বুধবার, ২৭ সেপ্টেম্বর, ২০২৩ ০০:০০ টা

মাউশির প্রকল্পে কচ্ছপগতি

হতাশা উত্তরণের চেষ্টা চলছে : মন্ত্রণালয়, আইসিটি প্রকল্পে সরকারের গচ্চা ১৬ কোটি ১৩ লাখ টাকা

আকতারুজ্জামান

মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা (মাউশি) অধিদফতরের কয়েকটি প্রকল্পের অগ্রগতি অত্যন্ত হতাশাজনক। কোনো কোনো প্রকল্প শুরুর সাত বছর পর অগ্রগতি হয়েছে মাত্র ৯ ভাগ। আবার কোনো প্রকল্প চালুর নয় বছর পর মাত্র ১৯ ভাগ অগ্রগতি হয়েছে। শিক্ষার এসব প্রকল্প চলছে কচ্ছপের মতো ধীরগতিতে। সেই সঙ্গে প্রকল্পগুলোয় চলছে অনিয়ম, দুর্নীতি আর সরকারি অর্থ তছরুপ। মাউশির কয়েক প্রকল্প এখন সরকারের গলার কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছে।

শিক্ষা মন্ত্রণালয়ও বলছে, খুবই ধীরগতিতে চলা শিক্ষার এসব প্রকল্পের প্রকৃত অবস্থা হতাশাজনক। তবে কচ্ছপ গতি থেকে বেরিয়ে আসার চেষ্টা চলছে। মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদফতরের আওতায় এডিপিভুক্ত উন্নয়ন প্রকল্পের অগ্রগতি পর্যালোচনা সভা থেকে জানা গেছে মাউশির প্রকল্পগুলোর দুর্দশার চিত্র। গত আগস্টে অনুষ্ঠিত এ সভায় সভাপতিত্ব করেন মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদফতরের মহাপরিচালক অধ্যাপক নেহাল আহমেদ।

তথ্যমতে, ২০১৬ সালের ১ জুলাই শুরু হয় ‘আইসিটির মাধ্যমে মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা স্তরে শিক্ষার প্রচলন (পর্যায় ২)’। প্রকল্পের আশানুরূপ অগ্রগতি না হওয়ায় কয়েক দফা বেড়েছে তার মেয়াদ। সর্বশেষ মেয়াদ অনুযায়ী গত জুনে প্রকল্পের সময়সীমা শেষ হয়েছে। তবু হয়নি অগ্রগতি। এ প্রকল্পে সাত বছরে আর্থিক অগ্রগতি হয়েছে মাত্র ৮ দশমিক ৬৪ শতাংশ। এ প্রকল্প নিয়ে শুধু মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদফতর নয়, শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কর্তাব্যক্তিরাও নাখোশ। প্রকল্পে হতাশাজনক চিত্রের মধ্যে আর্থিক অনিয়ম আর সরকারের অর্থের অপচয়ের প্রমাণও পেয়েছে শিক্ষা অডিট অধিদফতর। গত মাসে তৈর করা শিক্ষা অডিট অধিদফতরের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, প্রশিক্ষণের ক্ষেত্রে প্রতিটি প্রশিক্ষণ কক্ষকে আলাদা ভেন্যু দেখিয়ে অর্থ উত্তোলন করা হয়েছে। এভাবে অনিয়ম করে খরচ দেখানো হয়েছে ৯ কোটি ৩০ লাখ ১৩ হাজার ৫০০ টাকা। খরচ দেখানো চার্জ সরকারি কোষাগারেও জমা করা হয়নি। এ ছাড়া প্রশিক্ষণ ভেন্যুতে ইন্টারনেট সংযোগ না থাকলেও তার বিল দেওয়া হয়েছে। আর কিছু কিছু ভেন্যুতে দেওয়া হয়েছে অতিরিক্ত ইন্টারনেট বিল। অডিট অধিদফতরের নিরীক্ষায় বলা হয়েছে, ভেন্যু চার্জ, ইন্টারনেট বিল, সম্মানি ভাতা, ভ্রমণ ভাতা, সনদপত্র মুদ্রণ, ডুপ্লিকেট ভাউচার তৈরি, পরিবহন ভাড়া, মডেম কেনাসহ নানা কাজে সরকারের ১৬ কোটি ১৩ লাখ ৫৫ হাজার ৮৩৫ টাকা আর্থিক ক্ষতি হয়েছে। নিরীক্ষার সুপারিশে অর্থ অপচয়ের সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে বলা হয়েছে।

এ প্রকল্পের দুর্দশা, অনিয়ম ও অর্থ অপচয়ের অভিযোগ সম্পর্কে জানতে পরিচালক অধ্যাপক ড. মো. মোরশীদুল হাসানের সাক্ষাতের জন্য বেশ কয়েকদিন তার দফতরে গিয়েও পাওয়া যায়নি। গতকাল তাঁকে ফোন করা হলে গণমাধ্যমকর্মীদের সঙ্গে কোনো কথা বলবেন না বলে জানিয়েছেন।

‘ন্যাশনাল একাডেমি ফর অটিজম ও নিউরো ডেভেলপমেন্টাল ডিজঅ্যাবিলিটি’ প্রকল্প শুরু হয়েছিল ২০১৪ সালের ১ জানুয়ারি। চলতি বছরের আগস্ট পর্যন্ত এ প্রকল্পের আর্থিক অগ্রগতি মাত্র ১৯ দশমিক ১৭ শতাংশ। এ প্রকল্পের মেয়াদ নির্ধারিত রয়েছে চলতি বছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত। অথচ ৮০ শতাংশের বেশি কাজ বাকি। চলতি অর্থবছরে এ প্রকল্পে এডিপি বরাদ্দ রয়েছে ৯৭ কোটি ৫৮ লাখ টাকা। প্রকল্প দলিল যথাসময়ে অনুমোদন না হওয়ায় এ প্রকল্পের চলতি অর্থবছরের বরাদ্দ অর্থও ব্যয় করা সম্ভব হবে না বলে জানা গেছে।

‘ঢাকা শহর সন্নিকটবর্তী এলাকায় ১০টি সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয় স্থাপন’ প্রকল্প শুরু হয়েছে ২০১৭ সালের ১ জুলাই। গত ছয় বছরে এ প্রকল্পের অগ্রগতি হয়েছে মাত্র ২৮ দশমিক ৭৭ ভাগ। ইতোমধ্যে এ প্রকল্পের সময় আড়াই বছর বাড়ানো হয়েছে। জানা গেছে, এ প্রকল্পে ছয়টি জমির উন্নয়ন কার্যক্রম সম্পন্ন হয়েছে। এর মধ্যে তিনটি প্রতিষ্ঠানের ভবন নির্মাণের কাজ চলতি বছরে শুরু হবে। বাকি চারটির জমি প্রক্রিয়াকরণের পাশাপাশি ছয়টির নির্মাণকাজ দ্রুততার সঙ্গে এগিয়ে নিতে শিক্ষা প্রকৌশল অধিদফতর ও সংশ্লিষ্ট প্রকল্প পরিচালককে নির্দেশনা দিয়েছেন মাউশির মহাপরিচালক অধ্যাপক নেহাল আহমেদ।

২০১৭ সালের ১ জানুয়ারি শুরু হয় ‘সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের উন্নয়ন প্রকল্প’। চলতি বছরের জুন পর্যন্ত এ প্রকল্পের মেয়াদ নির্ধারিত ছিল। প্রকল্প শুরুর পর ছয় বছর অতিবাহিত হলেও কাজের অগ্রগতি হয়েছে মাত্র ২০ দশমিক ৩৭ শতাংশ। মেয়াদ শেষ হওয়ার পরও প্রকল্প কাজের আশানুরূপ অগ্রগতি না হওয়ায় এর মেয়াদ ফের বাড়ানো হয়েছে।

‘সরকারি কলেজে বিজ্ঞান শিক্ষার সুযোগ প্রকল্প’ শুরু হয়েছিল ২০১৮ সালের ১ জুলাই। আগামী বছরের জুন পর্যন্ত এ প্রকল্পের মেয়াদ নির্ধারিত রয়েছে। প্রকল্পের সময় পাঁচ বছর অতিক্রান্ত হওয়ার পর এর অগ্রগতি হয়েছে মাত্র ২৯ দশমিক ৭০ শতাংশ।

শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের অতিরিক্ত সচিব (পরিকল্পনা) মো. আবদুল মতিন গতকাল প্রতিবেদককে বলেন, ‘মাউশি অধিদফতরের প্রকল্পগুলোর অবস্থা খুবই হতাশাজনক। এতে কোনো সন্দেহ নেই। আমরা বেশকিছু পদক্ষেপ নিয়েছি অবস্থার উন্নয়ন করতে।’ তিনি বলেন, প্রকল্প বাস্তবায়নে সক্ষমতার দুর্বলতা দেশের বিভিন্ন প্রকল্পেই আছে। কিন্তু শিক্ষার প্রকল্পগুলোর অবস্থা বেশি খারাপ। কারণ হিসেবে তিনি বলেন, ‘শিক্ষকরা পাঠদানে দক্ষ, কিন্তু প্রকল্প পরিচালনায় দক্ষতা কিছুটা কম। আমরা চেষ্টা করছি শিক্ষার প্রকল্প পরিচালকদের দক্ষতা উন্নয়নের।’ অতিরিক্ত সচিব বলেন, ‘প্রকল্পগুলো যাতে এই কচ্ছপ গতি থেকে বেরিয়ে আসে সেই চেষ্টা করে যাচ্ছি।’

২০১৮ সালের অক্টোবরে শুরু হয় ‘৯টি সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয় স্থাপন প্রকল্প’। পাঁচ বছরে এ প্রকল্পের অগ্রগতি ৪০ দশমিক ২৪ শতাংশ। এ প্রকল্পের অধীনে আটটি প্রতিষ্ঠানের নির্মাণকাজ চলমান থাকলেও ছয়টির নির্মাণকাজ অত্যন্ত ধীরগতি। এ গতিতে চললে চলতি বছরও আশানুরূপ অগ্রগতি সম্ভব হবে না বলে জানা গেছে। প্রকল্পকাজ পিছিয়ে থাকার কারণ হিসেবে শিক্ষা প্রকৌশল অধিদফতরের কার্যক্রমের ধীরগতিকে দায়ী করা হয়েছে প্রকল্পসংশ্লিষ্টদের পক্ষ থেকে।

২০১০ সালের আগস্টে শুরু হওয়া ‘শিক্ষার মানোন্নয়নের লক্ষ্যে জেলা সদরে অবস্থিত সরকারি পোস্ট গ্র্যাজুয়েট কলেজের উন্নয়ন প্রকল্প’ চলতি বছরের জুন পর্যন্ত অগ্রগতি হয়েছে ৮১. ৪২ শতাংশ। মেয়াদ শেষ হলেও প্রকল্পের কাজ শেষ না হওয়ায় মেয়াদ বৃদ্ধির কার্যক্রম প্রক্রিয়াধীন আছে বলে জানা গেছে।

২০১২ সালের জুলাইয়ে শুরু হয় ‘তথ্যপ্রযুক্তির সহায়তায় শিক্ষার মানোন্নয়নের লক্ষ্যে নির্বাচিত বেসরকারি কলেজের উন্নয়ন প্রকল্প’। ১১ বছর পর এর অগ্রগতি দাঁড়িয়েছে ৭৯.৬৯ শতাংশে। আগামী বছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত প্রকল্পের মেয়াদ নির্ধারিত রয়েছে। নির্ধারিত সময়ে এ প্রকল্প শেষ হবে না বলে সভাসূত্রে জানা গেছে।

‘সেকেন্ডারি এডুকেশন প্রজেক্ট ইনভেস্টমেন্ট প্রোগ্রাম প্রকল্প’ শুরু হয়েছে ২০১৪ সালের ১ জানুয়ারি। নয় বছর পর এর অগ্রগতি দাঁড়িয়েছে ৯২ দশমিক ৪৭ শতাংশে। এ প্রকল্পের যুগ্ম প্রোগ্রাম পরিচালকসূত্রে জানা গেছে, কর্মসূচির জনবল রাজস্ব খাতে স্থানান্তর, বিভিন্ন প্রশিক্ষণ, ভোকেশনাল প্রতিষ্ঠানে ট্রেড শিক্ষক নিয়োগসহ বেশকিছু চ্যালেঞ্জ রয়েছে। অথচ এ কর্মসূচির মাত্র তিন মাস সময় আছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ড. ছিদ্দিকুর রহমান প্রতিবেদককে বলেন, ‘প্রকল্পকাজ যথাসময়ে সম্পন্ন না হওয়ায় শিক্ষার অনেক উন্নয়ন আটকে আছে।’

সর্বশেষ খবর