রবিবার, ২২ অক্টোবর, ২০২৩ ০০:০০ টা

তৈরি হচ্ছে না দক্ষ চালক

আরাফাত মুন্না ও হাসান ইমন

তৈরি হচ্ছে না দক্ষ চালক

দেশের অর্থনীতি বড় হওয়ার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে সড়ক ও যানবাহনের সংখ্যা। তবে তৈরি হচ্ছে না দক্ষ পেশাদার চালক। ফলে বাড়ছে সড়ক দুর্ঘটনা আর হতাহতের সংখ্যা। চলতি বছর প্রথম ৯ মাসেই সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যু সাড়ে ৪ হাজার ছাড়িয়ে গেছে। সড়ক পরিবহন আইন অনুযায়ী, চার স্তরের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে চালকদের লাইসেন্স পাওয়ার কথা। কিন্তু অভিযোগ আছে, ৯০ ভাগ পরীক্ষার্থীর ক্ষেত্রেই যথাযথ যোগ্যতা যাচাই করা হয় না। বাংলাদেশ প্রতিদিনের অনুসন্ধান বলছে, বাংলাদেশ রোড  ট্রান্সপোর্ট অথরিটি- বিআরটিএ’র ত্রুটিপূর্ণ পরীক্ষা পদ্ধতি ও সংশ্লিষ্টদের অনিয়ম-দুর্নীতির কারণেই যথাযথ যোগ্যতা যাচাই করা সম্ভব হচ্ছে না। আর দক্ষ চালক তৈরিতে বিআরটিএর নিবন্ধিত ড্রাইভিং স্কুলগুলোতেও দক্ষ প্রশিক্ষক না থাকার তথ্য মিলেছে। অভিযোগ রয়েছে, অধিকাংশ ড্রাইভিং স্কুলই ড্রাইভিং লাইসেন্সের দালালের ভূমিকায় কাজ করে থাকে।

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের সড়ক দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউট (এআরআই)-এর তথ্য অনুযায়ী ৯০ শতাংশ দুর্ঘটনার পেছনে চালকের সম্পৃক্ততা রয়েছে। বিআরটিএ-এর পরিসংখ্যান অনুযায়ী, দেশে নিবন্ধিত ভারী যানবাহনের সংখ্যা ২ লাখ ৬৭ হাজার ৮৩৭টি। অন্যদিকে লাইসেন্সধারী ভারী যানবাহন চালকের সংখ্যা ১ লাখ ৬৫ হাজার ১০। পরিবহন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আন্তর্জাতিক মানদন্ডে ভারী যানবাহনপ্রতি দেড়জন করে চালক প্রয়োজন।

কিন্তু আমাদের দেশে একজন করেও নেই। আর যানচলাচলের সময় চালকরা সড়ক পরিবহন আইনও যথাযথভাবে মানেন না। এসব কারণেই দুর্ঘটনা কমছে না।

এদিকে আজ সপ্তমবারের মতো দেশে পালিত হচ্ছে জাতীয় নিরাপদ সড়ক দিবস। এ বছর দিবসটির প্রতিপাদ্য হচ্ছে- ‘আইন মেনে সড়কে চলি, স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ে তুলি’। দিবসটিকে কেন্দ্র করে রাজধানীর ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনে আলোচনা সভাসহ নানা কর্মসূচি নিয়েছে বিআরটিএ।

দেশে দক্ষ চালক তৈরির বিষয়ে জানতে চাইলে পরিবহন বিশেষজ্ঞ ও বুয়েটের এক্সিডেন্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (এআরআই) বিভাগের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ড. হাদিউজ্জামান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, দেশের সড়কে আড়াই লাখ ভারী যানবাহন চলে। আন্তর্জাতিক মানদন্ডে ভারী যানবাহনে দেড়জন করে চালক প্রয়োজন। সে অনুযায়ী ৩ লাখের বেশি দক্ষ চালক প্রয়োজন। আমাদের একজন করেও দক্ষ চালক তৈরি হয়নি। এজন্য দায়ী বিআরটিএ ও বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন করপোরেশন- বিআরটিসি। সরকারি এই দুই প্রতিষ্ঠানই চালকদের প্রশিক্ষণ দিয়ে থাকে। দক্ষ চালক তৈরিতে প্রতিষ্ঠান দুটির তেমন কোনো ভূমিকা দেখছি না।

তিনি আরও বলেন, নিরাপদ সড়ক তৈরিতে সরকারসহ বিভিন্ন সংগঠন কাজ করছে। এর ফলাফল একেবারেই শূন্য বলব না। মানুষের মধ্যে কিছুটা সচেতনতা তৈরি হয়েছে। তবে সড়কে শৃঙ্খলার কোনো পরিবর্তন হয়নি। দুর্ঘটনার পরিসংখ্যান বাড়ছেই। সরকার বিগত বছরগুলোতে সড়কের নেটওয়ার্ক বৃদ্ধি করেছে। কিন্তু দুর্ঘটনা রোধে অন্তর্ভুক্তিমূলক কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। আইনও যথাযথভাবে মানা হচ্ছে না। এসব কারণে সড়কে দুর্ঘটনা কমছে না।

জানতে চাইলে বাংলাদেশ রোড  ট্রান্সপোর্ট অথরিটি- বিআরটিএর চেয়ারম্যান নূর মোহাম্মদ মজুমদার বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, দক্ষ চালক তৈরিতে আমরা কাজ করছি। প্রশিক্ষন কেন্দ্রের সংখ্যা বৃদ্ধি করছি। ড্রাইভিং লাইসেন্স প্রদানে পরীক্ষা ও প্র্যাকটিক্যাল পরীক্ষা নিয়ে থাকি। একই সঙ্গে তাদের সচেতনা বৃদ্ধিতেও কাজ করছি। তিনি আরও বলেন, সড়ক দুর্ঘটনা রোধে চালক, পথচারীসহ সবাইকে সচেতন হতে হবে। সড়কের আইন মানতে হবে। কিন্তু আইন মানার প্রবণতা খুবই কম। সড়কে শৃঙ্খলা ফেরাতে আমাদের ভ্রাম্যমাণ আদালত কাজ করছে। মোবাইল কোর্টের সংখ্যা আরও বাড়ানো হবে। তবে নিরাপদ সড়ক করতে সামাজিক আন্দোলনের বিকল্প নেই।

অনিয়মের চিত্র : গত ১৭ অক্টোবর বিআরটিএর ঢাকা মেট্রো সার্কেল-২ (ইকুরিয়া) কার্যালয়ে সরেজমিন ব্যাপক অনিয়মের চিত্র দেখা গেছে। ওই দিন দুপুর পৌনে ২টায় মাঠে নেওয়া হচ্ছিল ড্রাইভিং লাইসেন্স নবায়নের ফিল্ড টেস্ট। কমপক্ষে একজন মোটরযান পরিদর্শকের তত্ত্বাবধানে এই পরীক্ষা নেওয়ার কথা থাকলেও বিআরটিএর পক্ষে উপস্থিত ছিলেন শুধু জামান নামের একজন মেকানিক্যাল এসিস্ট্যান্ট (যদিও তিনি নিজেকে সহকারী পরিদর্শক পরিচয় দেন)। আর ‘মায়ের দোয়া ড্রাইভিং ট্রেনিং সেন্টার’ এর দুই কর্মী মাঠ থেকে পাস-ফেল সিগন্যাল দিচ্ছিলেন ওই বিআরটিএ কর্মীকে। নিয়ম না থাকলেও ওই মেকানিক্যাল এসিস্ট্যান্টই পাস-ফেল লিখছিলেন কাগজে। দুই সারিতে অপেক্ষমাণ ৫০ জনের বেশি পরীক্ষার্থী থাকলেও মুহূর্তেই তাদের টেস্ট পরীক্ষা নেওয়া হয়। কয়েক মিনিটের মধ্যেই খালি হয়ে যায় মাঠ। গড়ে ৩০ থেকে ৪৫ সেকেন্ডের মধ্যেই শেষ হয় প্রতি জনের ফিল্ড টেস্ট। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, একদিন আগেই (১৬ অক্টোবর) এই বিআরটিএর এই কার্যালয়ে নতুন ড্রাইভিং লাইসেন্স প্রদানে পরীক্ষা বোর্ড বসেছিল। সেদিন মোট ৪১১ জন পরীক্ষার্থীর মধ্যে অনুপস্থিত ছিলেন ৮০ জন। উপস্থিত ৩৩১ পরীক্ষার্থীর মধ্যে ৩০৫ জনই কৃতকার্য হন। অর্থাৎ মাত্র ২৬ জন অকৃতকার্য হন এই পরীক্ষায়। একই দিন বিআরটিএর ঢাকা মেট্রো সার্কেল-৪ (পূর্বাচল) কার্যালয়েও নতুন ড্রাইভিং লাইসেন্স প্রদান পরীক্ষা বোর্ড বসেছিল। ওইদিন এই কার্যালয়ে মোট ২০৯ পরীক্ষার্থীর মধ্যে ৫৯ জন অনুপস্থিত ছিলেন। উপস্থিত ১৫০ জনের মধ্যে ১৪৪ জন কৃতকার্য এবং মাত্র ছয়জন অকৃতকার্য হন। সূত্রের তথ্য অনুযায়ী এই কার্যালয়ের পরীক্ষার্থীদের অনেকেই বায়োমেট্রিক ও লিখিত পরীক্ষা দিয়ে হাজিরা খাতায় স্বাক্ষর করে চলে যান।

শুধু বিআরটিএর এই দুই কার্যালয়ই নয়, ড্রাইভিং লাইসেন্স প্রদানে বিআরটিএর সব কার্যালয়ের চিত্র প্রায় অভিন্ন। অনুসন্ধান বলছে, ফিল্ড পরীক্ষায় প্রায় ৮০ ভাগই অকৃতকার্য হলেও পরে দালাল চক্র ও তদবিরের জোরে তারাই হয়ে যান কৃতকার্য। কেউ কেউ শুধু মোটরসাইকেলের ড্রাইভিং পরীক্ষা দিয়ে একই সঙ্গে মোটরসাইকেল ও হালকা যানের লাইসেন্স পেয়ে যান দালালদের সহায়তায়।

এ বিষয়ে বিআরটিএর ঢাকা মেট্রো সার্কেল-২ এর উপপরিচালক মো. সানাউল হক বাংলাদেশ প্রতিদিনের কাছে অভিযোগ অস্বীকার করেন। তিনি বলেন, পরীক্ষার জন্য গঠিত বোর্ডই ফলাফল চূড়ান্ত করেন। এখানে একার কিছুই করার থাকে না। একই ধরনের কথা বলেছেন বিআরটিএর ঢাকা মেট্রো সার্কেল-৪ এর সহকারী পরিচালক মুহাম্মদ মোরশেদুল আলম। তিনি বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, লাইসেন্সের পরীক্ষায় বিআরটিএ কর্মকর্তারা একা সিদ্ধান্ত নেন না। সব সিদ্ধান্ত বোর্ড নেয়।

জানা গেছে, মহানগর পর্যায়ে বিআরটিএর প্রতিটি কার্যালয়ে লাইসেন্সের পরীক্ষা নেওয়ার জন্য একটি বোর্ড রয়েছে। এর নাম ড্রাইভিং কম্পিটেন্সি টেস্ট বোর্ড। এর চেয়ারম্যান হচ্ছেন অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট বা অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক)। সদস্য হলেন উপ বা সহকারী পুলিশ কমিশনার, মেডিকেল কলেজের একজন সহকারী অধ্যাপক, সড়ক ও জনপথ (সওজ) অধিদফতরের মেকানিক্যাল বা অটোমোবাইল বিভাগের একজন উপবিভাগীয় প্রকৌশলী ও মোটরযান পরিচালনায় জ্ঞানসম্পন্ন পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের একজন প্রশিক্ষক। আর বোর্ডের সদস্যসচিব বিআরটিএর সংশ্লিষ্ট কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক বা মোটরযান পরিদর্শক। 

তবে বাংলাদেশ প্রতিদিনের অনুসন্ধান বলছে, অধিকাংশ ক্ষেত্রে পরীক্ষাস্থলে বোর্ডের সদস্যরা উপস্থিত থাকেন না। কেউ কেউ অধীনস্থ ব্যক্তিদের পাঠিয়ে দায় সারেন। পরীক্ষায় উত্তীর্ণদের লাইসেন্স দিতে হলে সব সদস্যের স্বাক্ষর প্রয়োজন। প্রতিনিধি দিয়ে তা সম্ভব নয়। এ জন্য বিআরটিএর অফিস সহকারীরা উত্তীর্ণ তালিকা স্বাক্ষর করিয়ে আনতে কর্মকর্তাদের দফতরে দৌড়ঝাঁপ করেন। অনুসন্ধানে আরও জানা গেছে, বোর্ডের সদস্যদের পক্ষে যেসব প্রতিনিধি আসেন, তাদের একটা কক্ষে বসিয়ে চা-নাশতা খাওয়ানো হয়। এই ফাঁকে বিআরটিএর মোটরযান পরিদর্শকরা লাইসেন্স প্রার্থীদের লিখিত পরীক্ষা নেন। দিন শেষে যাওয়ার সময় সরকারি ২ হাজার টাকা ভাতার সঙ্গে অতিরিক্ত আয়ের ভাগও নিয়ে যান বোর্ড সদস্যদের প্রতিনিধিরা।

ত্রুটিপূর্ণ পরীক্ষা পদ্ধতি : পেশাদার ও অপেশাদার নির্বিশেষে মোটরযানচালকদের দক্ষতা যাচাইয়ে আন্তর্জাতিক কিছু মানদন্ড আছে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো ব্যবহারিক পরীক্ষায় যানবাহন চালানোর সক্ষমতা দেখা। এর জন্য ড্রাইভিং ট্র্যাক, র?্যাম্প, ড্রাইভিং সিমুলেটর, কম্পিউটারাইজড হলরুম জরুরি। নতুন চালকদের সংক্ষিপ্ত প্রশিক্ষণ দেওয়ার জন্য আধুনিক সুযোগ-সুবিধা সংবলিত প্রশিক্ষণ ও সেমিনার কক্ষও প্রয়োজন। এসবের কোনো কিছুই নেই বিআরটিএর। জানা গেছে, সারা দেশে জেলা ও মহানগর মিলে বিআরটিএর কার্যালয় আছে ৭০টি। এর মধ্যে প্রতিষ্ঠানের নিজস্ব জমিতে কার্যালয় আছে পাঁচটি। এগুলোতে স্বল্প পরিসরে চালকদের ব্যবহারিক পরীক্ষা নেওয়ার সুযোগ আছে। তবে পরীক্ষার্থীর সংখ্যা এত বেশি যে, তাদের দাঁড়ানোরও জায়গা থাকে না। ফলে সবার যানবাহন চালানো দেখে পরীক্ষা নেওয়া হয় খুবই কম। অনুসন্ধানে জানা গেছে, চালকরা যে যানবাহনে করে পরীক্ষা দেবেন, সেটি নিজের হবে নাকি ভাড়া করা হবে, এই বিষয়েও বিআরটিএর কোনো নির্দেশনা নেই। ফলে চালকরা পরীক্ষা দিতে এসে বিআরটিএ কার্যালয়ের সামনে থেকে গাড়ি বা মোটরসাইকেল ভাড়া করেন। এ জন্য এক ধরনের ব্যবসাও গড়ে উঠেছে। অনেক পেশাদার চালক বাস, ট্রাক কিংবা লরির মালিকের অনুমতি নিয়ে ড্রাইভিং পরীক্ষায় অংশ নেবেন, এমন সুযোগও নেই। কারণ বিআরটিএর পর্যাপ্ত জায়গা নেই। ফলে এদের ব্যবহারিক পরীক্ষা সেভাবে হয় না।

প্রথম ৯ মাসে মৃত্যু ৪৫৪২ : যাত্রীকল্যাণ সমিতির তথ্য অনুযায়ী, চলতি ২০২৩ সালের জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ৯ মাসে সারা দেশে ৪ হাজার ৩৭২টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৪ হাজার ৫৪২ জন নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন ৭৭৪৪ জন। তথ্য অনুযায়ী প্রতিবছর সড়ক দুর্ঘটনায় প্রায় ৮ হাজার মানুষের প্রাণহানি ঘটে। অন্যদিকে সরকারের স্বাস্থ্য অধিদফতর বলছে, সড়কে প্রতিদিন ৬৪ জন মানুষের প্রাণহানি ঘটছে। এই হিসাবে বাংলাদেশে প্রতি বছর সড়ক দুর্ঘটনায় গড়ে ২৩ হাজার ৩৬০ জন মানুষের প্রাণহানি হচ্ছে। প্রায় সাড়ে ৩ লাখ মানুষ আহত হচ্ছে। প্রতিবছর সড়ক দুর্ঘটনায় প্রায় ৮০ হাজার মানুষ প্রতিবন্ধী হয়ে পড়েছে। এর মধ্যে ১২ হাজারের বেশি ১৭ বছরের কম বয়সী। এ হিসাবে প্রতিদিন গড়ে ২২০ জন মানুষ প্রতিবন্ধী হচ্ছে কেবল সড়ক দুর্ঘটনায়।

সর্বশেষ খবর