শিরোনাম
রবিবার, ১ অক্টোবর, ২০২৩ ০০:০০ টা

আট বছর পর আরিফের হত্যা রহস্য উদঘাটন

নিজস্ব প্রতিবেদক

হত্যাকাণ্ডের আট বছর পর পিবিআই গাজীপুর জেলার তদন্তে উঠে এসেছে আরিফ হত্যার রোমহর্ষক কাহিনি। আরিফ স্ক্যানডেক্স টেক্সটাইল ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডের ফ্যাক্টরিতে ডাইং কিউসি পদে চাকরি করতেন। গাজীপুরের কালিয়াকৈর থানার উত্তর গজারিয়া এলাকায় ওই ফ্যাক্টরি অবস্থিত। সে ভাড়া থাকত ওসমানের বাড়িতে। বাড়িওয়ালি ছিল অনেক সুন্দরী। আরিফ জড়িয়ে পড়ে পরকীয়ায়। তার গ্রামের বাড়ি পাবনার চাটমোহর উপজেলার কুয়াবাসীতে। আরিফের স্ত্রী লিজা খাতুন তাদের সন্তান সাব্বিরকে নিয়ে থাকত পাবনা শহরে। এদিকে পাবনার আরিফের কিছু জমি নিয়ে শহীদ সরকার ওরফে শহিদুল্লাহ ও মো. রাজন সরকার ওরফে রাশেদের ঝামেলা ছিল। কিন্তু সে কথা জানত না ওসমান। সে আরিফকে পরকীয়া থেকে নিবৃত্ত করার জন্য যেই বন্ধুদের কাছে বিচার দেয়, সেখানে ছিল শহীদ ও রাশেদ। তারা সালিশ করার নামে হত্যার পরিকল্পনা সাজায়। পিবিআই তদন্তে জানতে পারে, এই হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে ১০ জনের সম্পৃক্ততার কথা জানতে পারে। এদের মধ্যে শহীদ, সাইদুর, শরীফ, মোমিরুল ও সোহেলকে গ্রেফতার করেছে পিবিআই। এ ছাড়া হত্যার সঙ্গে জড়িত ওসমান, রিপন, রাজন, হারুন ও মাসুদ পলাতক রয়েছে।

গ্রেফতার সোহেল জিজ্ঞাসাবাদে জানিয়েছে, সে ড্রিম হাউস রিহ্যান্ড সেন্টারে কেয়ারটেকার পদে চাকরি করতেন। ওসমানের সঙ্গে চলাফেরা করতেন। ওসমান সব সময় হেরোইন খেত। সেও তার সঙ্গে নেশা করত। ওসমানের বউ অনেক সুন্দরী ছিল। তবে তার চরিত্র ভালো ছিল না। আরিফ নামে এক ভাড়াটিয়ার সঙ্গে তার অবৈধ সম্পর্ক ছিল। এ বিষয়ে ওসমান সব সময় তাকে বলত। একদিন সন্ধ্যার পর ওসমান তাকে নিয়ে জারা ফ্যাক্টরির সামনে যায়। সেখানে রিপন ও শাহীনের কাছে ওসমান বিচার দেয়। তারা ওসমানের বিষয়টি দেখবে বলে জানায়। পরের দিন সন্ধ্যার পর গাজীপুরের জয়দেবপুরের জারা কম্পোজিট টেক্সটাইলের সামনে সোহেলকে নিয়ে যায় ওসমান। সেখানে রিপন, শহীদ, হারুন, শাহীন, মোমিরুল, শরীফ, রাজন ও মাসুদ আড্ডা দিচ্ছিলেন। এদের মধ্যে শহীদ ও রাজনের সঙ্গে জায়গা নিয়ে আরিফের সঙ্গে আগে থেকেই ঝামেলা চলছিল। তখন রিপন বিষয়টা ফয়সালা করতে লোকজনের মাধ্যমে আরিফকে ঝুট দেওয়ার কথা বলে জারা ফ্যাক্টরিতে ডেকে নিয়ে আসে। আরিফ এলে রিপন তার কাছ থেকে ঝুট বাবদ ৫০ হাজার টাকা নেয়। এরপর রিপন ও শাহীন বলেন, আরিফকে জারা ফ্যাক্টরির পেছনে নিয়ে একেবারে ফালাইয়া দাও। পরে আমরা সবাই মিলে আরিফকে ঝুট দেওয়ার কথা বলে জারা ফ্যাক্টরির পিছনে নিয়ে যাই। আমরা সবাই কিল-ঘুষি মেরে তাকে মাটিতে ফেলে দেই। শরীফ আরিফের দুই পা চেপে ধরে, ওসমান তার মাথা চেপে ধরে, রাজন কোমর থেকে ছুরি বের করে আরিফের গলায় পোচ দেয়। তারপর ওসমান নিজেই রাজনের কাছ থেকে ছুরি নিয়ে আরিফের অণ্ডকোষ কেটে ফেলে এবং বলে ‘এবার আমার বউরে লাগাইছ’। কিছুক্ষণের মধ্যেই আরিফ মারা যায়। সাইদুর জিজ্ঞাসাবাদে জানায়, ফ্যাক্টরির পেছনে নিয়ে ওরা আরিফকে মেরে ফেলবে এটা সে জানত না। সে ভেবেছিল, যেহেতু আরিফ পরকীয়া করে তাই একটু ধমক বা চড় থাপ্পড় দিয়ে ছেড়ে দেবে। কিন্তু রাজন আর সোহেল তাকে মেরে ফেলবে এটা ভাবিনি। পিবিআই গাজীপুর জেলার পুলিশ সুপার (এসপি) মোহাম্মদ মাকছুদের রহমান বলেন, ২০১৯ সালের ৩০ জুন আদালতের নির্দেশে মামলার তদন্তভার পায় পিবিআই গাজীপুর জেলা। ১১ জুলাই মামলার তদন্ত দায়িত্ব দেওয়া হয় গাজীপুর জেলার এসআই মো. সুমন মিয়াকে। তার তদন্ত অনুযায়ী ২০২০ সালের ২৪ ডিসেম্বর প্রথমে শহীদকে গ্রেফতার করা হয়। এরপর একে একে সাইদুর, শরীফ, মোমিরুল ও সোহেলকে গ্রেফতার করেন। বাদীর অভিযোগ, সাক্ষীদের জবানবন্দি, আসামিদের স্বীকারোক্তি, নিহত আরিফের সুরতহাল ও ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন পর্যালোচনা এবং ঘটনার পারিপার্শ্বিকতা পর্যালোচনা করে ঘটনার সঙ্গে জড়িত ১০ জনের বিষয়ে তথ্য পাওয়া গেছে। এদের মধ্যে পাঁচজনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। বাকি পাঁচজন পলাতক রয়েছে।

আরিফ হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় সাইদুর ও সোহেল হত্যার দায় স্বীকার করে আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। এ ছাড়া সন্দেজভাজন হিসেবে গ্রেফতার সেলিমের জড়িত থাকার প্রমাণ পাওয়া যায়নি। ২০২৩ সালের ১৬ এপ্রিল আদালতে চূড়ান্ত রিপোর্ট প্রদান করেছি। ২০১৫ সালের ২৬ ডিসেম্বর হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়। মামলার নথিপত্র ঘেঁটে জানা গেছে, ২০১৫ সালের ২৪ ডিসেম্বর বেলা ২টার দিকে আরিফের সঙ্গে তার স্ত্রী লিজার শেষ কথা হয়। ২৬ ডিসেম্বর জয়দেবপুর থানার সুরাবাড়ী এলাকার কালী দত্তেন বাঁশ বাগান থেকে গলা কাটা একজন পুরুষের লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। সেটা আরিফের লাশ বলে শনাক্ত করে তার পরিবার। এ ঘটনায় ওইদিনই অজ্ঞাত আসামি করে জয়দেবপুর থানায় মামলা করে নিহতের ভাই মনিরুল ইসলাম। মামলাটি তদন্তের পরপর তিনজন বদলি হওয়ার পর জয়দেবপুর থানার এসআই মো. হারুন-অর-রশিদ ঘটনার সঙ্গে জড়িত সন্দেহভাজন হিসেবে মো. সেলিমকে গ্রেফতার করে। কিন্তু হত্যার রহস্য উদঘাটন করতে পারেননি। এরই মধ্যে তিনিও বদলি হয়ে অন্যত্র চলে যান। পরবর্তীতে মামলার তদন্ত দেওয়া হয় আগের তদন্ত কর্মকর্তা এসআই মো. সাইফুল ইসলামকে। তার তদন্তের মধ্যেই ২০১৮ সালের ১৬ ডিসেম্বর গাজীপুর মেট্রোপলিটন পুলিশের যাত্রা শুরু হয়। তখন মামলাটি চলে যায় কাশিমপুর থানায়। এ সময় তদন্তের দায়িত্ব পায় কাশিমপুর থানার পরিদর্শক (তদন্ত) মো. রফিকুল ইসলাম। তিনি খুনিদের সন্ধান না পেয়ে ২০১৯ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি আদালতে চূড়ান্ত রিপোর্ট দাখিল করেন।

সর্বশেষ খবর