মঙ্গলবার, ২৪ অক্টোবর, ২০২৩ ০০:০০ টা

হারিয়ে যাচ্ছে পালতোলা নৌকা

নিজস্ব প্রতিবেদক, বগুড়া

হারিয়ে যাচ্ছে পালতোলা নৌকা

নদীমাতৃক বাংলাদেশের নদীগুলোতে একসময় চলত পালতোলা নৌকা। ব্যবসা-বাণিজ্যসহ চলাচলের মাধ্যম ছিল এটি। চলত বাতাসের সাহায্যে। এখন আর পালতোলা নৌকার দেখা মিলছে না। এটি এখন বিলুপ্তির পথে।

তথ্য-উপাত্ত ঘেটে জানা যায়- যমুনা, বাঙ্গালী, করতোয়া এবং সুখদহ নদীবেষ্টিত বগুড়ার বিভিন্ন বন্দরে ভিড়ত পালতোলা নৌকা। এসব নৌকার মধ্যে ছিল ছিপ, বজরা, ময়ূরপঙ্খী, গয়না, পানসি, চরঙ্গা, কোষা, পাথাম, বাচারি, ঘাসি, সাম্পান, ফেটি, নায়রি, গস্তি, সওদাগরি, ইলশা, কেড়াই, সাপুরিয়া বা বেদে নাও, বৌচোর, লক্ষ্মী বিলাস, গ-ী বিলাস, খেয়া, বাইচের নাও বা দৌড়ের নাও এবং ডিঙি। আগেকার মানুষের চলাচলসহ ব্যবসা-বাণিজ্যের অন্যতম বাহন ছিল এসব নৌকা। এগুলো নোঙর ফেলত ঘাটে ঘাটে। নৌকাগুলো পালতুলে যখন চলাচল করত, তখন মনে হতো একঝাঁক বক নদীর মাঝ বরাবর উড়ে যাচ্ছে। সাধারণ পালতোলা নৌকাকে বগুড়ায় বাদাম তোলা নৌকাও বলা হতো। হাজারীপাল, বিড়ালীপাল, বাদুড়পাল ইত্যাদি পালের ব্যবহার ছিল নৌকাগুলোতে। প্রমোদ ভ্রমণে ময়ূরপঙ্খী, পানসি ও মধ্যবিত্তদের বজরা, সওদাগরি নৌকা ব্যবহৃত হতো। কৃষকরা গস্তি ও ডিঙি আর নিম্নবিত্তরা ঘাটে গয়না ও কোষা নৌকা ব্যবহার করতেন। তখনকার দিনে মাঝি-মাল্লাদের ছিল অনেক কদর। এসব গল্প এখন শুধুই স্মৃতি। বর্তমানে তেল কিনে মানুষ ইঞ্জিন চালাচ্ছে। নাও ছাড়িয়া দে, পাল উড়াইয়া দে পালা গানগুলো আর ঘাটের পাড়ে শোনা যায় না। বর্তমান প্রজন্ম এসব গানের মর্মও বুঝে না। ইতিহাসে সিন্ধু সভ্যতার বিভিন্ন এলাকা থেকে নানা রকমের নৌকার অস্তিত্বের কথা জানা যায়। প্রায় সাড়ে পাঁচ হাজার বছর আগে ভূ-মধ্যসাগরে বহু দাঁড়বিশিষ্ট নৌকার দেখা মিলত। দাঁড় (রশ্মি) টানার কাজে ব্যবহার করা হতো কৃতদাসদের। এই কাজটি ছিল শ্রমসাধ্য ও কষ্টের। পালের উদ্ভাবন এ অবস্থা থেকে মানুষকে খানিকটা মুক্তি দিয়েছে। দাঁড় টানার সঙ্গে পাল উড়ানো হলে নৌকার গতি বেড়ে যেত। তাই পালের ব্যবহার শুরু হয়। কাজে লাগানো হয় বাতাসের শক্তি। উনিশ শতকে সমুদ্র দখল করে রেখেছিল বাতাসচালিত কার্গোজাহাজ। এরপর বাষ্পচালিত ইঞ্জিনের কারণে হারিয়ে যায় বায়ুচালিত নৌকা। পরে কয়লাচালিত ইঞ্জিন পুরো নদী সাগর-মহাসাগর দখল করে নেয়। বগুড়ায় এখনো যমুনা নদীতে সকালে দেখা মেলে পালতোলা নৌকার। যখন নদীপথে নৌকাগুলো চলাচল করে তখন অপরূপ দৃশ্য ফুটে ওঠে। মনে পড়ে যায় পুরনো দিনের কথা। যমুনা পাড়ের পালতোলা নৌকার মাঝি সারিয়াকান্দি এলাকার সিরাজুল ইসলাম জানান, তেলের দামের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে না পেরে তিনি আবার পালতোলা নৌকার ব্যবহার শুরু করেছেন। যমুনা চরে মরিচ, স্থানীয় জাতের গাইঞ্জা ধান এবং মাষকলাইয়ের আবাদ আছে অনেক কৃষকের। নদীভাঙনের শিকার হয়ে তারা যমুনার ডানতীরে বিভিন্ন চরে বসতি গড়ে তুলেছেন। ফসলের যত্ন করতেই তারা পালতোলা নৌকায় প্রতিদিন যমুনা নদী পাড়ি দেন। স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে নৌকার এই মাঝি গরুর গাড়ির গাড়িয়াল ছিলেন। সারিয়াকান্দি গনকপাড়া গ্রামের বাসিন্দা মো. খোরশেদ আলম জানান, সারিয়াকান্দি যমুনা নদীতে একসময় সারি সারি পালতোলা নৌকা দেখেছি। সেই নৌকা হারিয়ে যেতে বসেছে। মাঝে মধ্যে এখন সারিয়াকান্দি যমুনা ও বাঙ্গালী নদীতে দেখা মিলছে পালতোলা নৌকার।

সর্বশেষ খবর