শনিবার, ২১ অক্টোবর, ২০২৩ ০০:০০ টা

ভুল সংশোধনে জীবন পার

এনআইডি, পাসপোর্ট, জন্মনিবন্ধন, সার্টিফিকেট সর্বত্র ভুল, সংশোধনে হয়রানি পেরিয়ে যায় বছর, যত ভুল তত ঘুষ, দালাল ছড়িয়ে পড়েছে অনলাইনেও

শামীম আহমেদ

ভুল সংশোধনে জীবন পার

করণীক ভুলের কবলে দেশের কোটি কোটি মানুষ। জন্মনিবন্ধন সনদ, জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি), পাসপোর্ট, সার্টিফিকেট সর্বত্র ভুলের ছড়াছড়ি। কারও বাবার নামের জায়গায় বসিয়ে দেওয়া হয়েছে ‘আওয়ামী লীগ’, মায়ের নামে ভুল, কারও ঠিকানায় ভুল, কারও নিজের নাম ভুল, স্বামীর নামের স্থলে ছাপা হয়েছে বাবার নাম, জন্ম সালের সংখ্যা আগ-পিছ হওয়ায় বয়স বেড়ে গেছে ১০ বছর, কখনো আবার পুরুষের এনআইডিতে ছাপা হয়েছে নারীর ছবি। ভুল সংশোধনে প্রতিদিন লাখো মানুষ ঘুরে বেড়াচ্ছেন সংশ্লিষ্ট দফতরগুলোর এক টেবিল থেকে অন্য টেবিলে। হয়রানি হচ্ছেন। দালালদের পেছনে খরচ করতে হচ্ছে মোটা অঙ্কের টাকা। একটি বানান সংশোধনে পেরিয়ে যাচ্ছে বছরের বেশি। কারও আবার ভুল সংশোধনের আগেই মৃত্যু হচ্ছে। এসব ভুলের কারণে পদে পদে ভোগান্তিতে পড়তে হচ্ছে দেশের জনগণকে। নানা সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন তারা। পরিচয়পত্রে ভুল থাকায় চাকরি হচ্ছে না, কেউ বেতন বা পেনশন পাচ্ছেন না, কেউ ব্যাংকে লেনদেন করতে পারছেন না। অনেক হতদরিদ্র ত্রাণ নিতে পারছেন না। হচ্ছে না পাসপোর্ট ও ভিসা। আইইএলটিএস-এ কাক্সিক্ষত স্কোর তুলেও বিদেশে উচ্চশিক্ষার সুযোগ হারাচ্ছেন। ভুক্তভোগীরা বলছেন, অসংখ্য মানুষের নিজের নামের বানানেই ভুল আসছে। নিজের নাম তো কারও ভুল হওয়ার কথা না।  নির্বাচন কমিশন সূত্রে জানা গেছে, এখন পর্যন্ত দেশে জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি) পেয়েছেন প্রায় ১২ কোটি মানুষ। ৪ অক্টোবর পর্যন্ত এনআইডি সংশোধনের আবেদন জমা পড়েছে ৫৭ লাখ ২৯ হাজার ৫৭৯টি। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ১১ লাখ ৫৫ হাজার ৩৪৭টি আবেদন পড়েছে ঢাকা অঞ্চলে। অন্যদিকে গত ৫ অক্টোবর এক দিনে দেশে জন্ম নিবন্ধনের আবেদন করেছেন ২১ হাজার ৯৫৫ জন। সেখানে জন্ম নিবন্ধন সংশোধনের আবেদন করেছেন ২৪ হাজার ৭৪১ জন। এদিকে ভুল সংশোধনে সৃষ্টি হয়েছে ওইসব দফতরকেন্দ্রিক দালালচক্র। টেলিগ্রাম বা ফেসবুকেও এমন দালালদের অসংখ্য গ্রুপ পাওয়া গেছে, যেখানে ভুল সংশোধনে বিভিন্ন প্যাকেজ ঘোষণা করা হচ্ছে।

এ ব্যাপারে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, এনআইডি ও জন্ম নিবন্ধনসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ সনদ বা দলিলে ভুল তথ্যের দায় মূলত সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা-কর্মচারীদের একাংশের, যারা হয় দায়িত্বে অবহেলা, বা উদ্দেশ্যমূলকভাবে সেবাগ্রহীতাদের জন্য এ সমস্যা তৈরি করেন। এর মাধ্যমে গ্রাহককে জিম্মি করে অবৈধ অর্থ আদায়সহ বিভিন্ন প্রকার প্রতারণায় লিপ্ত রয়েছেন বলে গণমাধ্যমসহ বিভিন্ন নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা গেছে। সুষ্ঠু তদন্তসাপেক্ষে যারা এ ধরনের অনিয়মের সঙ্গে জড়িত তাদের চিহ্নিত করে আইনানুগ জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা সরকারের দায়িত্ব। এ ক্ষেত্রে ব্যর্থ হলে এ ধরনের অনিয়ম যেমন আরও বিকশিত হবে, তেমনি ডিজিটালাইজেশনের সুফল সাধারণ জনগণ, বিশেষ করে আর্থসামাজিকভাবে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জন্য অধরাই রয়ে যাবে।

ঢাকা তেজগাঁও এলাকার এক বাসিন্দা গত মাসে নির্বাচন কমিশনের অনলাইনে এনআইডিতে তার বাবার নাম সংশোধনের আবেদন করেন। কমিশনের কম্পিউটার অপারেটরদের ভুলের কারণে তার বাবার নামের শেষ অংশে বেগম যুক্ত করা হয়। সংশোধনীর জন্য কমিশনের সংশ্লিষ্ট অফিস তার কাছে একাডেমিক সার্টিফিকেট চায়। স্বীকৃত কোনো সার্টিফিকেট না থাকায় বিপত্তিতে পড়েন তিনি। পরে কমিশনের এক পরিচিত কর্মকর্তার মাধ্যমে ভোটার হওয়ার সময় পূরণ করা ফরম-২ উদ্ধার করতে সক্ষম হন। সেই ফরমে পিতার নাম সঠিক থাকায় তিনি তথ্য সংশোধনে সমর্থ হন। ওই ব্যক্তি বলেন, পরিচিত লোক থাকায় আমি ফরমটি উদ্ধার করতে পেরেছি। কয়েকজন দালাল কাজটি করে দিতে ১৫-২০ হাজার টাকা চেয়েছিল।

লক্ষ্মীপুরের রায়পুর উপজেলার ৭ নম্বর বামনী ইউনিয়নের রাশেদ হোসাইন। হাতে লেখা জন্ম নিবন্ধন সনদে মায়ের নামের শেষ অংশে আক্তারের জায়গায় বেগম লেখা। গত বছরের ১৩ সেপ্টেম্বর সব ডকুমেন্টসহ সংশোধনের জন্য অনলাইনে আবেদন করেন তিনি। বছর ঘুরলেও এখনো সংশোধিত জন্মসনদ পাননি তিনি। রাশেদ বলেন, আমার মায়ের জন্ম নিবন্ধনেও আক্তার লেখা আছে। আমার সব সার্টিফিকেটে, এমনকি জাতীয় পরিচয়পত্রেও মায়ের নামের শেষে আক্তার আছে। এটা তো গ্রাহকের ভুল না। ইউনিয়ন অফিসের ভুল। সংশোধনের জন্য প্রয়োজনীয় সব ডকুমেন্টসহ আবেদন করেছিলাম। বছর ঘুরলেও কাজ হয়নি। চাকরির সুবাদে ঢাকায় থাকি, বারবার তো গ্রামে যাওয়া সম্ভব না। তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ইউনিয়ন পরিষদের ভুলে আমাকে হয়রানি পোহাতে হচ্ছে! আমাকে ফি দিতে হচ্ছে। কেউ কেউ বলেছেন, হাজার পাঁচেক টাকা ঘুষ দিলে হয়ে যাবে। এটা কেমন দেশ? বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী হাবিবা সুলতানার সার্টিফিকেটে তার মায়ের নামে ভুল রয়েছে। পড়াশোনার কারণে তিনি ঢাকায় থাকেন। সার্টিফিকেট সংশোধনের জন্য বোর্ডে গেলে তাকে গ্রামের বাড়ির প্রতিষ্ঠান থেকে আবেদন করতে বলা হয়। গত বছরের ২৮ সেপ্টেম্বর গ্রামে গিয়ে নিজ প্রতিষ্ঠান থেকে মাদরাসা বোর্ডে আবেদন করেন। আবেদন করতে হাবিবাকে এফিডেভিট (আবশ্যক), পত্রিকার বিজ্ঞাপন (আবশ্যক), জন্ম সনদ অথবা জাতীয় পরিচয়পত্র, পিতা-মাতার নিকাহনামা (ঐচ্ছিক) সনদ জমা দিতে হয়। বোর্ড থেকে মোবাইলে খুদেবার্তার মাধ্যমে জানিয়ে দেওয়ার কথা বলা হলেও এখনো সেই কাক্সিক্ষত বার্তা আসেনি। তবে আট মাস পর কৌতূহলবশত ওয়েবসাইটে গিয়ে দেখেন সার্টিফিকেটে তার মায়ের নাম সংশোধনের সিদ্ধান্ত এসেছে। খুদেবার্তা না আসায় প্রায় আট মাস পর সনদ উত্তোলন করতে পারেন হাবিবা।

সর্বশেষ খবর