রবিবার, ১ অক্টোবর, ২০২৩ ০০:০০ টা
বিশ্ব প্রবীণ দিবস আজ

বয়স নয় কষ্ট একাকিত্বের

জিন্নাতুন নূর

বয়স নয় কষ্ট একাকিত্বের

রাজধানীর কাজীপাড়ার অ্যাপার্টমেন্ট হাউসে ফ্ল্যাটে থাকেন ষাটোর্ধ্ব দম্পতি ফয়সাল আহমেদ ও আমেনা বেগম। তাদের দুই সন্তানই পরিবার নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে। দু-তিন বছর পর দেশে মা-বাবার কাছে আসেন তারা। এ দম্পতির দেখাশোনার জন্য বাড়িতে লোক আছে। কোনো স্বজন তাদের কাছে খুব একটা আসেন না। দম্পতির থাকা-খাওয়ার কষ্ট নেই। কষ্ট শুধু একাকিত্বের। বাংলাদেশ প্রতিদিনকে ফয়সাল আহমেদ বলেন, ‘আমার কিছু হয়ে গেলে আমেনা একা হয়ে পড়বে। তখন ওর খুব কষ্ট হবে। আমরা ভিডিওকলে সন্তান ও নাতি-নাতনিদের সঙ্গে কথা বললেও সব সময় নিজেদের বড় একা লাগে।’ রংপুরের এক সরকারি কর্মকর্তা শরিফুল হক তাঁর জীবনের সব সঞ্চয় একমাত্র ছেলের বড় হওয়ার পেছনে খরচ করেছেন। এসএসসির পর ভালো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তির জন্য ছেলেকে ঢাকায় পাঠান। এরপর দেশের বাইরে পাঠানোর জন্য অবসরগ্রহণকালে এককালীন যে ভাতা পেয়েছেন তার পুরোটাই খরচ করেন। সেই ছেলে বাবার মৃত্যুর পর দাফন করতে দেশে আসেননি। বাড়িতে এখন শরিফুলের অসুস্থ স্ত্রী একা। এই মা তাঁর ছেলেকে দেখতে চান কিন্তু ছেলের আর দেশে ফেরার সম্ভাবনা নেই। ছেলেকে ছাড়াই মৃত্যুর প্রহর গুনছেন শরিফুলের স্ত্রী। চৌহালি উপজেলার দুর্গম উমারপুর ইউনিয়নের হাপানিয়া গ্রামের বাসিন্দা হামিদ মোল্লা (৮৬) ও তার স্ত্রী ফজিলা খাতুনকে (৭৭) তাদের পাঁচ ছেলে ভাগাভাগি করে ভরণপোষণ করে আসছিলেন। চলতি বছরের আগস্টের কথা। চৌহালি উপজেলার সম্ভুদিয়া জান্নাতুল বাকি কবরস্থানের পাশে বাকরুদ্ধ হয়ে বসে ছিলেন এ বৃদ্ধ দম্পতি। কারণ তাঁদের সন্তানরা আর ভরণপোষণ দিতে চান না। তাঁদের আত্মীয়ের কাছে পাঠিয়ে দেন। শেষে আত্মীয়ের বাড়িতেও তাঁদের ঠাঁই হয় না। হাড়ভাঙা পরিশ্রম করে সন্তানদের বড় করেছেন তাঁরা। বৃদ্ধকালে সন্তানদের সঙ্গে আরাম-আয়েশে দিনাতিপাত করবেন এমন স্বপ্নই ছিল হামিদ-ফজিলার। যমুনা নদীর ভাঙনে বসতভিটা হারিয়ে এ বৃদ্ধ দম্পতির সন্তানরা সুবিধামতো জায়গায় চলে গেলেও মা-বাবার ঠাঁই হলো না পাঁচ ছেলের সংসারে। এজন্য তাঁদের নির্জন কবরস্থানের পাশের সড়কে ফেলে রেখে যান স্বজনরা। পাঁচ সন্তান থাকার পরও শেষ বয়সে কেউ তাঁদের দায়িত্ব নিতে আগ্রহী নয়। তাঁদের একা রেখে সবাই যার যার জীবনে ব্যস্ত।

বর্তমানে উন্নত জীবনের খোঁজে দেশের উচ্চবিত্ত ও মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তানরা বিদেশে পাড়ি জমাচ্ছেন। আবার গ্রাম থেকেও অনেকে জীবিকার সন্ধানে বড় বড় শহরে এসে থাকছেন। এ সন্তানদের বেশির ভাগেরই বিয়ের পর আর স্থায়ীভাবে মা-বাবার কাছে ফেরা হয় না। ফলে জীবনের শেষভাগে এসে তাদের মা-বাবাকে একাকিত্বের কষ্ট সয়ে ধীরে ধীরে মৃত্যুর অপেক্ষা করতে হয়। সন্তানদের অনেকে শেষ বয়সে এসে মা-বাবাকে নিজের কাছে এনে রাখতে চাইলেও নতুন পরিবেশে ও নিজের কষ্টের গড়া বাড়ি-জমি ছেড়ে অভিভাবকরা অন্যত্র যেতে চান না। শেষ বয়সে মোবাইল ও ইন্টারনেটে সন্তান, নাতি-নাতনির মুখ দেখে নিঃসঙ্গ সময় কাটে তাদের। এ অবস্থায় আজ পালিত হবে ৩৩তম আন্তর্জাতিক প্রবীণ দিবস। এবার দিবসটির প্রতিপাদ্য ‘সর্বজনীন মানবাধিকার ঘোষণায় প্রবীণদের জন্য প্রদত্ত প্রতিশ্রুতি পূরণে প্রজন্মের ভূমিকা।’

তথ্য বলছে, দেশে বয়স্ক মানুষের সংখ্যা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাংলাদেশ ২০৪৭ সাল নাগাদ ‘ওল্ড সোসাইটি’তে পরিণত হবে। চিকিৎসাসেবা উন্নত হওয়ায় বিশ্বের উন্নত দেশগুলোর মতো বাংলাদেশেও বয়স্ক মানুষ এখন দীর্ঘদিন বেঁচে থাকছেন। ২০২২-এর জনশুমারি ও গৃহগণনা প্রতিবেদন অনুযায়ী, দেশে ৬০ বছরের বেশি বয়সী মানুষের সংখ্যা ১ কোটি ৫৩ লাখ ২৬ হাজার ৭১৯। আর তাঁরা মোট জনসংখ্যার ৯ দশমিক ২২ শতাংশ। অর্থাৎ বয়স্ক জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার বেশি। আবার বয়স বাড়ার সঙ্গে মানুষের একাকিত্ব ও অসহায়ত্বও বৃদ্ধি পাচ্ছে। তবে বয়স্ক পুরুষের তুলনায় নারী বেশি নির্যাতন ও বঞ্চনার শিকার হচ্ছেন। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে স্বামী মারা যাওয়ার পর একজন বিধবা তাঁর স্বামীর রেখে যাওয়া সম্পত্তি দিয়ে কষ্ট করে সংসার ধরে রাখার ও সন্তানদের মানুষ করার চেষ্টা করেন। কিন্তু সন্তানরা বড় হওয়ার পর দৃশ্য বদলাতে থাকে। যেসব মায়ের হাতে জমানো টাকা থাকে না তাঁরা নিজেদের পরিশ্রম দিয়ে সন্তানের সংসারে টিকে থাকার চেষ্টা করেন। গ্রামের অনেক নারীর স্বামী মারা গেলে বা অসুস্থ হলে পরিবারের আশ্রয়ও চলে যায়। আশঙ্কার বিষয় হচ্ছে, বার্ধক্য নিয়ে মানুষের নিজেদের মধ্যে যেমন কোনো প্রস্তুতি নেই। একইভাবে বয়স্কদের বিভিন্ন সুযোগসুবিধা নিশ্চিতে নেই কোনো প্রাতিষ্ঠানিক উদ্যোগ। শহর বা গ্রামে যৌথ পরিবার ভেঙে একক পরিবার তৈরি হওয়ায় এখন বয়স্কদের উল্লেখযোগ্য অংশ শেষ বয়সে এসে প্রবীণ নিবাসে থাকতে বাধ্য হচ্ছেন। দেশে হাতেগোনা কিছু প্রবীণ নিবাস থাকলেও এর সুযোগসুবিধা নিয়ে প্রশ্ন আছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পপুলেশন সায়েন্সেস বিভাগের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ মঈনুল ইসলাম বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘সামাজিক নিরাপত্তার আওতায় বয়স্করা যে ভাতা পাচ্ছেন তা অপর্যাপ্ত। আবার যে বয়স্ক ব্যক্তিরা দরিদ্র, নিঃসন্তান তারাও সুবিধাজনক অবস্থায় নেই। এজন্য সামাজিক নিরাপত্তার আওতা বৃদ্ধি করতে হবে। দেশে নারী ও পুরুষের মধ্যে বয়সের পার্থক্য আছে। এটি দূর করতে হবে। আবার বিভিন্ন সামাজিক নিরাপত্তার আওতাধীন সুযোগসুবিধা পেতে যে প্রতিবন্ধকতা আছে তা দূর করতে হবে। এজন্য স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের সহায়তা নিতে হবে। সংশ্লিষ্ট নীতিমালায় দেশের হাসপাতালগুলোয় জেরিএটট্রিক্স (বার্ধক্যবিদ্যা) থাকার কথা থাকলেও বাস্তবে নেই। বয়স্করা যাতে সুলভে এ চিকিৎসা নিতে পারেন তা-ও নিশ্চিত করতে হবে। একক পরিবারগুলোয় সন্তানদের মা-বাবার প্রতি দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করতে হবে। বেসরকারিভাবে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে বয়স্ক জনগোষ্ঠীর স্বাস্থ্যসহ অন্য সেবা নিশ্চিত করার ব্যাপারে এগিয়ে আসতে হবে। বয়স্কদের জন্য আন্তরিকতা বৃদ্ধিতে সামাজিকীকরণের মধ্যে পরিবর্তন আনতে হবে।’

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর