শনিবার, ২৮ অক্টোবর, ২০২৩ ০০:০০ টা

দেশজুড়ে তীব্র গ্যাস সংকট

বিপদে শিল্পমালিকরা, বাড়ছে এলপিজিনির্ভরতা ভোগান্তি গ্রাহকের, পাম্পে গাড়ির দীর্ঘ লাইন

জিন্নাতুন নূর

দেশজুড়ে তীব্র গ্যাস সংকট

শীতের আগে এবারও দেশজুড়ে তীব্র গ্যাস সংকট দেখা দিয়েছে। এতে আবাসিক গ্রাহকরা চরম ভোগান্তিতে পড়েছেন। গ্যাস না পেয়ে নিরুপায় গ্রাহক ঝুঁকছেন তরলীকৃত পেট্রোলিয়াম গ্যাস (এলপিজি)-তে। কল-কারখানার উৎপাদন বন্ধ হয়ে যাওয়ায় বিপদে পড়েছেন শিল্পমালিকরা। রাজধানী ঢাকা ছাড়াও আশপাশের নারায়ণগঞ্জ, গাজীপুর, আশুলিয়া এবং চট্টগ্রামের শিল্প এলাকাগুলোতেও গ্যাস সংকটে উৎপাদন অনেকাংশে নেমে এসেছে। সিএনজি স্টেশনগুলোতে গ্যাসের কাক্সিক্ষত চাপ না থাকায় গাড়ির দীর্ঘ লাইন চোখে পড়ে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, মূলত দেশীয় গ্যাসক্ষেত্রগুলো থেকে গ্যাস উৎপাদন কমে আসায় এবং শিল্পে কমিয়ে সার-কারখানায় গ্যাস সরবরাহ বেশি করায় গ্যাসের সংকট দেখা দিয়েছে। এ ছাড়া হঠাৎ করে তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাসের (এলএনজি) সরবরাহও কমে যাওয়ায় এ সংকট আরও তীব্র হয়েছে।

বাংলাদেশ তেল, গ্যাস, খনিজ সম্পদ করপোরেশন (পেট্রোবাংলা) সূত্র বলছে, দেশে দিনে গ্যাসের চাহিদা ৩৮০ কোটি ঘনফুট। গত কয়েকদিন ধরে গড়ে সরবরাহ করা হচ্ছে ২৬৫ কোটি ঘনফুট। এর মধ্যে এলএনজি থেকে সরবরাহ করা হচ্ছে দিনে ৬০ কোটি ঘনফুট। যদিও দুটি ভাসমান এলএনজি টার্মিনাল থেকে দৈনিক ৮৫ কোটি ঘনফুট গ্যাস সরবরাহের কথা। দেশে বর্তমানে ২৮টি গ্যাসক্ষেত্র রয়েছে। দেশীয় গ্যাসক্ষেত্র থেকে সাধারণত দিনে ২২০ কোটি ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ করা হয়, যা এখন ১৫ কোটি ঘনফুটের মতো কমেছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দেশীয় গ্যাসক্ষেত্র থেকে উৎপাদন কমেছে। সরকারকে বিদ্যুৎ উৎপাদনে গ্যাস বেশি দিতে হচ্ছে। সার-কারখানায় সরবরাহ বাড়ানো হয়েছে। তাই শিল্প খাতে ভোগান্তি বেশি।

রূপান্তরিত প্রাকৃতিক গ্যাস কোম্পানি লিমিটেড (আরপিজিসিএল) দেশে এলএনজি আমদানি করে। তবে সংস্থাটি শীত সামনে রেখে বিদ্যুতের চাহিদা কম থাকায় নভেম্বর থেকে খোলাবাজার থেকে এলএনজি আমদানি কমিয়ে দেয়। সংকট দেখা দেওয়ায় আগামী দুই মাসে তিন থেকে চারটি এলএনজিবাহী কার্গো আনার পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। এরই মধ্যে দেশের দুটি এলএনজি টার্মিনালের একটির রক্ষণাবেক্ষণের সময় এসে গেছে। আর সেটি বন্ধ রাখা হলে গ্যাস সংকট আরও বাড়বে। এর আগে চলতি বছরের এপ্রিলে মার্কিন কোম্পানি এক্সিলারেট এনার্জির এলএনজি টার্মিনালটি রক্ষণাবেক্ষণের কথা থাকলেও গ্যাসের চাহিদা বেশি থাকায় রক্ষণাবেক্ষণ সময় পিছিয়ে দেওয়া হয়। আগামী ১ নভেম্বর রক্ষণাবেক্ষণের জন্য এই টার্মিনালটি পুরোপুরি বন্ধ করার কথা। যা চলবে অন্তত দুই মাস। তবে এবার টার্মিনালটি রক্ষণাবেক্ষণ না করে সময় পিছিয়ে দেওয়া হলে এটি বিকল হয়ে আরও প্রতিকূল পরিস্থিতি তৈরি করতে পারে বলে সংশ্লিষ্টরা আশঙ্কা করছেন।   

গ্যাস সংকটের অভিযোগ জানিয়ে প্রতিদিনই তিতাস গ্যাস কর্তৃপক্ষের কাছে শিল্প-কারখানার মালিকরা ফোন করছেন। তিতাস কর্তৃপক্ষ বলছেন, চন্দ্রা, টঙ্গী ও জয়দেবপুরসহ আশপাশে ৬০ কোটি ঘনফুট গ্যাসের চাহিদা আছে। কিন্তু এখন সরবরাহ করা হচ্ছে ৩৫ থেকে ৩৬ কোটি ঘনফুট। সামনেই বড়দিন, এ উপলক্ষে এখন পোশাক কারখানাগুলোতে পোশাক ফিনিশিংয়ের কাজ চলছে। যার শিপমেন্ট শিডিউল কয়েকদিনের মধ্যেই। কিন্তু গ্যাস সংকটের কারণে এখন এসব কারখানায় কাজ চরমভাবে বিঘিœত হচ্ছে। উৎপাদন ধরে রাখতে বিকল্প জ¦ালানি ব্যবহার করলে খরচ দ্বিগুণেরও বেশি হয়। শিল্পমালিকরা আশঙ্কা করছেন, এই গ্যাস সংকট দীর্ঘ হলে পোশাক খাতের ব্যবসায়ীরা ক্ষতির মুখে পড়বেন।    

রাজধানীর আবাসিক গ্রাহকদের মধ্যে বেশি গ্যাস সংকট দেখা দিয়েছে মোহাম্মদপুর, পান্থপথ, কাঁঠালবাগান, কলাবাগান, মিরপুর, পুরান ঢাকা, মুগদা, বাড্ডা, আশকোনা, পাইকপাড়া, রামপুরা, যাত্রাবাড়ী ও কল্যাণপুরে। রাজধানীর বিভিন্ন আবাসিক এলাকায় ভোর ৫টার দিকেই কমে যাচ্ছে গ্যাসের চাপ। দিনভর যে চাপ থাকে তাতে চুলা এত স্বল্প আঁচে জ্বলে যাতে রান্না করা সম্ভব নয়। মধ্যরাত ছাড়া এখন আর গ্যাস পাওয়া যায় না। তবে গ্যাস না থাকলেও গ্রাহকদের বিল পরিশোধ করতে হচ্ছে নিয়মিত। তীব্র গ্যাস সংকটে রাজধানীবাসী এখন এলপিজি সিলিন্ডার ব্যবহারে ঝুঁকছেন। তিতাস গ্যাস কর্তৃপক্ষ বলছেন, এক মাস ধরে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় গ্যাসের চাপ কম বলে তাদের কাছে অভিযোগ আসছে। এ জন্য রেশনিং করে গ্যাস দিতে হচ্ছে।

এ ছাড়াও রাজধানীর সিএনজি ফিলিং স্টেশনগুলোর সামনে এখন গ্যাস নিতে দেখা যাচ্ছে গাড়ির দীর্ঘ লাইন। চাহিদা অনুযায়ী গ্যাস সরবরাহ করতে হিমশিম খাচ্ছে ফিলিং স্টেশনগুলো। সিএনজি পাম্পে চাহিদা অনুযায়ী অর্ধেক গ্যাসও দেওয়া যাচ্ছে না। আগে যেখানে ৩ থেকে ৫ মিনিটে একটি গাড়িতে গ্যাস পূর্ণ করা সম্ভব হতো চাপ না থাকায় এখন সেখানে লাগছে ১৫ থেকে ২০ মিনিট।

নাকাল নারায়ণগঞ্জ, শিল্পের উৎপাদনে ধস : তীব্র গ্যাস সংকটে নাকাল পুরো নারায়ণগঞ্জ। শিল্প থেকে শুরু করে বাসাবাড়িতেও চরম গ্যাস সংকটে ধুঁকছেন গ্রাহক। বাসাবাড়িতে গ্যাস নেই বললেই চলে। শিল্প-কারখানায় উৎপাদন কমেছে প্রায় ৯০ শতাংশ। অভিযোগ উঠেছে, গ্যাসের চাপ কম থাকায় ১২ দিন ধরে নারায়ণগঞ্জের প্রায় ৫০০টি ছোট-বড় গার্মেন্ট ও প্রায় ৬০০টি ডায়িং কারখানার উৎপাদন কমে গেছে ৯০ শতাংশ। এতে চরম হতাশা প্রকাশ করে শিল্পমালিকরা জানিয়েছেন, যে কোনোভাবে গ্যাস প্রবাহ স্বাভাবিক করতে হবে। না হয় রপ্তানি আয়ে নামবে ধস, মালিকরা সময়মতো বেতন দিতে না পারলে শ্রমিক অসন্তোষ দেখা দেবে। শুরু হবে নানা অস্থিরতা।

ব্যবসায়িক সংগঠন বিকেএমইএর সাবেক প্রথম সহসভাপতি ও নারায়ণগঞ্জ ফতুল্লার ক্রোনি গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজের এমডি এ এইচ আসলাম সানি জানান, এভাবে চলতে থাকলে বিদেশি অর্ডার হারাতে হবে। উৎপাদন একেবারেই বন্ধ।

চট্টগ্রামে দৈনিক গ্যাস থাকে না ৬ ঘণ্টা : চট্টগ্রামে দৈনিক গ্যাসের চাহিদা ৩২৫ মিলিয়ন ঘনফুট। কিন্তু এখন গ্যাস মিলছে ২৮০ থেকে ২৯৫ মিলিয়ন ঘনফুট। দৈনিক ৪০ থেকে ৫০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাসের ঘাটতি থাকছে চট্টগ্রামে। গত শনিবার থেকে এ সমস্যা তৈরি হয়েছে। সংশ্লিষ্ট সূত্রমতে, শিগগিরই এ সমস্যার সমাধান হবে না। আগামী এক মাস এমন সংকট নিয়েই চলতে হবে নগরবাসীকে। প্রায় প্রতিদিনই সকাল ৯টা থেকে দুপুর ২টা পর্যন্ত গ্যাস সংকট থাকে। ফলে ভোগান্তি সঙ্গী হয়েছে নগরবাসীর। নগরের আসকারদীঘি পাড়ের গৃহিণী বিউটি সুলতানা বলেন, গত শনিবার থেকে কোনো আগাম ঘোষণা ছাড়াই সকাল ৮টা থেকে দুপুর ২টা পর্যন্ত গ্যাস থাকছে না। প্রথম দুই দিন আমরা দুর্ভোগে পড়েছি। এখন সকাল সকাল রান্না করে ফেলতে হচ্ছে।

কেজিডিসিএলের মহাব্যবস্থাপক (অপারেশন) আমিনুর রহমান বলেন, চট্টগ্রামে দৈনিক গ্যাসের চাহিদা ৩২৫ মিলিয়ন ঘনফুট। এর মধ্যে মহেশখালী থেকে পাওয়া যেত ২৮০ থেকে ৩০০ মিলিয়ন ঘনফুট। বাকিগুলো একটি কোম্পানি সরবরাহ করত। বর্তমানে প্রতিষ্ঠানটি সরবরাহ বন্ধ রেখেছে। তিনি বলেন, সামনে শুষ্ক মৌসুমে সার প্রয়োজন হবে। তাই সার উৎপাদনে গ্যাস সরবরাহ নিরবচ্ছিন্ন রাখতে হচ্ছে। তাছাড়া দিনের বেলায় বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানে গ্যাস সরবরাহ অক্ষুন্ন রাখতে হয়।

(প্রতিবেদনটি তৈরিতে সহায়তা করেছেন চট্টগ্রামের সিনিয়র রিপোর্টার রেজা মুজাম্মেল ও নারায়ণগঞ্জ প্রতিনিধি রোমান চৌধুরী সুমন)।

সর্বশেষ খবর