শনিবার, ৩০ সেপ্টেম্বর, ২০২৩ ০০:০০ টা

ওষুধের বাজারে আগুন

♦ দাম বেড়েছে সব কোম্পানির ওষুধের ♦ সংকটে রোগী, বাড়ছে চিকিৎসা ব্যয়

জয়শ্রী ভাদুড়ী

ওষুধের বাজারে আগুন

নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের বাজারে আগুন। এর মধ্যে বেড়েছে সব কোম্পানির ওষুধের দাম। নিয়মিতই ওষুধের দাম বাড়ানোর প্রস্তাব জমা পড়ছে ঔষধ প্রশাসন অধিদফতরে। ওষুধের দাম বাড়ায় রোগীর চিকিৎসা ব্যয় আরও বাড়ছে। ডলারের মূল্য বৃদ্ধি, আন্তর্জাতিক বাজারে কাঁচামালের দাম বৃদ্ধিকে ওষুধের দাম বাড়ানোর কারণ হিসেবে বলছে ওষুধ শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলো। ঔষধ প্রশাসন অধিদফতরের উপপরিচালক ও আইন কর্মকর্তা মো. নুরুল আলম বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, দেশের ওষুধের বাজারে প্রায় ১ হাজার ৬৫০টি জেনেরিকের ২৫ হাজার-৩০ হাজার প্রোডাক্ট চালু আছে। এর মধ্যে ১১৭টি জেনেরিকের ৪৬০টি ওষুধের দাম ওষুধ প্রশাসন নির্ধারণ করে। অন্যগুলো কোম্পানি খরচ হিসাব করে একটি দাম প্রস্তাব করে। আমরা ভ্যাট সংযোজন করে দাম সমন্বয় করে দেই। কাঁচামালের দাম বাড়ার বিষয় উল্লেখ করে প্রতিটি ওষুধ কোম্পানি অধিকাংশ ওষুধের দাম বাড়িয়ে নিয়েছে। নিয়মিতভাবেই এসব আবেদন ঔষধ প্রশাসনে জমা পড়ে। টেকনিক্যাল কমিটি এবং মূল্য নির্ধারণে উচ্চপর্যায়ের কমিটি এগুলো পর্যালোচনা করে অনুমোদন দেয়। তিনি আরও বলেন, স্যালাইনের দাম বাড়াতে আবেদন করেছিল লিব্রা। আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে সমন্বয় করে দাম নির্ধারণ করেছিল ঔষধ প্রশাসন অধিদফতর। কিন্তু তাদের এ দাম লাভজনক মনে না হওয়ায় হাই কোর্টে রিট করেছে প্রতিষ্ঠানটি।’ রাজধানীর ফার্মেসিগুলোতে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ফেক্সোফেনাডিন প্রতি পিস ৮ টাকা থেকে ৯ টাকা হয়েছে। অ্যাজিথ্রোমাইসিন প্রতি পিস ৩৫ টাকা থেকে ৪০ টাকা হয়েছে। মন্টিলুকাস্ট প্রতি পিস ১৬ টাকা থেকে ১৭ টাকা ৫০ পয়সা হয়েছে। ভিটামিন বি১ বি৬ বি১২ এর প্রতি পিসের দাম ৭ টাকা থেকে দুই ধাপে দাম বাড়িয়ে ১০ টাকা হয়েছে। ইসমিপ্রাজল এর প্রতি পিসের দাম ৫ টাকা থেকে ৭ টাকা হয়েছে। লোসারটান পটাশিয়াম ৫০ মিলিগ্রামের প্রতি পিসের দাম ৮ টাকা থেকে ১০ টাকা করা হয়েছে। প্যারাসিটামল ৫০০ মিলিগ্রামের ১০ পিস ওষুধের দাম ৮ টাকা থেকে ১২ টাকা হয়েছে। প্যারাসিটামল ৬৬৫ মিলিগ্রাম ১০ পিস ওষুধের দাম ১৫ থেকে ২০ টাকা হয়েছে। প্যারাসিটামল সিরাপের দাম হয়েছে ২০ টাকা থেকে ৩৫ টাকা। অ্যামলোডিপাইন অ্যাটিনোলাল ৫ মিলিগ্রামের দাম ৬ টাকা থেকে ৮ টাকা হয়েছে। ব্রোমাজিপাম ৩ মিলিগ্রামের দাম ৫ টাকা থেকে ৭ টাকা হয়েছে। ১০ পিচ কিনতে আগে ৫০ টাকা লাগত এখন থেকে ৭০ টাকা লাগবে। অ্যাসপিরিন ৭৫ মিলিগ্রামের দাম এক পাতায় ১০ পিসের দাম পড়ত ৫ টাকা এখন ৮ টাকা টাকা হয়েছে।

নতুন বাজারের আর কে মেডিকেল হল নামের ফার্মেসিতে ওষুধ কিনতে এসেছিলেন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মী সাইফুল ইসলাম। তিনি বলেন, চাল, ডাল, তেল, সবজি সবকিছুর দাম ঊর্ধ্বমুখী। যে কোনো কিছুর দাম বাড়লে সেটা খাওয়া কমিয়ে দেই। তেলের দাম বাড়ার পর তেল কেনা কমিয়েছি। আমি উচ্চ রক্তচাপে ভুগছি। এটা নিয়ন্ত্রণে চিকিৎসকের পরামর্শে নিয়মিত ওষুধ সেবন করতে হয়। আগে এক পাতা ওষুধ ৮০ টাকায় কিনতাম। এখন সেটা ১০০ টাকায়  কিনতে হচ্ছে। আয় একই থাকছে খরচ বেড়েই চলেছে। বাঁচতে গেলে ওষুধ তো কিনতেই হবে। এ খরচ আমি কীভাবে কমাব?

বাংলাদেশ কেমিস্টস অ্যান্ড ড্রাগিস্ট সমিতির পরিচালক জাকির হোসেন রনি বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘ওষুধ কিনতে এসে ক্রেতারা আমাদের জিজ্ঞাসা করেন দাম কেন বেশি? কিন্তু দাম তো ফার্মেসি মালিকরা বাড়ায়নি, বাড়িয়েছে কোম্পানি। এমআরপি রেট বাড়ালে আমাদের করার কিছুই থাকে না। ওষুধ প্রশাসনের উচিত ওষুধের দাম বাড়ানোর ক্ষেত্রে অন্য সবকিছুর সঙ্গে বাজার ও ভোক্তার কথা মাথায় রাখা।’

স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইউনিটের তথ্য মতে, বর্তমানে বাংলাদেশে চিকিৎসা নিতে গিয়ে ব্যক্তির নিজস্ব ব্যয় ৬৮ দশমিক ৫০ শতাংশ। এর মধ্যে ৬৪ শতাংশ ব্যয় হয় ওষুধে। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের মাইক্রোবায়োলজি বিভাগের অধ্যাপক ও গবেষক ড. মো. আনোয়ার খসরু পারভেজ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘দৈনন্দিন জীবনযাপনের জন্য অপরিহার্য নিত্যপণ্যের ঊর্ধ্বগতির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে হুহু করে বাড়ছে জরুরি প্রয়োজনীয় ওষুধের দাম। এই দৌড়ে পেরে উঠছে না মানুষ। দেশের শীর্ষ ছয় প্রতিষ্ঠান তাদের উৎপাদিত ২৩৪টি জীবন রক্ষাকারী ওষুধের দাম ১০ থেকে ৫০ শতাংশ পর্যন্ত বাড়িয়েছে। অভিযোগ রয়েছে, নির্ধারিত দরের চেয়ে বাজারে অনেক ওষুধ বেশি দামেও কেনাবেচা চলছে। এক্ষেত্রেও দাম বাড়ানোর অজুহাত হিসেবে কোম্পানিগুলো বলেছে, করোনা মহামারি, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ, বিশ্ববাজারে কাঁচামালের দাম বৃদ্ধি, ডলার সংকট, এলসি জটিলতা, গ্যাস-বিদ্যুতের দাম বাড়ানোসহ সরবরাহ সমস্যা, মোড়ক, পরিবহন, বিপণন ব্যয় বৃদ্ধি ইত্যাদি।’

তিনি আরও বলেন, ‘আকস্মিক দাম বাড়ালে অনেক রোগী ওষুধ কিনতে পারবে না। আর ডোজ সম্পূর্ণ না করলে শরীরে মারাত্মক প্রভাব ফেলতে পারে। দাম নিয়ন্ত্রণে ঔষধ প্রশাসনের কোনো উদ্যোগ নেই। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তালিকা ধরে দেশে অত্যাবশ্যকীয় ওষুধের তালিকা বড় করা উচিত। যেটির মূল্য নিয়ন্ত্রণে সরকারকে নজরদারি বাড়াতে হবে। বাকিগুলো বিক্রিতে নীতিমালা অনুসরণে বাধ্য করতে হবে। সব ওষুধের দর সরকার নির্ধারিত ফর্মুলার ভিত্তিতে নির্ধারণ করা প্রয়োজন।’

ওষুধ শিল্প সমিতির মহাসচিব এস এম শফিউজ্জামান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, আগে ওষুধের কাঁচামাল আমদানির জন্য এলসি খুলতে ডলারের দাম পড়ত ৮০ টাকা। এখন ডলারের দাম পৌঁছেছে ১২০ টাকায়। প্রাইস পলিসি মোতাবেক প্রত্যেক বছরের বাজারের আর্থিক অবস্থা যাচাই করে এমআরপি পণ্যের দাম নির্ধারণ করার কথা। কিন্তু ২০ বছরেও তা করা হয়নি। প্যারাসিটামল শিশুরা খায় তাই এতদিন আর্থিক ক্ষতি হলেও উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলো আপত্তি করেনি। আন্তর্জাতিক বাজারে কাঁচামালের দামও চড়া। এখন কিছু ওষুধের দাম না বাড়ালে প্রতিষ্ঠানের টিকে থাকা মুশকিল। এর পরিপ্রেক্ষিতে এমআরপি প্রোডাক্টের কিছু দাম বেড়েছে।’

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর