বুধবার, ২৭ সেপ্টেম্বর, ২০২৩ ০০:০০ টা

ছোট দলের চোখ বড় দলে

আত্মপ্রকাশ হচ্ছে নিত্যনতুন জোট, ভোট না থাকলেও তাদের পাশে পেতে চায় আওয়ামী লীগ ও বিএনপি

রফিকুল ইসলাম রনি ও শফিকুল ইসলাম সোহাগ

ছোট দলের চোখ বড় দলে

নির্বাচন এলেই বাড়ে জোটের রাজনীতি। ভোট আর জোট একসঙ্গেই চলছে কয়েক দশক ধরে। নির্বাচনী বৈতরণী পার হতে জোটের হিসাব মেলাতে চায় বড় রাজনৈতিক দলগুলো। বিশেষ করে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও মাঠের বিরোধী দল বিএনপি জোট গড়েই গত কয়েক দফায় নির্বাচনে অংশ নিয়েছে। বড় দুই দলের সঙ্গে থাকলে ক্ষমতার ‘স্বাদ’ পাওয়া আর তা না হলে নিজেদের ‘গুরুত্ব’ বাড়ানোর প্রক্রিয়াও শুরু হয়েছে ছোট রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে। নিজস্ব ভোট ব্যাংক না থাকলেও ভোটের রাজনীতিতে তাদের দিন দিন গুরুত্ব বাড়ছে। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে ছোট ছোট রাজনৈতিক দলগুলো ঝুকছে বড় দলের দিকে। নিবন্ধন না থাকলেও নিত্যনতুন জোটের আত্মপ্রকাশ ঘটছে। পাঁচ তারকা হোটেলসহ জাতীয় প্রেস ক্লাবে ঘটা করে সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে নিজেদের আত্মপ্রকাশের ঘোষণা দিচ্ছে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও জোট। অতি সম্প্রতি ছয়টি রাজনৈতিক দলকে নিয়ে ‘জাতীয় জোট’ নামে একটি জোটের আত্মপ্রকাশ ঘটেছে। এ ছাড়াও ১৫-দলীয় প্রগতিশীল ইসলামী জোটের আত্মপ্রকাশ ঘটেছে। এই দুটি রাজনৈতিক জোটই ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সঙ্গে থাকতে চায়। অন্যদিকে সম্প্রতি আলোচনায় থাকা ‘গণতন্ত্র মঞ্চ’, ‘১২-দলীয় জোট’ এবং ‘১১-দলীয় জাতীয়তাবাদী সমমনা জোট’-এর এখনো মাঠের বিরোধী দল বিএনপির দিকেই ঝোঁক রয়েছে।

আওয়ামী লীগ নতুন দল বা জোটকে স্বাগত জানাবে কি না জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘বাংলাদেশের সংবিধান, মুক্তিযুদ্ধ, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে যারা মানেন, ধারণ করেন এমন রাজনৈতিক দলকে স্বাগত জানানো হবে। ‘দশের লাঠি একের বোঝা’ বলে একটি কথা রয়েছে। কাজেই আমরা চাই শক্তি বাড়ুক। কাজেই ছোট দল বলে কাউকে অবেহলার চোখে দেখছি না।’

বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান শামসুজ্জামান দুদু বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘গণতন্ত্র রক্ষার আন্দোলনে যারাই আমাদের যুগপৎ আন্দোলনে যুক্ত হবে, তাদেরকেই আমরা সাধুবাদ জানাব। ইতোমধ্যে আমরা ৩৬টি রাজনৈতিক দল নিয়ে নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে আন্দোলন করছি। নিরপেক্ষ সরকার প্রতিষ্ঠা হলে ভোটে ওই দলগুলোর প্রতিনিধি বিজয়ী না হলেও বিএনপি সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করলে তাদেরকে নিয়ে সরকার গঠন করব।’

জানা গেছে, ভোটের আগে ছোট দলগুলোর লক্ষ্য বড় দুটি রাজনৈতিক দলের কাঁধে সোয়ার হয়ে ক্ষমতার স্বাদ নেওয়া। ভাগ্য ভালো হলে মিলেও যেতে পারে এমপি কিংবা মন্ত্রীর পদ। নিকট অতীতেই এমন নজির রয়েছে। সাম্যবাদী দলের সাধারণ সম্পাদক দিলীপ বড়ুয়া এককভাবে নির্বাচনে অংশ নিয়ে চট্টগ্রামের একটি আসন থেকে ৫১৭ ভোট পেয়েছিলেন। সেই দিলীপ বড়ুয়াও বিগত মহাজোট সরকারের মন্ত্রী ছিলেন।

আওয়ামী লীগ ও বিএনপির সূত্র জানিয়েছে, নির্বাচনের সময় ঘনিয়ে আসায় ছোট ছোট অনেক রাজনৈতিক দল বড় দলগুলোতে ভর করার চেষ্টা করছে। আওয়ামী লীগ বর্তমানে ১৪-দলীয় জোট রয়েছে। এ জোটে রাজনৈতিক দলের সংখ্যা বাড়ানো নিয়ে নানা মত রয়েছে। একটি পক্ষ চায় জোটের পরিধি না বাড়িয়ে অন্য দলগুলো যুগোপৎভাবে আওয়ামী লীগের সঙ্গে থাকুক। তারা দেশবিরোধী ষড়যন্ত্র মোকাবিলায় অংশ নিক। এ ছাড়াও এককভাবে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে নিজেদের সাংগঠনিক শক্তির জানান দিক। আবার জোট বাড়িয়ে নির্বাচনে যাওয়ার পক্ষে কেউ কেউ। সবকিছু নির্ভর করছে বিএনপির নির্বাচনে অংশগ্রহণ কিংবা বর্জনের ওপর।

জানা গেছে, যতই ভোট কাছাকাছি আসে, ছোট ছোট দলগুলো ততই তৎপর হয় জোটবদ্ধ হতে। নির্বাচন হলো ছোট দলগুলোর মৌসুম। সর্বশেষ নিবন্ধন পাওয়া দলসহ বর্তমানে বাংলাদেশ নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধিত রাজনৈতিক দল আছে ৪০টি। এ ছাড়া আরও শতাধিক দলের নাম আছে রাজনীতির মাঠে। এর মধ্যে বেশির ভাগই নাম ও প্যাডসর্বস্ব, ব্যক্তিনির্ভর। এমনকি নিবন্ধিত দলের মধ্যেও নামসর্বস্ব দল আছে। আবার নিবন্ধিত দল হলেও নেই নিজস্ব রাজনৈতিক কার্যালয়। ব্যক্তিগত অফিসে হয় দলের কার্যক্রম। আসলে নিবন্ধিত দলগুলোর মধ্যে আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জাতীয় পার্টি ও জামায়াতে ইসলামী ছাড়া আর কারও লড়ার মতো তেমন ভোট নেই। অন্যদের ভোট না থাকলেও সাইনবোর্ড আছে। সারা বছর ঘুমিয়ে থাকলেও নির্বাচনী মৌসুমে এই দলগুলোর তৎপরতা বেড়ে যায়। এদিক সেদিক ঘোরাফেরা করে। কোনো বড় দলের ছায়ায় আশ্রয় নিতে চায়। জোটভুক্ত হওয়ার জন্য, নির্বাচনে মনোনয়নের জন্য নানারকম দর কষাকষি শুরু করে। একটা-দুটা আসনে মনোনয়ন পেলেই এরা খুশি। তবে মনোনয়ন সবার কপালে জোটে না। মনোনয়ন না পেলেও নির্বাচনের পর নানা সুবিধা পায়। ভোটের মাঠে একটা হাওয়া, একটা জোয়ার তৈরি করতেই হাঁকডাক লাগে। কখনো কখনো জোট বা দলের সংখ্যাটাও গুরুত্বপূর্ণ। তাই ভোটের আগে ভোটারবিহীন খুচরা দলগুলোরও জোটের প্রশ্নে দাম বেড়ে যায়। নির্বাচনের আগে দলবদলের মতো জোট বদলের ঘটনাও ঘটে।

১৫-দলীয় প্রগতিশীল ইসলামী জোট : সাবেক সংসদ সদস্য, ইসলামী গণতান্ত্রিক পার্টির চেয়ারম্যান এম এ আউয়ালের নেতৃত্ব ১৫টি রাজনৈতিক দলের সমন্বয়ে প্রগতিশীল ইসলামী জোট গঠিত হয়েছে। ১৩ সেপ্টেম্বর জাতীয় প্রেস ক্লাবে সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে আত্মপ্রকাশ করে মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের প্রগতিশীল, ইসলামী ও সমমনা দলগুলোর এই জোট। জোটভুক্ত দলগুলো হচ্ছে- ইসলামী গণতান্ত্রিক পার্টি, নেজামে ইসলাম বাংলাদেশ, বাংলাদেশ গণ আজাদী লীগ, বাংলাদেশ তরীকত ফ্রন্ট, বাংলাদেশ ডেমোক্রেটিক পার্টি, বাংলাদেশ ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক লীগ, বাংলাদেশ জনমত পার্টি, বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী জনতা দল, ইসলামী লিবারেল পার্টি, জনতার কথা বলে, বাংলাদেশ স্বাধীন পার্টি, বাংলাদেশ গণতন্ত্র মানবিক পার্টি, সাধারণ ঐক্য আন্দোলন, বাংলাদেশ ইসলামিক গণতান্ত্রিক লীগ ও বাংলাদেশ ইসলামিক ডেমোক্রেটিক ফোরাম।

জোটের চেয়ারম্যান এম এ আউয়াল বলেন, মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষে ধর্মীয় মূল্যবোধে বিশ্বাসী ১৫টি দল নিয়ে প্রগতিশীল ইসলামী জোট গঠন করেছি। উদ্দেশ্য নির্বাচন ও নির্বাচনপরবর্তী দেশি-বিদেশি সব চক্রান্ত প্রতিহত করা। তিনি বলেন, আমরা চাই গণতন্ত্র উন্নয়ন এবং সংবিধান অক্ষুণ্ন থাকুক। তিনি বলেন, দেশের একটি জরুরি মুহূর্তে মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের শক্তি হিসেবে প্রগতিশীল জোট সম্মিলিতভাবে সব চক্রান্ত রুখে দিতে প্রস্তুত।

ছয়-দলীয় লিবারেল ইসলামিক জোট : সম্প্রতি নির্বাচন কমিশনের নিবন্ধন পাওয়া বাংলাদেশ সুপ্রিম পার্টির (বিএসপি) নেতৃত্বে ‘লিবারেল ইসলামিক জোট’ নামে নতুন একটি জোট গঠন করা হয়েছে। গত ৪ সেপ্টেম্বর এই জোটের আত্মপ্রকাশ হয়। এ জোটের দলগুলো সরকার সমর্থক বলে পরিচিত।

জোটের বাকি দলগুলো হলো- বাংলাদেশ ইসলামী ঐক্যজোট, আশিক্কীনে আউলিয়া ঐক্য পরিষদ, বাংলাদেশ জনদল (বিজেডি), কৃষক শ্রমিক পার্টি (কেএসপি) এবং ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ ভাসানী)। বিএসপি চেয়ারম্যান সৈয়দ সাইফুদ্দীন আহমদ মাইজভান্ডারী জোটের চেয়ারম্যান।

বাংলাদেশ ইসলামী ঐক্যজোটের চেয়ারম্যান মিছবাহুর রহমান চৌধুরী জোটের নির্বাহী চেয়ারম্যান ও মুখপাত্র। তিনি আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর থেকেই বিভিন্ন সময় সরকারি বিভিন্ন দায়িত্ব পালন করে আসছেন।

ছয়-দলীয় জাতীয় জোট : নিবন্ধিত রাজনৈতিক দল বাংলাদেশ কংগ্রেসের নেতৃত্বে ছয়-দলীয় ‘জাতীয় জোট’ নামে গত ২৩ সেপ্টেম্বর রাজনৈতিক জোটের আত্মপ্রকাশ ঘটেছে। বাংলাদেশ কংগ্রেসের চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট কাজী রেজাউল হোসেন চেয়ারমান এবং একই দলের মহাসচিব অ্যাডভোকেট মো. ইয়ারুল ইসলাম জোটের মুখপাত্র। এই জোট ৩০০ আসনে প্রার্থী দিয়ে আগামী দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে অংশ নেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে। জোটভুক্ত অন্য পাঁচটি দল হচ্ছে- গণ অধিকার পার্টি-পিআরপি, বাংলাদেশ বেকার সমাজ, বাংলাদেশ পিপলস পার্টি, বাংলাদেশ গ্রিন পার্টি ও বাংলাদেশ সৎ-সংগ্রামী ভোটার পার্টি। জাতীয় ও স্থানীয় সরকার নির্বাচনে আগামীতে একত্রে অংশ নেওয়া ছাড়াও এই জোট দেশ ও জনগণের স্বার্থে এবং জাতীয় সংকট নিরসনে যৌথভাবে কর্মসূচি দেবে।

৩৬ দল সক্রিয় চার প্ল্যাটফরমে : বিএনপির সঙ্গে সমন্বয় করে সরকারবিরোধী যুগপৎ আন্দোলন করে যাচ্ছে ৩৬টি রাজনৈতিক দল। তারা চারটি প্ল্যাটফরমে আলাদা মোর্চা গঠন করে বিএনপির সঙ্গে অভিন্ন কর্মসূচি পালন করছে। সমাজতান্ত্রিক দল (জেএসডি), নাগরিক ঐক্য, বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি, গণসংহতি আন্দোলন, গণ অধিকার পরিষদ, ভাসানী অনুসারী পরিষদ ও রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলন এই ৭টি সমমনা দল নিয়ে গঠিত হয়েছে ‘গণতন্ত্র মঞ্চ’। ‘১২-দলীয় জোট’ নামে কর্মসূচি পালন করা দলগুলো হচ্ছে- জাতীয় পার্টির (কাজী জাফর) চেয়ারম্যান মোস্তফা জামাল হায়দারের নেতৃত্বে বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টি, বাংলাদেশ জাতীয় দল, বাংলাদেশ এলডিপি, জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশ, বাংলাদেশ মুসলিম লীগ, জাতীয় গণতান্ত্রিক পার্টি- জাগপা, ইসলামী ঐক্য জোট, বাংলাদেশ ইসলামিক পার্টি। এ ছাড়াও লেবার পার্টি ও এনডিপি পৃথকভাবে কর্মসূচি পালন করে।

১১-দলীয় জাতীয়তাবাদী সমমনা জোট : জোটে থাকা দলগুলো হলো ন্যাশনাল পিপলস পার্টি-এনপিপি, জাগপা (খন্দকার লুৎফুর), ডেমোক্রেটিক লীগ (ডিএল), বাংলাদেশ ন্যাপ, বিকল্প ধারা (নুরুল আমিন), সাম্যবাদী দল, গণদল, ন্যাপ-ভাসানী, ইসলামী ঐক্যজোট, পিপলস লীগ ও বাংলাদেশ সংখ্যালঘু জনতা পার্টি।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর