্মূল করায় নিষেধাজ্ঞা তুলে নিয়েছে রাশিয়া। চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে রাশিয়ার রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে বৈঠক করে কৃষিমন্ত্রী ড. আবদুর রাজ্জাক বলেছেন, দেশটিতে আবারও আলু রপ্তানির উদ্যোগ নেওয়া হবে। প্রশ্ন উঠেছে, রপ্তানিজাত এই কৃষিপণ্যটি আমদানির সুপারিশ কতটা যৌক্তিক হবে। সরকারের সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সরকারিভাবে দেশে আলুর কোনো ঘাটতি নেই। গত মৌসুমে উৎপাদিত আলু যা আছে, তা দিয়ে এখনো প্রায় চার মাস চলবে। কিন্তু হিমাগার মালিকরা কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে সরবরাহ কমিয়ে দিয়েছেন। ফলে দাম নিয়ন্ত্রণে আমদানির বিকল্প পথে যাওয়ার বিষয়ে চিন্তাভাবনা করছে সরকার।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের মহাপরিচালক তাজুল ইসলাম বলেন, এটি আমাদের কাছেও আশ্চর্যের যে, আলুর দাম নিয়ন্ত্রণে আমদানি করতে হবে! আমরা কয়েক মাস আগেও পণ্যটি রপ্তানি বাড়ানোর জন্য কৃষকদের উৎসাহিত করেছি। কিন্তু হিমাগার মালিকরা অতি মুনাফার আশায় সরবরাহ কমিয়ে দিয়ে এই কৃত্রিম সংকট তৈরি করেছেন।

তাজুল ইসলাম জানান, তাদের হিসাবে এবার দেশে মোট ১ কোটি ১১ লাখ মেট্রিক টন আলু উৎপাদিত হয়েছে। পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সঙ্গেও অধিদফতরের হিসাবের খুব বেশি পার্থক্য নেই। বিবিএস বলছে, আলুর উৎপাদন ১ কোটি ৪ লাখ মেট্রিক টন। মহাপরিচালক বলেন, আমরা যদি এই ৭ লাখ মেট্রিক টন হিসাব থেকে বাদ দিই তারপরও বার্ষিক চাহিদার চেয়ে প্রায় ২৫ লাখ মেট্রিক টন আলু বেশি থাকে। উপরন্তু ১০ লাখ মেট্রিক টন পচে বা নষ্ট হয়ে যাওয়ার কারণে বাদ দেওয়া হলেও চাহিদার চেয়ে ১৫ লাখ মেট্রিক টন আলু বেশি থাকে।

কৃষি সম্প্রসারণ অদিদফতরের কর্মকর্তারা জানান, হিমাগার মালিকদের তথ্য অনুযায়ী এখনো গুদামে ১৬ লাখ মেট্রিক টন আলু আছে। এ ছাড়া গুদামের বাইরে বিভিন্ন দোকানে, কৃষকের হাতে রয়েছে আরও প্রায় ১০ লাখ টন; ফলে সব মিলিয়ে ২৫ লাখ টন আলু রয়েছে, যা দিয়ে আরও চার মাসের চাহিদা মেটানো যাবে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দেশে যে আলু আছে, তা দিয়ে জানুয়ারি পর্যন্ত চলবে। এর আগে নভেম্বরের দিকে আগাম আলু কিছু উঠতে পারে। ফলে সংকট হওয়ার কথা নয়। তবে অসাধু ব্যবসায়ীরা কৃত্রিম সংকটের দোহাই দিয়ে দাম না কমালে আলু আমদানির সিদ্ধান্ত নেওয়া ছাড়া সরকারের উপায় থাকবে না।

সর্বশেষ খবর