রবিবার, ২৪ সেপ্টেম্বর, ২০২৩ ০০:০০ টা
ভাসমান মানুষের জীবন

মাথা গোঁজার ঠাঁই নেই ওদের

আফরিদ সাররাফ আলী

মাথা গোঁজার ঠাঁই নেই ওদের

ঘড়ির কাঁটা বিকাল ৫টা ছুঁইছুঁই। শেষ বিকালের আলো ঠিকরে পড়েছে রাজধানীর বিমানবন্দর রেলস্টেশনের প্ল্যাটফরমে। দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে ট্রেন এসে থামছে স্টেশনে। ব্যস্ত যাত্রীদের নিজ গন্তব্যে যাওয়ার তোড়জোড়। ঠায় দাঁড়িয়ে থাকা ১০ বছরের ছেলে অনিক অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে ছেড়ে যাওয়া একটি ট্রেনের দিকে। কাছে গিয়ে তুমি বাড়ি যাবে না জানতে চাইলে তার উত্তর আমি কোথায় যাব? এটাই তো আমার বাড়ি। মানুষের কাছে খাওয়ার জন্য টাকা চাওয়া লাগে। রাতে মাথার নিচে পলিথিন দিয়ে শুয়ে থাকি এই প্ল্যাটফরমে। অনীকের মতো বাংলাদেশে এমন ভাসমান মানুষের সংখ্যা ২২ হাজার ১৮৫ জন। ২০২২ সালের জনশুমারি ও গৃহগণনার প্রাথমিক রিপোর্ট অনুযায়ী, ঢাকা জেলাতেই ৬ হাজার ৪৭৬ জন ভাসমান মানুষ আছেন। এই মানুষেরা রেলস্টেশন, বাসস্ট্যান্ড, মাজার, ফুটপাত, ওভারব্রিজের সিঁড়ি, লঞ্চ টার্মিনালসহ বিভিন্ন জায়গায় মানবেতর জীবনযাপন করে।

কমলাপুরে কথা হয় ভাসমান শিশুদের নিয়ে কাজ করা অ্যাকশন ফর সোশ্যাল ডেভেলপমেন্ট এনজিওর কর্মী খন্দকার সালাউদ্দিনের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘এই কমলাপুর রেলস্টেশনে শতাধিক ভাসমান শিশুর বসবাস। এখানে ওদের জীবনযাপন বেশ করুণ। দুর্যোগে-বৃষ্টিতে এই শিশুরা ঘুমাতে পারে না। কিছু শিশু মাদকাসক্ত। ছিনতাইয়ের সঙ্গে অনেকে জড়িত। কেউ কেউ প্রতারণার ফাঁদ ফেলে টাকা আয় করে। আমরা স্টেশনে ওপেন লার্নিং সেন্টারের মাধ্যমে শিশুদের সচেতন করার জন্য প্রতিনিয়ত সেশন নেই। শিশুদের লেখতে পড়তে শেখার পাশাপাশি মানবপাচার, পরিচ্ছন্নতাসহ বেশ কিছু বিষয়ে সচেতন করা হয়।’ হাই কোর্ট মাজার এলাকার রাখি বেগমের বয়স ৫০-এর ঘরে। শরীরে বাসা বেঁধেছে কিডনি রোগ। টাকার অভাবে চিকিৎসা করাতে পারছেন না। তিনি বলেন, ‘ভিক্ষা কইরা ১০ টাকা, ২০ টাকা পাই। ওড়না, কাপড়, পলিথিন বিছিয়ে জাতীয় ঈদগাহের বাইরের রাস্তায় থাকি। এই মাজারে আসলে দুপুর আর সন্ধ্যায় খাবার পাই।’ হাই কোর্ট মাজার এলাকায় ৩০ পেরোনো সোনিয়া বলেন, ভোর হলেই উঠে যেতে হয়। ভিআইপি আসলে উঠায়া দেয়। রাস্তার লোকেরা একজনের জায়গা আরেকজন নিয়া নেয়।’ মহাখালী বাস টার্মিনালের যাত্রী ছাউনিতে থাকে আট-নয় বছরের শিশু সাব্বির। সে বলল, আমার মা-বাবা কেউ নাই। খেয়ে না খেয়ে এই টার্মিনালেই আছি। টার্মিনাল ছেড়ে যেতে চাই, কিন্তু যাওয়ার কোনো জায়গা নাই। এয়ারপোর্ট এলাকার ৪০ বছর বয়সী মো. আলমাস আলমগীরের পায়ে ঘা হয়েছে। সেই ক্ষতে মাছি বসছে একের পর এক। তিনি টাকার অভাবে চিকিৎসা করাতে পারেন না। তিনি বলেন ‘আমি ভিক্ষা করে খাই। এই স্টেশনেই থাকি ১৪ বছর ধরে। আমাকে লোকেরা প্রতিবন্ধী দেখে কাজই দিতে চায় না।’ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. ফাতেমা রেজিনা ইকবাল বলেন, ৯০-এর দশক থেকে ঢাকায় আশ্রয়হীন মানুষদের সংখ্যা বাড়তে থাকে। গৃহহীন মানুষদের ঢাকায় আসার মূল কারণ, এখানে আসলে নানানরকম কাজ পাওয়া যায়। আশ্রয়হীন মানুষদের একটি অংশের সঙ্গে অপরাধের সম্পর্ক আছে। অনেকে বাধ্য হয়েই অপরাধের সঙ্গে জড়িয়ে যায়। দেশে নদী ভাঙনের ফলে কৃষক রাতারাতি বেকার হয়ে অনেকেই ঢাকায় এসে পড়েন।

সর্বশেষ খবর