শনিবার, ১৪ অক্টোবর, ২০২৩ ০০:০০ টা

জামিনে বেপরোয়া ওরা

অপরাধীরা হত্যা, অপহরণ, চাঁদাবাজিতে জড়িত

সাখাওয়াত কাওসার

জামিনে বেপরোয়া ওরা

জামিনে থেকেই ভয়ংকর ওরা। একের পর এক ঘটিয়ে যাচ্ছে ভয়ংকর সব অপরাধ। সমাজ এবং রাষ্ট্রের জন্য হুমকি হওয়ার পরও রহস্যজনকভাবে তারা অল্প দিনেই জামিনে বেরিয়ে আসছে। অন্যদিকে, জামিনে থাকা দুর্ধর্ষ আসামিদের মনিটরিংয়ে রাখার কথা থাকলেও বাস্তব চিত্র একেবারেই উল্টো। খোদ আইন প্রয়োগকারী সংস্থার দুর্নীতিগ্রস্ত সদস্যদের সঙ্গে সখ্য গড়ে ওরা হয়ে উঠছে আরও বেপরোয়া। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সমাজের বিভিন্ন স্তরে অনিয়মই স্থায়ী রূপ পাওয়ার কারণে এমনটা হচ্ছে বারবার। গত ২০২০ সালে টাঙ্গাইলের মধুপুরে ২০০ টাকার জন্য একই পরিবারের চারজনকে চেতনানাশক ওষুধ খাইয়ে গলা কেটে হত্যা করেন সাগর আলী। ওই হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় সাগরকে গ্রেফতার করে র‌্যাব। এরপর থেকে টাঙ্গাইল কারাগারে ছিলেন সাগর। সাড়ে তিন বছর পর জামিনে বের হওয়ার কিছুদিন পর সাগর গত ৩০ সেপ্টেম্বর সাভারের আশুলিয়া জামগড়া এলাকায় মোক্তার হোসেন, তার স্ত্রী সাহিদা ও তাদের ১২ বছরের শিশু সন্তান মেহেদীকে হত্যা করেন। সম্প্রতি সাগরকে গ্রেফতার করে র‌্যাব এ তথ্য জানতে পারে। গ্রেফতার হওয়ার পর ‘সাগর নিজেই বলেছেন, তিনি একজন সিরিয়াল কিলার। খুন করে তিনি পৈশাচিক আনন্দ পান।’ র‌্যাব সূত্র বলছে, গত এক বছরে  গ্রেফতার হওয়া আসামিদের মধ্যে অন্তত দুই শতাধিক অপরাধী পাওয়া গেছে  যারা একাধিক মামলার আসামি। তারা জামিনে থেকে ফের একই ধরনের অপরাধের সঙ্গে সম্পৃক্ত। এ ব্যাপারে র?্যাবের মুখপাত্র কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, সম্প্রতি অনেক অপরাধিকে গ্রেফতার করেছেন তারা, যারা একাধিক মামলার আসামি। জামিনে বের হয়ে তারা একই ধরনের অপরাধ বারবার করেছে বলে জানান তিনি। সিরিয়াল খুনি সাগর সম্পর্কে তিনি বলেন, সাগর আমাদের প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে জানিয়েছেন, টাঙ্গাইল কারাগারে বন্দি একজন রাজনৈতিক প্রভাবশালী ২৮ লাখ টাকা খরচ করে তাকে জামিনে বের করার ব্যবস্থা করেন। আসন্ন নির্বাচনকে কেন্দ্র করে নিজের রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে খুন করতে সাগরকে জামিনে বের করেন তিনি। ওই ব্যক্তি নিজেও হত্যা মামলার আসামি। খুনের বিনিময়ে সাগরকে জামিনে বের করা ও তার পরিবারের ভরণপোষণের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন ওই নেতা। সাগরের দেওয়া প্রাথমকি এ তথ্য যাচাই করা হচ্ছে। ঢাকা মহানগর গায়েন্দা পুলিশ সূত্র বলছে, গত এক বছরে  জামিনে থাকা কয়েক হাজার আসামিকে তারা গ্রেফতার করেছেন। এসব আসামির কেউ একাধিক হত্যা মামলার আসামি। আবার অনেকে চুরি, ছিনতাই, ডাকাতি ও ধর্ষণ মামলার আসামি। সর্বশেষ গত দুই দিনে সংঘবদ্ধ অপরাধী চক্রের সাতজনকে গ্রেফতার করেছেন তারা। এরা হত্যা, কুপিয়ে যখম, অপহরণ ও চাঁদাবাজিসহ নানা অপরাধে জড়িত। তারা একাধিক মামলার আসামি। জামিনে থেকে তারা একই ধরনের অপরাধ করে আসছিলেন। ডিএমপির অন্তত ২০ থানার ওসির সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, প্রতি মাসেই তারা জামিনে থাকা অনেক অপরাধিকে হত্যা, মাদক, অস্ত্র, চাঁদাবাজিসহ নানা অপরাধে গ্রেফতার করেন। আগেও বিভিন্ন মামলায় এরা একাধিকবার গ্রেফতার হয়েছিল।  আইন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জামিন দেওয়ার এখতিয়ার একমাত্র আদালতের। তবে অনেক সময় মামলার তদন্তে ধীরগতি, আসামির বিরুদ্ধে এজাহারে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ না থাকা, সাক্ষী হাজির না হওয়ায় বিচার বিলম্বসহ নানা কারণেই জামিন পান আসামিরা। জামিন পেয়ে কোনো আসামি যদি আবারও একই ধরনের অপরাধ করেন তাহলে রাষ্ট্রপক্ষের উচিত সংশ্লিষ্ট আসামির জামিন বাতিলে আদালতে উপযুক্ত পদক্ষেপ নেওয়া। কারণ মামলার বাদী ও সাক্ষীদের সুরক্ষা দেওয়ার দায়িত্ব রাষ্ট্রের। একই সঙ্গে জামিনপ্রাপ্ত আসামির ওপর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কঠোর নজরদারি প্রয়োজন। সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী মো. আলতাফ হোসাইন বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, অন্তর্র্বর্তীকালীন কিংবা স্থায়ী হোক, জামিন পাওয়ার পর নিয়মকানুন মেনেই চলতে হবে আসামিকে। জামিনপ্রাপ্ত ব্যক্তি কোনোরকম অপরাধমূলক কাজে নিজেকে জড়িত করলে জামিনের শর্তাবলি ভঙ্গ করেছে বলে গণ্য হবে। এ ব্যাপারে আদালতকে জামিন মঞ্জুরকালীন আরও দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করতে হবে। অপরাধ বিশেষজ্ঞ এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক ড. তৌহিদুল হক বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, এটা আমাদের তৈরি করা বাস্তবতা। আমরা অপরাধী এবং অপরাধ নিয়ন্ত্রণ করতে পারছি না। জামিন পাওয়ার অধিকার সবার আছে। তবে কাকে কোন অপরাধের পরিপ্রেক্ষিতে জামিন দিচ্ছেন, তার আগের অপরাধ কতটা সমাজে বিভীষিকা তৈরি করতে পারে সে বিষয়টি বিবেচনা করা প্রয়োজন। অনেকে অর্থের শক্তি, পেশি শক্তির কারণে জামিনে বেরিয়ে এসে সমাজে ফের অস্থিরতা তৈরি করছেন। তিনি আরও বলেন, আইন প্রয়োগকারী সংস্থার কাজ হলো জামিনকালীন সময়টি মনিটরিং করা। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যায় পুলিশের সঙ্গে তার বিশেষ বোঝাপড়া তৈরি হয়। এ সুযোগে সহজেই আগের রূপে ফিরে যান জামিনপ্রাপ্ত ব্যক্তি। একাধিক ভুক্তভোগীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, অনেক ভয়ংকর অপরাধী জামিনে থাকার কারণে মামলার বাদী, সাক্ষী ও অপরাধ সংঘটন এলাকার বাসিন্দারা আতঙ্কে থাকেন। জামিনে বেরিয়ে এসে তারা ভয়ভীতি দেখান সাক্ষীদের। ফলে সাক্ষীরা মামলার সাক্ষ্য দিতে গরহাজির থাকছেন। ২০০৯ সালে চট্টগ্রামের ইপিজেড এলাকায় এরশাদ নামে এক ব্যক্তিকে খুন করে দুর্বৃত্তরা। এক বছরের বেশি সময় হাজতবাসের পর জামিনে বেরিয়েই হত্যা মামলার সাক্ষী লায়লা নামের এক নারীকে খুন করে তারা। পরে আসামি ইরানকে গ্রেফতার করে র‌্যাব। ২০১৫ সালে ট্যুরিস্ট পুলিশের কনস্টেবল পারভেজ হাসান হত্যাকাে  গ্রেফতার হন আবু তাহের। সাত বছর জেলে থাকার পর গত বছর জামিনে বের হন। ওই বছরের ১৬ আগস্ট খুন করেন কক্সবাজার পৌরসভার ১১ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর নূর মোহাম্মদের ছেলে শাহজাহান সেজানকে। ডিএমপির উপকমিশনার (মিডিয়া) মোহাম্মদ ফারুক হোসেন বলেন, বিশেষ করে যারা পেশাদার অপরাধী তাদের বিরুদ্ধে কতগুলো মামলা রয়েছে তা চার্জশিটে উল্লেখ থাকে। তাই এ ধরনের অপরাধীদের যদি নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত কারাগারে আটকে রাখা যায়, তাহলে অপরাধের পুনরাবৃত্তি রোধ করা সম্ভব হবে।

 

সর্বশেষ খবর