বুধবার, ৪ অক্টোবর, ২০২৩ ০০:০০ টা

ডেঙ্গুর থাবা বছরজুড়ে

প্রতিদিন আড়াই হাজারের বেশি আক্রান্ত হচ্ছে - দীর্ঘ হচ্ছে ডেঙ্গুর মৌসুম

জয়শ্রী ভাদুড়ী

ডেঙ্গুর থাবা বছরজুড়ে

এ বছর দেশে ডেঙ্গুজ্বরে আক্রান্ত ও মৃত্যু অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে। এর মধ্যে হাজার ছাড়িয়েছে মৃত্যু, আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে ২ লাখের বেশি মানুষ। জুন থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ডেঙ্গুর মৌসুম। কিন্তু অক্টোবরেও লাগামহীন ডেঙ্গু। বছরজুড়েই ডেঙ্গুর প্রকোপ থাকবে বলে শঙ্কা সংশ্লিষ্টদের। 

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক কীটতত্ত্ববিদ ড. কবিরুল বাশার বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, বাংলাদেশের ডেঙ্গু ইতিহাসের রেকর্ড ভেঙে আক্রান্ত এবং মৃত্যুর সংখ্যা সর্বোচ্চ স্থানে পৌঁছাল। দেশে ২০০০ সালে ডেঙ্গু চিহ্নিত হওয়ার পর থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত মোট প্রায় ৮৫৩ মানুষের মৃত্যু হয়েছিল আর এ বছর অক্টোবর মাস শুরু পর্যন্ত দুর্ভাগ্যজনকভাবে মৃত্যু হয়েছে হাজারের অধিক। সরকারি হিসাবের তুলনায় আক্রান্তের সংখ্যা আরও অনেক বেশি। বছরের শুরু থেকে বিভিন্ন গণমাধ্যমে নানাভাবে আমি সতর্কবার্তা দিয়েছি। ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণের রূপরেখাও বিস্তারিতভাবে বর্ণনা করেছি। কিন্তু তার বাস্তবায়ন দেখতে পাইনি। ঢাকা শহর ছাড়িয়ে ডেঙ্গু এখন দেশের ৬৪ জেলা শহরে তার শক্ত অবস্থান তৈরি করেছে। গ্রামাঞ্চলে ছড়িয়েছে ডেঙ্গু। আমার মাঠপর্যায়ের গবেষণা ফলাফল বলছে, ডেঙ্গু নিয়েই বসবাস করতে হবে আমাদের। যতদিন পর্যন্ত ডেঙ্গু ভ্যাকসিন সবার মধ্যে আমরা দিতে না পারব ততদিন ডেঙ্গু থেকে মুক্তি মেলা কঠিন। বৃষ্টিপাত, তাপমাত্রা, আর্দ্রতা ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা ও মাঠপর্যায়ে এডিস মশার ঘনত্ব পর্যালোচনা করে কম্পিউটার সিমুলেশনের মাধ্যমে আমরা যে ফোরকাস্টিং মডেল তৈরি করি সেখানে দেখা যাচ্ছে, অক্টোবর মাসে ডেঙ্গুর প্রকোপ খুব বেশি কমে আসবে না। ঢাকা শহরে কিছুটা কমতে থাকলেও বাংলাদেশের অন্যান্য জেলায় এর প্রকোপ অক্টোবরজুড়েই থাকবে।’ স্বাস্থ্য অধিদফতর জানান, গতকাল সারা দেশে ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ২ হাজার ৭৯৯ জন, মারা গেছেন ১৩ জন। ঢাকার হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ৬৮২ জন, ঢাকার বাইরের হাসপাতালে ২ হাজার ১১৭ জন। সরকারি হিসেবে ঢাকার হাসপাতালে এ পর্যন্ত ভর্তি হয়েছেন ৮৫ হাজার ১৪০ জন। ঢাকার বাইরের হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ১ লাখ ২৬ হাজার ৫৪৩ জন। বর্তমানে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আছেন ৯ হাজার ১৯৮ জন। ঢাকার বাইরে আক্রান্ত আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে। ড. কবিরুল বাশার আরও বলেন, ‘স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের অঙ্গপ্রতিষ্ঠানগুলোকে (ইউনিয়ন, উপজেলা, জেলা পরিষদ ও পৌরসভা) মশা নিয়ন্ত্রণের জন্য যুগোপযোগী করে তৈরি করতে হবে। তাদের ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে প্রশিক্ষণ কীটনাশক এবং কীটনাশক প্রয়োগের ফগিং মেশিন এবং ¯েপ্র মেশিন সরবরাহ করতে হবে। ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে নিয়মিত কার্যক্রম পরিচালনার জন্য স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের মাঠ প্রশাসনকে নির্দেশ দিতে হবে। বৃষ্টি পুরোপুরি থেমে গেলে ডেঙ্গুর প্রকোপ কমে আসবে। তবে বাংলাদেশে ডেঙ্গু এখন সারা বছর থাকবে। যেসব পাত্রে বৃষ্টি ছাড়াও পানি জমা হয় অথবা নাগরিকরা পানি জমিয়ে রাখেন সেসব পাত্রে সারা বছরই এডিস মশার প্রজনন হবে। ডেঙ্গু থেকে মুক্তি পেতে সবাইকে নিশ্চিত করতে হবে যেন নিজ বাড়ি এবং বাড়ির আঙিনায় কোনো পানি জমা না থাকে।’ স্বাস্থ্য অধিদফতরের এডিস মশার মৌসুম জরিপের তথ্যমতে, ঢাকা উত্তর সিটির ২৩ দশমিক ৫২ শতাংশ এবং দক্ষিণ সিটির ১৮ দশমিক ৯০ শতাংশ বাড়িতেই এডিস মশার লার্ভা পাওয়া গেছে। উত্তর সিটির ৭৫ শতাংশ এলাকায় এডিস মশার লার্ভার ঘনত্ব ২০ শতাংশের বেশি। এমন কোনো ওয়ার্ড খুঁজে পাওয়া যায়নি যেখানে এডিস মশার লার্ভা নেই। উত্তর সিটিতে এডিসের লার্ভার গড় ঘনত্ব (ব্রুটো ইনডেক্স) ২৮ দশমিক ৯১ শতাংশ। সবচেয়ে বেশি ৬০ শতাংশ ঘনত্ব পাওয়া গেছে ২৪ নম্বর ওয়ার্ডে। লার্ভার দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ৪৮ দশমিক ৮৯ শতাংশ ঘনত্ব পাওয়া গেছে ৬ নম্বর ওয়ার্ডে। দক্ষিণ সিটিতে এডিস মশার লার্ভার গড় ঘনত্ব (ব্রুটো ইনডেক্স) ২৫ দশমিক ২৯ শতাংশ। লার্ভার সর্বোচ্চ ঘনত্ব পাওয়া গেছে ১৯ নম্বর ওয়ার্ডে ৭৩ দশমিক ৩৩ শতাংশ। ২০ নম্বর ওয়ার্ডে এ হার ৭০ শতাংশ। উত্তর সিটির মতো এখানে লার্ভা নেই, এমন কোনো ওয়ার্ড পাওয়া যায়নি। ঢাকার বাইরে সারা দেশের ডেঙ্গু পরিস্থিতিও নাজুক। গত জুলাই ও আগস্টে গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জ, রাজশাহী, যশোর, পিরোজপুর ও পটুয়াখালীর কয়েকটি এলাকায় জরিপ চালায় স্বাস্থ্য অধিদফতর।

 তাতে সবগুলো এলাকাতেই মশার ঝুঁকিপূর্ণ উপস্থিতি পাওয়া গেছে। স্বাস্থ্য অধিদফতরের পরিচালক (রোগনিয়ন্ত্রণ) অধ্যাপক ডা. নাজমুল ইসলাম বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, দেশে ডেঙ্গুর এমন ভয়াবহ পরিস্থিতির মধ্যেও উল্লেখযোগ্য সচেতনতা দেখা যাচ্ছে না। অবস্থার উন্নতি করতে হলে পাড়া-মহল্লায় এডিস নির্মূল কমিটি করতে হবে। মশা নিয়ন্ত্রণে আনতে না পারলে রোগী কমবে না।’

সর্বশেষ খবর