বৃহস্পতিবার, ৫ অক্টোবর, ২০২৩ ০০:০০ টা
বিশ্ব শিক্ষক দিবস আজ

ভালো নেই মানুষ গড়ার কারিগররা

আকতারুজ্জামান

ভালো নেই মানুষ গড়ার কারিগররা

ভালো নেই মানুষ গড়ার কারিগর শিক্ষকরা। স্বতন্ত্র বেতন কাঠামো না থাকা, সরকারি-বেসরকারি শিক্ষকের মধ্যে বৈষম্য, প্রাপ্যতা থাকা সত্ত্বেও পদোন্নতি না পাওয়া ছাড়াও অনেক সমস্যায় জর্জরিত শিক্ষকরা। কয়েক হাজার বেসরকারি বিদ্যালয়ের শিক্ষক কোনো বেতনই পান না সরকার থেকে। একই অবস্থা নন এমপিও শিক্ষকদেরও। সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা এখনো বিবেচিত হন তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারী হিসেবে। সব মিলে শিক্ষকরা দিন কাটাচ্ছেন অনেকটা অস্বস্তির মধ্য দিয়ে। এমন পরিস্থিতির মধ্যেই বিশ্ব শিক্ষক দিবস পালিত হচ্ছে আজ। এর আগে নানা সময় শিক্ষক দিবস আয়োজন করা হলেও এবারই দিবসটি শ্রেণিভুক্ত হিসেবে পালন করবে সরকার।  বিশ্ব শিক্ষক দিবস মন্ত্রিসভায় ‘খ’ শ্রেণিভুক্ত করা হয়েছে। দিবসটি উপলক্ষ্যে রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বানী দিয়েছেন। বানীতে রাষ্ট্রপতি বলেন, আদর্শ জাতি গঠনের মহান কারিগর শিক্ষকগণ সবর্দা জ্ঞান ও প্রজ্ঞার আলোকবর্তী হিসাবে নিবেদিত প্রাণ। শিক্ষরা সমাজের বাতিঘর এবং সুনাগরিক গড়ার প্রধান প্রকৌশলী। প্রধানমন্ত্রী তার  বানীতে বলেন, শিক্ষার মূল চালিকা শক্তি হলো শিক্ষক। শিক্ষকতা একটি মহান পেশা। ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনে আয়োজিত এ শিক্ষক দিবসে প্রধান অতিথি থাকবেন রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করবেন শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি। বিশেষ অতিথি থাকবেন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রী, প্রাথমিক ও গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রী এবং শিক্ষা উপমন্ত্রী। এবারের শিক্ষক দিবসের প্রতিপাদ্য, ‘কাক্সিক্ষত শিক্ষার জন্য শিক্ষক : শিক্ষকস্বল্পতা পূরণে বৈশ্বিক অপরিহার্যতা’। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা ছাত্রছাত্রীদের শিক্ষার ভিত তৈরি করে দেন। কিন্তু বেতন আর মর্যাদার প্রশ্নে সব থেকে পিছিয়ে আছেন তারা। বাংলাদেশ প্রাথমিক বিদ্যালয় সহকারী শিক্ষক সমিতির সভাপতি মোহাম্মদ শামছুদ্দীন মাসুদ গতকাল প্রতিবেদককে বলেন, ‘সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষকরা তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারীর পদমর্যাদা পান, যা খুব দুঃখজনক।’ তিনি বলেন, ‘সহকারী শিক্ষকের মধ্যে ১০ শতাংশও পদোন্নতি পান না। একজন সহকারী শিক্ষক ৩৫-৩৬ বছর চাকরি করে সহকারী শিক্ষক হিসেবেই অবসরে যান, যা খুব লজ্জার।’ প্রাথমিকের এই শিক্ষক নেতা বলেন, ‘প্রাথমিকের সহকারী শিক্ষকদের দ্বিতীয় শ্রেণির পদমর্যাদার পাশাপাশি সম্মানজনক বেতন স্কেল ও শতভাগ পদোন্নতি দিতে হবে।’ দেশের সিংহভাগ মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান (স্কুল, কলেজ, মাদরাসা) নিয়ন্ত্রিত হয় বেসরকারি মাধ্যমে। বেসরকারি মাধ্যমের অনেক শিক্ষক এখনো এমপিওভুক্ত নন, অর্থাৎ সরকারের বেতনের বাইরেই থেকে গেছেন। যাঁরা এমপিওভুক্ত আছেন তাঁদেরও দেওয়া হয় যৎসামান্য বাড়ি ভাড়া আর চিকিৎসা ভাতা। একই কারিকুলামে পাঠদান, একাডেমিক কার্যক্রমে অংশ নিলেও বেসরকারি শিক্ষক আর সরকারি শিক্ষকের মধ্যে পার্থক্য রয়েছে অনেক। বেসরকারি শিক্ষকরা বলছেন, যে বেতন-ভাতা বেসরকারি শিক্ষক-কর্মচারীদের দেওয়া হয় তা দিয়ে বর্তমান দুর্মূল্যের বাজারে টিকে থাকাই অসম্ভব হয়ে দাঁড়িয়েছে। বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতির (বিটিএ) সাধারণ সম্পাদক শেখ কাওছার আহমেদ সম্প্রতি প্রতিবেদককে বলেন, ‘সরকারি আর বেসরকারি এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের মধ্যে বেতন ও মর্যাদায় পার্থক্য অনেক। এমপিওভুক্ত বেসরকারি শিক্ষকরা মাত্র ২৫ শতাংশ উৎসব ভাতা, ১ হাজার টাকা বাড়ি ভাড়া এবং মাত্র ৫০০ টাকা চিকিৎসা ভাতা পান। একই কারিকুলামের অধীন একই সিলেবাস, একই একাডেমিক সময়সূচিতে শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করলেও আর্থিক সুবিধার ক্ষেত্রে সরকারি ও বেসরকারি শিক্ষক-কর্মচারীদের মধ্যে রয়েছে পাহাড়সম বৈষম্য। তা ছাড়া বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানপ্রধানের বেতন স্কেল সরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানপ্রধানের বেতন স্কেলের এক ধাপ নিচে প্রদান করা হয়। এসব কারণে বেসরকারি শিক্ষকদের দীর্ঘদিনের অসন্তোষ রয়েছে।’ সারা দেশের বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান জাতীয়করণের দাবি জানান তিনি। চান শিক্ষক দিবসে সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান জাতীয়করণের ঘোষণা।

অসন্তোষ রয়েছে সরকারি শিক্ষকদের মধ্যেও। বাংলাদেশ সরকারি কর্ম কমিশনের প্রতিযোগিতাপূর্ণ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে সরকারি কলেজে যোগদান করা শিক্ষা ক্যাডাররাও ফুঁসছেন অসন্তোষে। সোমবার সারা দেশের সরকারি কলেজসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে কর্মরত শিক্ষা ক্যাডাররা কর্মবিরতি পালন করেছেন। দাবিদাওয়া আদায় না হলে ফের ১০, ১১ ও ১২ অক্টোবর কর্মবিরতি পালন করবেন এই ক্যাডাররা।

এই শিক্ষকরা বলছেন, অন্য ক্যাডার সার্ভিসের চেয়ে পদমর্যাদায় অনেক পিছিয়ে আছেন শিক্ষা ক্যাডার কর্মকর্তারা। একের পর এক সমস্যা আর সংকটের কারণে প্রায় প্রতিনিয়তই অন্য ক্যাডারে যোগদানের চেষ্টা করছেন এই ক্যাডার কর্মকর্তারা। তাঁরা বলছেন, শিক্ষকের মাধ্যমে আদর্শ মানুষ তথা স্মার্ট নাগরিক গড়ার কথা থাকলেও শিক্ষকদের যথাযথ মর্যাদা দেওয়া হচ্ছে না।

বিসিএস সাধারণ শিক্ষা সমিতির সভাপতি অধ্যাপক মো. শাহেদুল খবির চৌধুরী গতকাল প্রতিবেদককে বলেন, ‘শিক্ষা রূপান্তরের অন্যতম কারিগর শিক্ষা ক্যাডাররা। কিন্তু প্রাপ্য অধিকার ও সুযোগসুবিধা থেকে তাঁদের বঞ্চিত করা হচ্ছে। পদোন্নতির মতো স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায়ও এই ক্যাডাররা অন্য ক্যাডারের থেকে অনেক পিছিয়ে। পদোন্নতির সব শর্ত পূরণ করেও পদোন্নতি পাচ্ছি না আমরা। দীর্ঘ সময় পর সহযোগী অধ্যাপক পদে পদোন্নতি দেওয়া হলেও যোগ্য সব কর্মকর্তা পদোন্নতি পাননি। পদোন্নতি না পাওয়ায় এই শিক্ষা ক্যাডাররা চাকরিজীবনে হতাশায় আছেন।’

বিসিএস সাধারণ শিক্ষা সমিতির মহাসচিব শওকত হোসেন মোল্যা বলেন, ‘শিক্ষার অনেক দফতর এই ক্যাডারবহির্ভূত কর্মকর্তারা দখল করে আছেন, যা সাধারণ শিক্ষা কম্পোজিশন অ্যান্ড ক্যাডার রুলসের পরিপন্থী। আমরা চাই শিক্ষার দফতরগুলো শিক্ষকদের ফিরিয়ে দিতে। আর শিক্ষকদের যথাযথ মর্যাদা না দিলে এমন দিবস পালন হবে লোকদেখানো।’

শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সম্প্রতি জারি করা এক আদেশে বলা হয়েছে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো খোলা রেখে নিজ উদ্যোগে শিক্ষার মানোন্নয়নে শিক্ষকের ভূমিকা এবং শিক্ষকের প্রতি সবার শ্রদ্ধাবোধ, সম্মান বৃদ্ধির লক্ষ্যে সচেতনতা তৈরিতে কর্মরত শিক্ষক, শিক্ষার্থী, অংশীজনের অংশগ্রহণে স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে র‌্যালি, আলোচনা সভা ও সেমিনারের আয়োজন করতে হবে।

শিক্ষক দিবস পালনের লক্ষ্যে সম্প্রতি অনুষ্ঠিত আন্তমন্ত্রণালয় সভাসূত্রে জানা গেছে, শিক্ষক দিবসে আজ গুণী শিক্ষকদের সংবর্ধনা দেওয়া হবে। মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিক, কারিগরি ও মাদরাসা শিক্ষকদের জন্য জাতীয় শিক্ষা সপ্তাহ ২০২৩-এ প্রতিটি ক্যাটাগরি থেকে নির্বাচিত একজন শ্রেষ্ঠ শিক্ষককে গুণী শিক্ষক সংবর্ধনা দেওয়া হবে। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের মধ্য থেকে একজন শ্রেষ্ঠ শিক্ষককে গুণী শিক্ষক হিসেবে সংবর্ধনা দেওয়া হবে। এ ছাড়া বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের জাতীয় অধ্যাপকদের মধ্যে বয়োজ্যেষ্ঠ দুজন অধ্যাপককে সংবর্ধনা দেওয়া হবে।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর