বুধবার, ২৭ সেপ্টেম্বর, ২০২৩ ০০:০০ টা

নিষিদ্ধ পলিথিনে কৃষির সর্বনাশ

♦ অণুজীবের বৃদ্ধি রোধে অনুর্বর হচ্ছে মাটি ♦ মাইক্রোপ্লাস্টিক আকারে ঢুকছে জীবনচক্রে ♦ বাড়ছে ক্যান্সারসহ নানা রোগ

শামীম আহমেদ

নিষিদ্ধ পলিথিনে কৃষির সর্বনাশ

শুধু পরিবেশ দূষণ নয়, দেশের কৃষিকে ভয়াবহ ঝুঁকির মুখে ঠেলে দিচ্ছে নিষিদ্ধ পলিথিন। মাঠঘাট, খালবিল, নদী, ডোবা, কৃষিজমি সর্বত্র সয়লাব অপচনশীল বিপজ্জনক পলিথিনে। এসব পলিথিন মাটি বা পানিতে অপচনশীল অবস্থায় থাকছে শত শত বছর। এতে শিকড় বিস্তার করতে পারছে না গাছ। মাটিতে অণুজীব বাড়তে না পারায় উর্বরতা হারিয়ে বন্ধ্যা হচ্ছে মাটি। ঝুঁকির মুখে সব ধরনের ফসল উৎপাদন। পরিবেশ বিপর্যয় রোধে ২১ বছর আগে দেশে পলিথিন নিষিদ্ধ করা হলেও এ সময়ে উল্টো বেড়েছে পলিথিনের উৎপাদন ও বিপণন। মাঝে মধ্যে বিভিন্ন বাজারে অভিযান চালিয়ে পলিথিন জব্দ করা হলেও বন্ধ হচ্ছে না কারখানা।

পরিবেশবিদরা বলছেন, দুই দশক আগে পলিথিন নিষিদ্ধ করার আগে একটি পলিথিন ব্যাগের দাম ছিল এক-দুই টাকা। মূল্যস্ফীতি ধরলে এখন সেগুলোর দাম হওয়া উচিত অন্তত ১০-১৫ টাকা। অথচ বর্তমানে ২০-৩০ পয়সায় পলিথিন ব্যাগ মিলছে। দোকানিরা পাঁচটি পণ্যের সঙ্গে পাঁচটি পলিথিন বিনামূল্যে দিচ্ছে। ১০০ গ্রাম আদা কিনলেও ঘরে আসছে একটি পলিথিন। প্লাস্টিক বোতলের একটি অংশ রিসাইকেল হলেও পলিথিন সবটাই পরিবেশে ছড়িয়ে পড়ছে। এগুলো গুঁড়ো হয়ে মাইক্রোপ্লাস্টিক আকারে পরিবেশের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ছে।

যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল ওশেনিক অ্যান্ড অ্যাটমোসফেরিক অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের গবেষণার তথ্যানুযায়ী, মুদি দোকানের পণ্য বিক্রিতে ব্যবহৃত প্লাস্টিক ব্যাগ মাটিতে মিশতে সময় লাগে প্রায় ২০ বছর; চা, কফি, জুস তথা কোমল পানীয়ের প্লাস্টিক কাপের ক্ষেত্রে সময় লাগে ৫০ বছর; প্লাস্টিকের বোতল প্রকৃতিতে অবিকৃত থাকে প্রায় ৪৫০ বছর। চলতি বছর একটি বেসরকারি সংস্থা ঢাকার চারপাশের নদী তীরের মাটি খুঁড়ে প্রতি টন মাটিতে আধা কেজি থেকে দেড় কেজি পর্যন্ত প্লাস্টিক পেয়েছে। সেখানে মিলেছে ১৫ বছরের পুরনো প্লাস্টিকও। এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড সোশ্যাল ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশনের (এসডো) এক জরিপে দেখা গেছে, প্রতি বছর ৮৭ হাজার টন একবার ব্যবহার্য পলিথিন ও প্লাস্টিক বাংলাদেশে ব্যবহৃত হয়। এসব অপচনশীল দ্রব্য কৃষিজমি, পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থা, নদীনালা, খালবিল ও সমুদ্রে পতিত হয়ে পরিবেশ, প্রতিবেশ ও কৃষির মারাত্মক ক্ষতি করছে।

শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের জেনেটিক্স অ্যান্ড প্লান্ট ব্রিডিং বিভাগের অধ্যাপক ড. জামিলুর রহমান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, প্রাকৃতিক নিয়মে প্রতিনিয়ত নতুন মাটি তৈরি হয়। মাটির অনুজীব জৈব পদার্থ পচিয়ে মাটিকে উর্বর করে। পলিথিন বা প্লাস্টিক থাকলে অনুজীব বাড়ে না। নতুন মাটি তৈরি হয় না। আবার প্লাস্টিক বা পলিথিনের কারণে গাছ শিকড় বিস্তার করতে পারে না। এতে ফসলের উৎপাদন কমে যায়। আপাতদৃষ্টে প্রভাবটা হয়তো চোখে লাগছে না, কিন্তু ভবিষ্যৎ খুবই ভয়াবহ। কৃষিতে বিপর্যয় দেখা দিতে পারে। তিনি বলেন, ঢাকায় বাসাবাড়ির ময়লা সিটি করপোরেশন সংগ্রহ করে নিয়ে যায়। কিন্তু সারাদিন পথে ঘাটে চিপস, চানাচুর, বিস্কুটের প্যাকেট পরিবেশেই ছড়িয়ে পড়ে। আর গ্রামে তো ময়লা সংগ্রহই করা হয় না। এজন্য গ্রামে বাসাবাড়ি ও হাট-বাজারের আশপাশের জমিতে তেমন ফসল হয় না। লোকালয় থেকে দূরের কৃষিজমি পরিষ্কার মনে হলেও সেখানে মাইক্রোপ্লাস্টিক ঢুকে গেছে। হয়তো সরাসরি পলিথিন পড়ছে না, কিন্তু ধীরে ধীরে বাতাসে উড়ে বা পানির সঙ্গে সর্বত্র ছড়িয়ে পড়বে। সেচের পানির সঙ্গে এসব জমিতে মাইক্রোপ্লাস্টিক জমছে। কারণ নদনদীর পানিতে মাইক্রোপ্লাস্টিক ভরে গেছে। মাছের দেহে মাইক্রোপ্লাস্টিক পাওয়া যাচ্ছে। খাবারের মাধ্যমে এসব প্লাস্টিক আমাদের শরীরে ঢুকে ক্যান্সারসহ নানা রোগ জন্ম দিচ্ছে।

গতকাল রাজধানীর নতুন বাজারে ১৬-২০ বর্গফুট আকারের ছোট্ট একটি পলিথিনের দোকানে গিয়ে জানা যায়, প্রতিদিন দোকানটি থেকে প্রায় ৩০-৩৫ কেজি পলিথিন আশপাশের দোকানদাররা কিনে নেন। পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলনের (পবা) এক প্রতিবেদনে দেখা যায়, সারা দেশে অবৈধ পলিথিন তৈরির কারখানা রয়েছে কমপক্ষে দেড় হাজার। পুরান ঢাকা এবং বুড়িগঙ্গার তীর ঘেঁষেই রয়েছে কমপক্ষে সাত শতাধিক কারখানা।

এদিকে দেশে ২০০২ সালে পলিথিনের ব্যবহার নিষিদ্ধ করা হয়। এ ছাড়া পরিবেশ সংরক্ষণ আইন অনুযায়ী পলিথিনে তৈরি সব ধরনের শপিং ব্যাগ উৎপাদন, আমদানি, বাজারজাতকরণ, বিক্রি ও বিক্রির জন্য প্রদর্শন, মজুদ-বিতরণ নিষিদ্ধ। অথচ প্রশাসনের নাকের ডগায় চালু রয়েছে পলিথিনের উৎপাদন, বিপণন ও ব্যবহার। পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়ের তথ্যানুযায়ী, দেশে বছরে এখন ৮ লাখ ২১ হাজার ২৫০ টন প্লাস্টিক বর্জ্য উৎপন্ন হয়। এর ৪০ শতাংশ রিসাইকেল বা পুনঃব্যবহার হলেও বাকিটা পরিবেশে পড়ে থাকে। সরকারি তথ্যানুযায়ী, সারা দেশের মানুষ বছরে গড়ে মাথাপিছু ৯ থেকে ১০ কেজি প্লাস্টিক বর্জ্য উৎপন্ন করে। রাজধানীতে এর পরিমাণ ১৮ থেকে ২২ কেজি পর্যন্ত।

এ ব্যাপারে বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) নির্বাহী কমিটির সদস্য আমিনুর রসুল বাবুল বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ২০ বছর আগে আইন করে নিষিদ্ধ করা একটা পণ্য কীভাবে প্রকাশ্যে বিক্রি হয়, কীভাবে কারখানা বাড়ে সেটাই মাথায় ধরে না। পুরান ঢাকায় তো বাড়িতে বাড়িতে পলিথিন কারখানা। নিশ্চয়ই এখানে বড় রকমের দুর্নীতি আছে। সবাই এটার ভাগ পায়। আগে তো কাপড়ের ব্যাগ নিয়ে সবাই বাজারে যেত। পলিথিনের সহজলভ্যতায় সেই সংস্কৃতি উঠে গেছে। পলিথিন উৎপাদন বন্ধ করলে আপনা-আপনি বিকল্প চলে আসত। তিনি বলেন, গবেষণায় দেখা গেছে একটি পরিবারের প্রতিটি সদস্য প্রতিদিন গড়ে পাঁচটি পলিথিন ব্যবহার করছে। বিস্কুটের প্যাকেট, চানাচুরের প্যাকেট, চিপসের প্যাকেট, জুসের বোতল সবই এখন প্লাস্টিকের। খাবারটা খেয়ে প্যাকেটটি ছুড়ে ফেলছে যত্রতত্র। বিষয়টা কতটা ভয়ঙ্কর! এখানে হয় বিকল্প পণ্যের ব্যবস্থা করতে হবে, অন্যথায় রিসাইকেলের ব্যবস্থা করতে হবে। দরকারি প্লাস্টিক পণ্য উৎপাদনকারীদের পুনঃব্যবহারে বাধ্য করতে হবে। যেই দূষিত করবে, তাকে তাৎক্ষণিক শাস্তি দিতে হবে।

সর্বশেষ খবর