সোমবার, ১৬ অক্টোবর, ২০২৩ ০০:০০ টা

ঝুলছে ৪২ লাখ মামলা

আরাফাত মুন্না

ঝুলছে ৪২ লাখ মামলা

সরকার ও বিচার বিভাগের বিভিন্ন কার্যকর উদ্যোগের ফলে আদালতগুলোতে সাম্প্রতিক সময়ে মামলা নিষ্পত্তির হার বেড়েছে। তবে এর পরেও কমছে না মামলাজট। এরই মধ্যে বিচারাধীন মামলার সংখ্যা ৪২ লাখ ছাড়িয়ে গেছে। দীর্ঘদিনেও মামলার বিচারকাজ শেষ না হওয়ায় বিচারপ্রার্থীদের সময় ও অর্থ দুটোই নষ্ট হচ্ছে। দীর্ঘসূত্রতার কারণে ন্যায়বিচার বঞ্চিত হওয়ার শঙ্কা তো রয়েছেই। আর অতিরিক্ত মামলার চাপে হিমশিত খেতে হচ্ছে বিচারক ও আদালত সংশ্লিষ্টদের।

আইনজ্ঞরা বলছেন, বিচারক স্বল্পতার পাশাপাশি আইনের ত্রুটি, সাক্ষী হাজির না হওয়াই মামলাজটের অন্যতম কারণ। এসব সমস্যা দ্রুত দূর করতে পারলেই কমবে মামলাজট। এদিকে মামলাজট নিরসনে সরকার বেশ কিছু কার্যকর পদক্ষেপ নিয়েছে উল্লেখ করে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেছেন, এর সুফল শিগগিরই মিলবে।

সুপ্রিম কোর্টের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, গত ৩১ মার্চ পর্যন্ত দেশের সব আদালত ও ট্রাইব্যুনালে বিচারাধীন মামলার সংখ্যা ৪২ লাখ ৮ হাজার ৯৮৭টি। এসব মামলার মধ্যে তদন্তাধীন অবস্থায় রয়েছে ১ লাখ ৫৮ হাজার ৫৮ মামলা। এরমধ্যে উচ্চ আদালতের দুই বিভাগে (আপিল বিভাগ ও হাই কোর্ট) ৫ লাখ ৩৮ হাজার ৩১৭ এবং অধস্তন আদালতে ৩৬ লাখ ৭০ হাজার ৬৭০টি মামলা বিচারাধীন রয়েছে।

পরিসংখ্যান বলছে, ১৩ হাজার ৪৪২টি দেওয়ানি, ৭ হাজার ৫৯৪টি ফৌজদারি ও আদালত অবমাননার ১৪৮টিসহ আপিল বিভাগে বিচারাধীন মামলার সংখ্যা ২১ হাজার ১৮৪টি। অন্যদিকে হাই কোর্ট বিভাগে মোট বিচারাধীন মামলা পাঁচ লাখ ১৭ হাজার ১৩৩টি। এর মধ্যে ৯১ হাজার ৬৩৮টি দেওয়ানী, তিন লাখ তিন হাজার ৮৬৩টি ফৌজদারী এবং রিট ও আদিম মিলিয়ে আরও এক লাখ ২১ হাজার ৬৩২টি মামলা বিচারাধীন আছে।

সুপ্রিম কোর্টের পরিসংখ্যান বলছে, ৬৪ জেলার অধস্তন আদালতে বিচারাধীন মামলা গুলোর মধ্যে ১৬ লাখ ৮৯ হাজার ২৪০টি দেওয়ানী এবং ২৩ লাখ ৯৭ হাজার ৯৬৭টি ফৌজদারী অপরাধের মামলা। এই মামলা গুলোর মধ্যে আবার সাত লাখ ৮১ হাজার ৯৫৬টি মামলা ঝুলছে পাঁচ বছরের বেশি সময় ধরে। এর মধ্যে চার লাখ ৬৭ হাজার ৮৯০টি দেওয়ানী এবং তিন লাখ ১৪ হাজার ৬৬টি ফৌজদারী অপরাধের মামলা। আর অধস্তন আদালতে বিচারাধীন মামলা গুলোর মধ্যে অনুসন্ধান ও তদন্তাধীন রয়েছে এক লাখ ৫৮ হাজার ৫৮টি মামলা। জানা গেছে, বিদায়ী প্রধান বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী মামলাজট নিরসনে বেশ কিছু কার্যকর পদক্ষেপ নিয়েছিলেন। এরফলে মামলা নিষ্পত্তির হার বেড়েছে। তার নেওয়া উদ্যোগ গুলোর মধ্যে আট বিভাগের মামলা তদারকিতে হাই কোর্টের আটজন বিচারপতিকে প্রধান করে আটটি মনিটরিং সেল গঠন, উচ্চ আদালতে পুরনো মামলা নিষ্পত্তির জন্য মাঝে মাঝেই বিশেষ বেঞ্চ গঠন ছিল অন্যতম। এদিকে বর্তমান প্রধান বিচারপতি ওবায়দুল হাসান দায়িত্ব গ্রহণের দিন থেকেই মামলাজটকে চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিয়েছেন। এ জন্য নিজের পূর্বসূরীর নেওয়া কার্যকর পদক্ষেপ গুলোর ধারাবাহিকতা বজায় রাখার ঘোষণাও দিয়েছেন তিনি।

শিগগিরই জট কমবে আশা আইনমন্ত্রীর: মামলাজটের বিষয়ে জানতে চাইলে আইন বিচার ও সংসদ বিষয়কমন্ত্রী আনিসুল হক বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, মামলাজট নিরসনে আমরা বেশ কিছু কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করেছি। তবে আমাদের এসব কাজকে আটকে দিয়েছে করোনা মহামারী। তিনি বলেন, করোনাকালে অপরাধ কমেনি, কিন্তু শুনানি হয়ে মামলা নিষ্পত্তি হওয়া বন্ধই ছিল। ওই সময় আমরা প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে আদালত কর্তৃক তথ্য-প্রযুক্তির ব্যবহার আইন করে মামলার অন্তবর্তীকালীন বিভিন্ন বিষয়, যেমন- জামিন ও স্থগিতাদেশ সংক্রান্ত আবেদন নিষ্পত্তি করেছি। প্রায় এক বছর এজলাসে বসতে পারেননি বিচারকরা। বাসায় থেকে ভার্চুয়াল মাধ্যমে শুধু অন্তবর্তীকালীন বিষয় নিষ্পত্তি করেছেন। এসব কারণে মামলার সংখ্যা বেড়েছে। তিনি আরও বলেন, করোনার প্রভাব কমে যাওয়ার পর যখন সশরীরে আদালতের কার্যক্রম শুরু হয়, তখন সুপ্রিম কোর্টের সঙ্গে পরামর্শ করে আমরা কিছু পদক্ষেপ নিয়েছি। এর মধ্যে সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত মামলার বিচার করা এবং দুপুরের পর থেকে জামিন ও অন্যান্য আবেদনের শুনানি করা। আমরা ছোট মামলা গুলো আদালতের বাইরে নিষ্পত্তির জন্য উৎসাহিত করছি। এইসব কারণে কিন্তু মামলা নিষ্পত্তি কিছুটা বেড়েছে। আইনমন্ত্রী বলেন, জনসংখ্যার তুলনায় আমাদের বিচারকের আনুপাতিক হার কম। তবে এটা আগে আরও অনেক কম ছিল। বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর বিচারক নিয়োগ বৃদ্ধি করেছে। আমি আমার দুই মেয়াদে প্রায় ৮০০ বিচারক নিয়োগ দিতে পেরেছি। মন্ত্রী বলেন, এছাড়াও নতুন নতুন ভবন করে এজলাস সংকট দূর করছি। বিচারকদের উন্নত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে পেরেছি। বিচারক ও বিচার সংশ্লিষ্টদের উন্নত প্রশিক্ষণের জন্য আমরা জুডিশিয়াল একাডেমী প্রতিষ্ঠার কাজ শুরু করেছি। যেসব পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে, তার সুফল হিসেবে মামলাজট কমার যে চিত্র, তা খুব শিগগিরই দেখা যাবে বলে মনে করেন আইনমন্ত্রী।

কীভাবে হবে মামলাজট দূর : ৪২ লাখের বেশি মামলার জট দেশের বিচার বিভাগের জন্য বিষফোঁড়া হয়ে দাঁড়িয়েছে। পাহাড়সহ এ মামলার জট নিরসনের কিছু পথ দেখিয়েছেন অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি ও সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবীরা। জানতে চাইলে আপিল বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি এএইচএম শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, বিচারপ্রার্থীরা দ্রুততম সময়ে ন্যায়বিচার চান। তবে আমাদের আদালতের পক্ষে মানুষের সেই আশা পূরণ করা সম্ভব হচ্ছে না। বিচারপ্রার্থীদের জন্য একটি দুর্ভোগের নাম ‘মামলাজট’। তিনি বলেন, এই দুর্ভোগের হাত থেকে রেহাই পেতে এখন সাধারণ মানুষের উচিত যতদূর সম্ভব মামলা না করা। মামলার পরিবর্তে বিকল্প বিরোধ পদ্ধতিতে (এডিআর) সকল ঝামেলা নিষ্পত্তি করলে একদিকে আদালতে যেমন মামলার চাপ কমবে, ঠিক একই ভাবে বিচারপ্রার্থীদের সময় ও অর্থ দুটোই বাঁচবে বলেও মন্তব্য করেন তিনি। সাবেক আইনমন্ত্রী সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘মামলার জট যেভাবে বাড়ছে, তাতে আইনের শাসন সুপ্রতিষ্ঠিত হচ্ছে বলে আমার মনে হয় না।’ তিনি বলেন, ‘মামলার জট দ্রুত নিষ্পত্তিতে এখন আর হালকা করে ভাবার সময় নেই। দ্রুত সিদ্ধান্ত নিয়ে সেসব সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করতে হবে। টাইম ফ্রেম করে বিচারকদের মামলা নিষ্পত্তির টার্গেট দিতে হবে। আমার মনে হয় ইচ্ছে করলে এটা করা সম্ভব।’ এ ছাড়া নতুন মামলা রুজু ঠেকাতে বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তির (এডিআর) ওপরও গুরুত্বারোপ করেছেন তিনি। সাবেক এই আইনমন্ত্রী বলেন, এডিআর দুভাবে করা যায়। মামলা দায়েরের আগেও করা যায়, আবার দায়েরের পরেও করা যায়। দুই পক্ষ যদি সম্মত থাকে, দেওয়ানি মামলার পাশাপাশি ফৌজদারি মামলাও এডিআর পদ্ধতি প্রয়োগ করে দ্রুত নিষ্পত্তি করতে হবে। যে কোনোভাবে মামলার জট কমানোর লক্ষ্য নিয়ে কাজ করতে পারলেই এই ‘অভিশাপ’ থেকে মুক্তি সম্ভব বলে মনে করেন তিনি।

 

 

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর