শুক্রবার, ২৭ অক্টোবর, ২০২৩ ০০:০০ টা

ধ্বংসস্তূপের নিচে আটকা মানুষ

গাজায় হামলায় নিহত আরও ৩০, বহু আহত

প্রতিদিন ডেস্ক

ধ্বংসস্তূপের নিচে আটকা মানুষ

ইসরায়েলি বিমান গতকাল ভোরে অবরুদ্ধ গাজার খান ইউনিস এলাকায় কয়েকটি ভবন লক্ষ্য করে বোমা বর্ষণ করেছে। এতে ৩০ ফিলিস্তিনি নিহত ও বহু মানুষ আহত হয়েছেন। ধ্বংসস্তূপের নিচে অনেক মানুষ আটকা পড়ে আছেন। এর আগের রাতে ইসরায়েলি ট্যাংক ও পদাতিক বাহিনী উত্তর গাজায় আকস্মিক ঢুকে বিভিন্ন স্থাপনায় হামলা চালিয়েছে এবং সেখানে ধ্বংসযজ্ঞ চালানোর পর ফিরে গেছে।

সূত্র : রয়টার্স, আলজাজিরা, বিবিসি, হারেৎজ, দ্য গার্ডিয়ান, স্কাই নিউজ, দ্য স্টেটসম্যান। খবরে বলা হয়, খান ইউনিসের কয়েকটি বাড়ির ওপর ইসরায়েলি বিমান হামলায় ৩০ জন নিহত হয়েছেন এবং ধ্বংসস্তূপের নিচে কয়েক ডজন লোক আটকা পড়েছেন। গাজা উপত্যকার দক্ষিণাঞ্চলীয় খান ইউনিস শহরের নাসার হাসপাতাল থেকে মাত্র ২০০ মিটার দূরের ভবনে এ হামলা চালানো হয়। হামলায় অন্তত শতাধিক লোক হতাহত হয়েছেন। এদিকে ইসরায়েলি সেনাবাহিনী বলেছে, তারা গভীর রাতে ট্যাংক এবং পদাতিক বাহিনীর সহায়তায় গাজার অভ্যন্তরে ঝটিকা অভিযান চালিয়েছে। গণমাধ্যমের খবরে বলা হয়েছে, রাতভর এ অভিযানে অনেক ফিলিস্তিনিকে হত্যা করা হয়েছে এবং বহু স্থাপনাও ধ্বংস করা হয়। আইডিএফের বিবৃতিতে বলা হয়েছে, সেনাবাহিনীর পাঁচটি পদাতিক ইউনিটের মধ্যে অন্যতম একটি ইউনিট ‘গিভাতি ব্রিগেডের’ নেতৃত্বে এ অভিযানটি গাজায় ‘যুদ্ধের পরবর্তী পর্যায়ের’ প্রস্তুতি হিসেবে পরিচালনা করা হয়েছে। তারা নির্দিষ্ট লক্ষ্যবস্তুকে মাথায় রেখেই গাজায় প্রবেশ করে। সফল অভিযান শেষ করে উত্তর গাজা থেকে তারা বেরিয়ে এসেছে। তবে বিবৃতিতে ইসরায়েলি সৈন্যদের হতাহতের কথা উল্লেখ করা হয়নি। ইসরায়েল গাজায় পূর্ণ স্থল অভিযান চালানোর প্রস্তুতি হিসেবেই এই ঝটিকা অভিযান চালানো হয়েছে বলে মনে করছেন সামরিক বিশ্লেষকরা।

আরেক খবরে বলা হয়েছে, মধ্যপ্রাচ্যের চারপাশের ঘাঁটিতে বিমান প্রতিরক্ষা মোতায়েন করার জন্য আমেরিকা সময় চাওয়ার পর ইসরায়েল গাজায় তার পরিকল্পিত স্থল অভিযান বিলম্বিত করতে রাজি হয়েছে। মার্কিন ও ইসরায়েলি কর্মকর্তারা বলেছেন, ওয়াশিংটন তেলআবিবকে ‘চলতি সপ্তাহের শেষ পর্যন্ত’ পরিকল্পিত অভিযান বন্ধ রাখতে রাজি করিয়েছে। এদিকে সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, কুয়েত, ইরাক, জর্ডান এবং সিরিয়ার ঘাঁটিতে কয়েক ডজন বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা মোতায়েন করছে পেন্টাগন।

ইসরায়েলি কর্মকর্তারা বলেছেন, হামাসের হাতে আটক জিম্মিদের কূটনৈতিক প্রচেষ্টার মধ্য দিয়ে মুক্ত করার চেষ্টা চলছে। পাশাপাশি স্থল অভিযান বিলম্বিত করার সিদ্ধান্তের পেছনে গাজায় মানবিক সহায়তা পৌঁছানোর বিষয়টিও রয়েছে। গত সাত দিনে ইরাকে অন্তত ১০ বার এবং সিরিয়ায় তিনবার মার্কিন সেনা ঘাঁটি লক্ষ্য করে ড্রোন ও রকেট হামলা হয়েছে। তবে মার্কিন সেন্ট্রাল কমান্ড বা সেন্টকম প্রাথমিকভাবে এসব হামলায় ক্ষয়ক্ষতি বা হতাহতের খবর প্রকাশ করেনি। তবে মঙ্গলবার সেন্টকম এনবিসি নিউজকে জানিয়েছে, ১৮ অক্টোবর সিরিয়ার আল-তানফ ঘাঁটিতে ড্রোন হামলায় ২০ জন মার্কিন সেনা ‘সামান্য আহত’ হন।  এসব ঘটনা বিবেচনায় রেখে আমেরিকা তার মধ্যপ্রাচ্যের ঘাঁটিগুলোর নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করছে। পর্যবেক্ষকদের ধারণা, ইসরায়েল যদি গাজায় স্থল অভিযান চালায় তাহলে পুরো মধ্যপ্রাচ্যে যুদ্ধের দামামা বেজে উঠবে এবং মার্কিন ঘাঁটিগুলোতে গেরিলা হামলা বেড়ে যাবে। আরেক খবরে অবরুদ্ধ গাজায় ইসরায়েলের স্থল হামলা সম্পর্কে বলা হয়েছে, গাজা উপত্যকায় হামাসের সুড়ঙ্গগুলোতে নার্ভ গ্যাস ও রাসায়নিক অস্ত্র দিয়ে হামলা চালানোর পরিকল্পনা করেছে ইসরায়েল। এই হামলা যুক্তরাষ্ট্রের ডেল্টা ফোর্স কমান্ডোদের নজরদারিতে পরিচালনা করা হতে পারে। একটি সিনিয়র আরব সূত্র জানিয়েছে, যুক্তরাষ্ট্র থেকে ফাঁস হওয়া এক নথির তথ্য অনুসারে, হামাসের সুড়ঙ্গে প্রবেশ, প্রায় ২২০ জন জিম্মিকে উদ্ধার ও হাজারো হামাস যোদ্ধাদের হত্যার জন্য নার্ভ গ্যাস ও রাসায়নিক অস্ত্র ব্যবহার করে আকস্মিক হামলার সুবিধা নেওয়ার আশা করছে ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্র। সূত্র বলেছে, পরিকল্পনা হলো- আন্তর্জাতিকভাবে নিষিদ্ধ নার্ভ গ্যাস ও রাসায়নিক অস্ত্র দিয়ে হামলা চালিয়ে ফিলিস্তিনি স্বাধীনতাকামীদের হতচকিত করে দেওয়া।

সুড়ঙ্গগুলোতে বিপুল পরিমাণ নার্ভ গ্যাস পাম্প করা হবে। মার্কিন ডেল্টা ফোর্স এই কাজে নজরদারি করবে। এই গ্যাস মানুষের দেহকে ৬ থেকে ১২ ঘণ্টার জন্য নিশ্চল করে দেয়। সূত্র আরও বলেছে, এই সময়ের মধ্যে সেনারা সুড়ঙ্গে প্রবেশ, জিম্মিদের উদ্ধার ও হাজারো হামাস যোদ্ধাকে হত্যা করবে।

খবরে বলা হয়, গাজায় ইসরায়েলের সম্ভাব্য স্থল অভিযানে বিভিন্নভাবে জড়িয়ে পড়েছে যুক্তরাষ্ট্র। মার্কিন প্রতিরক্ষামন্ত্রী লয়েড অস্টিন প্রায় প্রতিদিন ফোনে কথা বলছেন ইসরায়েলি প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইয়োভ গ্যালান্তের সঙ্গে। শহুরে যুদ্ধের অভিজ্ঞতাসম্পন্ন মার্কিন সামরিক কর্মকর্তারা ইসরায়েল পৌঁছেছেন। দুটি বিমানবাহী রণতরী ইসরায়েলের কাছাকাছি অবস্থান করছে। আর ডেল্টা ফোর্স হলো যুক্তরাষ্ট্রের সেনাবাহিনীর স্পেশাল অপারেশনস  ফোর্স। জিম্মি উদ্ধার, সন্ত্রাস দমন, হত্যা বা আটক মিশনের জন্য তাদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। ইসলামিক স্টেট (আইএস) জঙ্গিদের কাছ থেকে জিম্মি উদ্ধারের অভিজ্ঞতা রয়েছে এই বাহিনীর। সংঘাত মধ্যপ্রাচ্যের বাইরেও ছড়িয়ে পড়বে : রাশিয়া হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে বলেছে, সংঘাত মধ্যপ্রাচ্যের বাইরেও ছড়িয়ে পড়তে যাচ্ছে। রুশ প্রেসিডেন্ট ভøাদিমির পুতিন সতর্ক করে বলেছেন, কিছু মানুষের অপরাধের জন্য গাজার নারী, শিশু ও বয়স্ক মানুষকে শাস্তি দেওয়াটা বড় ভুল। মস্কোয় বিভিন্ন ধর্মের নেতাদের সঙ্গে এক বৈঠকে পুতিন এ বিষয়ে বলেন, ‘আজ আমাদের মূল কাজ হচ্ছে রক্তপাত ও সহিংসতা বন্ধ করা। অন্যথায় এই সংকট আরও গভীর ও ভয়াবহ হয়ে উঠবে এবং ধ্বংসাত্মক পরিণতি ডেকে আনবে।’

কূটনীতিকদের লিবিয়া ছাড়ার নির্দেশ : লিবিয়ার পূর্বাঞ্চলভিত্তিক সংসদ ইসরায়েলকে সমর্থনকারী দেশগুলোর রাষ্ট্রদূতদের লিবিয়া ছেড়ে নিজ নিজ দেশে চলে যাওয়ার নির্দেশ দিয়েছে। অবরুদ্ধ গাজা উপত্যকায় গত ১৯ দিন ধরে দখলদার ইসরায়েলি সেনাদের বর্বর আগ্রাসনে সাড়ে ৬ হাজারের বেশি অসহায় নারী ও শিশু শহীদ হওয়ার প্রেক্ষাপটে এ কথা বলল লিবিয়ার পূর্বাঞ্চলভিত্তিক সংসদ। গত বুধবার লিবীয় পার্লামেন্ট এক বিবৃতিতে বলেছে, ‘আমরা দাবি করছি- যেসব রাষ্ট্র ইহুদিবাদী সত্তাকে তার অপরাধযজ্ঞে সমর্থন জোগায় তাদের রাষ্ট্রদূতদের অবিলম্বে লিবিয়া ত্যাগ করতে হবে।’ লিবিয়ার সংসদ প্রশ্নবিদ্ধ দেশগুলোতে জ্বালানি সরবরাহ বন্ধেরও হুমকি দিয়েছে। বিবৃতিতে আরও বলা হয়েছে, ‘যদি গাজায় ইহুদিবাদী শত্রুদের গণহত্যা বন্ধ না হয় তাহলে ইসরায়েলি হত্যাযজ্ঞ সমর্থনকারী রাষ্ট্রগুলোতে তেল ও গ্যাস রপ্তানি স্থগিত করার জন্য আমরা সরকারের কাছে দাবি জানাই।’ লিবিয়ার সংসদ গাজা আগ্রাসনে ইসরায়েলের প্রতি সমর্থন দেওয়ার জন্য আমেরিকা, ব্রিটেন, ফ্রান্স এবং ইতালিকে সতর্ক করেছে। লিবীয় সংসদ বলেছে, এ দেশগুলো গাজা উপত্যকায় অপরাধযজ্ঞ চালানোর জন্য ইহুদিবাদী ইসরায়েলকে সমর্থন করে, অথচ তারা মানবাধিকার এবং জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকারের বুলি আওড়ায়।

সমালোচনার মুখে বাইডেন : অবরুদ্ধ গাজা উপত্যকায় ইসরায়েলের  পৈশাচিক গণহত্যায় নিহতের সংখ্যা নিয়ে প্রশ্ন তোলায় মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের তীব্র সমালোচনা করেছে দ্য কাউন্সিল অন আমেরিকান-ইসলামিক রিলেশন্স বা কেয়ার। আমেরিকার এ মানবাধিকার সংগঠনটি বলেছে, শুধু গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ই যে নিহতের সংখ্যা প্রকাশ করছে তা নয়, বরং সাংবাদিকরা হিসাব রাখছেন এবং প্রতি মুহূর্তে বিধ্বস্ত ঘরবাড়ি  থেকে শত শত লাশ বেরিয়ে আসার খবর ও ছবি বিশ্বব্যাপী প্রচার হচ্ছে।

উল্লেখ্য, গত বুধবার হোয়াইট হাউসে এক সংবাদ সম্মেলনে জো বাইডেনকে প্রশ্ন করা হয়, ‘গাজায় ইসরায়েলি বিমান হামলায় এ পর্যন্ত ২৭০০ শিশুর মৃত্যু কি এ কথা প্রমাণ করে যে, বেসামরিক নাগরিকদের মৃত্যু এড়ানোর জন্য তেলআবিবের প্রতি ওয়াশিংটন যে আহ্বান জানিয়েছে তা মানা হচ্ছে না?’ এ প্রশ্নের উত্তরে মার্কিন প্রেসিডেন্ট বলেন, ‘ফিলিস্তিনিরা নিহতের যে সংখ্যা প্রকাশ করছে তার সত্যতার ব্যাপারে আমার সন্দেহ রয়েছে।’ বাইডেন আরও বলেন, ‘আমি নিশ্চিত যে নিরপরাধ মানুষ মারা যাচ্ছে এবং সেটি হচ্ছে যুদ্ধ শুরু করার মাশুল।’

কেয়ার এক বিবৃতিতে বলেছে, ‘সাংবাদিকরা গাজায় বিপুলসংখ্যক মানুষের হত্যাকান্ডের খবর দিচ্ছেন এবং ওই উপত্যকা থেকে অসংখ্য ভিডিও ছড়িয়ে পড়ছে যেখানে দেখা যাচ্ছে, ফিলিস্তিনি নারী ও শিশুদের ছিন্নভিন্ন লাশ ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। শহরের বিস্তীর্ণ এলাকার সমস্ত ঘরবাড়ি ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে।’ বিবৃতিতে আমেরিকার এ মানবাধিকার সংগঠনটি বলেছে, ‘প্রেসিডেন্ট বাইডেনের উচিত এর কিছু ভিডিও দেখে নিজেকে এই প্রশ্ন করা  যে, নিজেদের বসতবাড়ির ধ্বংসস্তূপ থেকে বের করে আনা শিশুদের লাশ কি সাজানো ছবি, নাকি যুদ্ধ শুরু করার মাশুল?’

এদিকে ফিলিস্তিনি বংশো™ভূত মার্কিন মানবাধিকার কর্মী আমের জাহরও গাজায় নিহত ফিলিস্তিনিদের সংখ্যা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করায় প্রেসিডেন্ট বাইডেনের কড়া সমালোচনা করেছেন। তিনি বলেছেন, ‘একজন মানুষ কতটা নীচ হলে এ কথা বলতে পারে যে, আমরা আমাদের মৃত্যুর সংখ্যা নিয়ে মিথ্যা বলছি?’

ফিলিস্তিনি নিহতের সংখ্যা ৭ হাজার ছাড়িয়েছে : গাজায় ইসরায়েলের অব্যাহত পাশবিক হামলায় শহীদের সংখ্যা ৭ হাজার ছাড়িয়ে গেছে। আহত বা নিখোঁজ হয়েছেন হাজার হাজার ফিলিস্তিনি। গাজার তথ্যকেন্দ্র সর্বশেষ এ পরিসংখ্যান দিয়েছে। গাজায় হতাহতদের বেশির ভাগই নারী ও শিশু। গত ২০ দিন ধরে গাজায় বর্বরোচিত হামলা চালাচ্ছে মার্কিন মদদপুষ্ট ইসরায়েলি বাহিনী। একইভাবে ফিলিস্তিনের পশ্চিম তীরেও ইসরায়েলের হত্যাযজ্ঞ অব্যাহত রয়েছে। সেখানে ৭ অক্টোবরের পর থেকে এ পর্যন্ত ১০৩ ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। এ সময়ের মধ্যে দখলদার বাহিনী ১৪৫০ জন ফিলিস্তিনিকে আটক করেছে।

সর্বশেষ খবর