বুধবার, ২৫ অক্টোবর, ২০২৩ ০০:০০ টা

কৈলাসে ফিরে গেলেন দেবী দুর্গা

নিজস্ব প্রতিবেদক

কৈলাসে ফিরে গেলেন দেবী দুর্গা

ঢাকের বাদ্য, উলু-শঙ্খ ধ্বনিতে পৃথিবী থেকে কৈলাসে ফিরে গেলেন দেবী দুর্গা। গতকাল প্রতিমা বিসর্জনের মধ্য দিয়ে শেষ হলো বাঙালি হিন্দুর সবচেয়ে বড় পার্বণ শারদীয় দুর্গোৎসবের। আসছে বছর আবার হবে- এ বার্তা দিয়ে অশুভশক্তির বিনাশের প্রত্যয়ে ফিরে গেলেন দেবী দুর্গা।

হিন্দু পঞ্জিকা মতে, দেবী দুর্গা এবার ঘোটকে (ঘোড়ায়) চড়ে এসেছেন, গেলেনও ঘোটকে চড়ে। দেবীর এমন গমনাগমন সামাজিক, রাজনৈতিক ও সাংসারিক ক্ষেত্রে অস্থিরতার ইঙ্গিত দেয়। ঢাকেশ্বরী মন্দিরের প্রধান পুরোহিত ধর্মদাস চট্টোপাধ্যায় বলেন, ‘মহিষাসুর বধ করার মধ্য দিয়ে আজ বিজয়ী হয়েছেন দুর্গা মা। সে কারণেই আজ আমাদের আনন্দের দিন, আমরা উৎসব করি। জাতি-ধর্ম-বর্ণনির্বিশেষ সবাইকে বিজয়ার শুভেচ্ছা জানাই।’

ঢাকার ওয়াইজঘাটের বীণাস্মৃতি স্নানঘাটে বিকাল সাড়ে ৩টায় ধানমন্ডি সর্বজনীন পূজা উদযাপন কমিটির প্রতিমা বিসর্জনের মধ্য দিয়ে রাজধানীতে দেবীকে বিদায় জানানোর আনুষ্ঠানিকতা শুরু হয়। বিভিন্ন ঘাটে রাত ৮টা পর্যন্ত রাজধানীর ২৪৫টি ম-পের প্রতিমা একে একে বিসর্জন দেওয়া হয় বলে বাংলাদেশ পূজা উদযাপন পরিষদের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে।

বিসর্জনের আগে ঢাকার মন্দিরে মন্দিরে চলে সিঁদুর খেলা আর আনন্দ উৎসব। দুপুরে নগরীর বিভিন্ন স্থান থেকে ট্রাকে করে প্রতিমা এনে জড়ো করা হয় পলাশীর মোড় ও ঢাকেশ্বরী পূজামন্ডপ এলাকায়। এরপর সেখান থেকে ক্রমিক নম্বর নিয়ে শঙ্খ আর উলুধ্বনি, খোল-করতাল-ঢাক-ঢোলের সনাতনী বাদ্যের সঙ্গে আধুনিক সাউন্ড সিস্টেমে দেবীবন্দনার গানে গানে শোভাযাত্রা করেন ভক্তরা। স্বল্পগতিতে চলা ট্রাক ও পিকআপ ভ্যানে চড়া পূজারিদের পাশাপাশি অনেকে হেঁটে শোভাযাত্রায় অংশ নেন। প্রতিমা ঘাটে নেওয়ার পর ভক্তকুল শেষবারের মতো ধূপধুনো নিয়ে আরতিতে মেতে ওঠেন। শেষে পুরোহিতের মন্ত্রপাঠের মধ্য দিয়ে দেবীকে নৌকায় তুলে বিসর্জন দেওয়া হয়। সারা দেশের ৩২ হাজার ৪০৫টি মন্ডপে এ বছর দুর্গাপূজা অনুষ্ঠিত হয়েছে। আমাদের ময়মনসিংহ ব্যুরো জানিয়েছে, বিজয়া দশমীর সকালে ময়মনসিংহের পূজামন্ডপগুলোয় ভক্তরা অঞ্জলি দিয়েছেন। নগরীর রামকৃষ্ণ মিশন, দুর্গাবাড়ী মন্দির, শিববাড়ী মন্দির, আমলাপাড়া, বড় কালীবাড়ীসহ প্রতিটি মন্ডপে দেবী দুর্গার বিদায়ের সুরের মধ্য দিয়ে শুরু হয় সিঁদুর খেলা। এ সময় নারীরা ধর্মীয় রীতিতে পান-মিষ্টি দিয়ে বরণ করে বিদায় জানান দুর্গাকে। বিবাহিত নারীরা একে অন্যকে সিঁদুর পরিয়ে দেন। ঢাকের বাদ্য, শঙ্খ আর উলুধ্বনিতে মন্ডপগুলোয় ছিল উৎসবমুখর পরিবেশ। সন্ধ্যা থেকে নগরীর কাচারীঘাট ব্র??হ্মপুত্র নদে শুরু হয় প্রতিমা বিসর্জন। এ বছর ময়মনসিংহ সিটি করপোরেশনে ৮৮টিসহ জেলায় ৮৩৫ মন্ডপে শারদীয়া দুর্গোৎসব অনুষ্ঠিত হয়েছে।

নোয়াখালী প্রতিনিধি জানান, বিজয়া দশমীতে নোয়াখালীতে ১৭৯টি প্রতিমা বিসর্জন দিয়েছেন হিন্দুধর্মাবলম্বীরা। দুপুরে বেগমগঞ্জের রাজগঞ্জে বিজয়া দশমীর মধ্য দিয়ে সম্পন্ন হয়েছে উৎসব।

২০২১ সালে নোয়াখালীর বেগমগঞ্জে মন্দির ও পূজামন্ডপে হামলা, লুটপাট এবং দুজন নিহতের ঘটনা ঘটেছে। সেই শঙ্কার মধ্য দিয়ে এবার পূজা শুরু হলেও শেষ পর্যন্ত শান্তিপূর্ণ উৎসব করতে পেরে খুশি হিন্দুধর্মাবলম্বীরা। এবারের মতো এমন সম্প্রীতি বজায় থাকবে আগামীর বাংলাদেশে- এমনটাই প্রত্যাশা সবার।

জেলা প্রশাসক দেওয়ান মাহবুবর রহমান বলেন, ‘জেলায় শারদীয় দুর্গাপূজা শান্তিপূর্ণভাবে শেষ করতে আমাদের ম্যাজিস্ট্রেট, পুলিশ প্রশাসন ও সিভিল প্রশাসনের সদস্যরা আন্তরিকভাবে কাজ করেছেন।’ দিনাজপুর প্রতিনিধি জানান, গতকাল সকালে দিনাজপুরে শুরু হয় বিজয়া দশমীর আনুষ্ঠানিকতা।

নিজস্ব প্রতিবেদক, বগুড়া জানান, দুর্গাপূজার নবমীতে বগুড়া জেলার বিভিন্ন পূজামন্ডপ পরিদর্শন করেছেন জেলা পুলিশ সুপার সুদীপ কুমার চক্রবর্ত্তী। সোমবার সকাল থেকে রাত পর্যন্ত গাতবলী, সারিয়াকান্দি, সোনাতলা, শিবগঞ্জসহ অন্যান্য উপজেলার মন্ডপ পরিদর্শন করেন তিনি।

খাগড়াছড়ি প্রতিনিধি জানান, খাগড়াছড়ি পূজামন্ডপের প্রতিমাগুলো গতকাল মঙ্গলবার বিকাল ৫টায় চেঙ্গী নদীতে বিসর্জন দেওয়া হয়। বিসর্জনের আগে প্রতিমা নিয়ে ট্রাকে করে শহরের বিভিন্ন সড়ক প্রদক্ষিণ করা হয়। জেলা শহরের শ্রীশ্রীলক্ষ্মীনারায়ণ মন্দির, জগন্নাথ মন্দির, গীতা আশ্রম মন্দির, ঠাকুরছড়া শিবমন্দির, ভুবনেশ্বরী কালীমন্দির, খাগড়াপুর অখন্ডমন্ডলী মন্দিরে পূজার্থীর ভিড় দেখা গেছে। দেবীর বন্দনা, প্রার্থনায় মগ্ন থেকেছেন বিভিন্ন বয়সী নারী-পুরুষ।

কক্সবাজার প্রতিনিধি জানান, দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়া সত্ত্বেও বিপুলসংখ্যক পর্যটক আর ভক্ত-দর্শনার্থীর উপস্থিতিতে বিশ্বের দীর্ঘতম সমুদ্রসৈকতে হয়ে গেল প্রতিমা বিসর্জন। রং ছিটানো, আতশবাজি ফুটিয়ে ঢাকঢোল বাজিয়ে বের করা হয় শোভাযাত্রা। ঘূর্ণিঝড় হামুনের ৭ নম্বর বিপৎসংকেতের মধ্যে বিরূপ আবহাওয়া উপেক্ষা করে প্রতিমা বিসর্জন উপলক্ষে সৈকতে নামে পর্যটক আর ভক্তের ঢল। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত কখনো গুঁড়িগুঁড়ি, কখনো ভারী বৃষ্টিপাত হয় কক্সবাজারে। সন্ধ্যায় নানা ধর্মীয় ভাবগাম্ভীর্য আর উৎসাহ-উদ্দীপনার মধ্য দিয়ে সমাপ্ত হয় কক্সবাজার সমুদ্রসৈকতে সনাতন ধর্মাবলম্বীদের প্রতিমা বিসর্জন। এর মাধ্যমে সমাপ্তি ঘটে দুর্গোৎসবের।

বিকাল ৩টার পর কক্সবাজারের বিভিন্ন মন্ডপ থেকে প্রতিমা বহনকারী ট্রাকগুলো কক্সবাজার সমুদ্রসৈকতের দিকে আসতে থাকে। শহরজুড়ে নেওয়া হয় নিরাপত্তাব্যবস্থা। কক্সবাজার সৈকতের লাবণী পয়েন্টের উন্মুক্ত মঞ্চে চলে প্রতিমা বিসর্জনের অনুষ্ঠান।

এতে প্রধান অতিথি ছিলেন আওয়ামী লীগের দফতর সম্পাদক ও প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ সহকারী ব্যারিস্টার বিপ্লব বড়ুয়া। অনুষ্ঠানে বক্তব্য দেন স্থানীয় সংসদ সদস্য সাইমুম সরওয়ার কমল, সংসদ সদস্য আশেক উল্লাহ রফিক, সংসদ সদস্য কানিছ ফাতেমা আহমেদ, আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় ধর্মবিষয়ক সম্পাদক অ্যাডভোকেট সিরাজুল মোস্তফা, কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক মুহাম্মদ শাহীন ইমরান, ট্যুরিস্ট পুলিশের এসপি মো. জিল্লুর রহমান, কক্সবাজারের পুলিশ সুপার মাহফুজুল ইসলাম, কক্সবাজারের পৌর মেয়র মাহবুবুর রহমান, কক্সবাজার জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মজিবুর রহমান প্রমুখ। জেলা পূজা উদ্যাপন পরিষদের সভাপতি উজ্জ্বল করের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে বক্তব্য দেন জেলা পূজা উদ্যাপন পরিষদ, প্রশাসনের কর্মকর্তা, জনপ্রতিনিধি, সামাজিক নেতাসহ নানা সম্প্রদায়ের নেতৃত্ব। বিসর্জন মঞ্চ থেকে মন্ত্র উচ্চারণ শেষে সমুদ্রসৈকতে শুরু হয় বিসর্জন। এরপর একে একে পূজামন্ডপের প্রতিমা বিসর্জন দেওয়া হয় সাগরসৈকতে। পূজা উদযাপন পরিষদের সভাপতি উজ্জ্বল কর জানিয়েছেন, জেলায় ৩১৫টি মন্ডপে পূজার আয়োজন করা হয়েছে। এর মধ্যে ১৫১টি প্রতিমাপূজা আর ১৬৪টি ঘটপূজা।

সর্বশেষ খবর