রবিবার, ২৯ অক্টোবর, ২০২৩ ০০:০০ টা

আকর্ষণীয় কাজের লোভ দেখিয়ে ফাঁদ

জিন্নাতুন নূর

আকর্ষণীয় কাজের লোভ দেখিয়ে ফাঁদ

আকর্ষণীয় বেতনে কাজের লোভ দেখিয়ে বাংলাদেশ থেকে ভারত, মধ্যপ্রাচ্যসহ বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশি নারীদের পাচার করা হচ্ছে। ভুক্তভোগীদের ‘টিকটক স্টার’, সুপার শপ, ড্যান্স বার, পারলার ও বিভিন্ন বাসাবাড়িতে কাজ দেওয়ার লোভ দেখিয়ে পাচারের ফাঁদ পাতে দুর্বৃত্তরা। ভারতে এসব নারীর জন্য বানানো হয় ভোটার আইডি কার্ড। বাংলাদেশ ও ভারতের একটি সংঘবদ্ধ চক্র চাকরির লোভ দেখিয়ে কিশোরী, তরুণী ও নারীদের পাচার করছে। এরপর তাদের দালালের কাছে বিক্রি করে দেওয়া হচ্ছে। আর একবার বিক্রি হয়ে গেলে তাদের ভারতের বিভিন্ন হোটেল ও পতিতালয়ে যৌনকাজ করতে বাধ্য করা হয়। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মনিটরিং সেল পাচার প্রতিরোধে কাজ করলেও জেলা পর্যায়ে এ বিষয়ে যে সচেতনতা তৈরির কথা তা হচ্ছে না। সম্প্রতি ভারতীয় পুলিশের কাছে গ্রেফতার পাচারকারী চক্রের এক সদস্য জানান, সাতক্ষীরা সীমান্ত থেকে পাচারকারী যে চক্রটিকে আটক করা হয় তাদের মাধ্যমে ইতোমধ্যে বাংলাদেশ থেকে ১ হাজার ৫০০ কিশোরী ও নারীকে ভারতে পাচার করা হয়েছে। এর বেশির ভাগই এখন ভারতের বেঙ্গালুরুতে অবস্থান করছে। তথ্য বলছে, পাচারের আগে পাচারকারীরা ভুক্তভোগীদের ‘টিকটক স্টার’ বানিয়ে দেওয়ার স্বপ্ন দেখায়। কেউ আবার তাদের পারলার ও ভারতের সুপার শপে কাজ দেওয়ার লোভ দেখিয়ে পাচারের ফাঁদ পাতে। দুবাইয়ে বাংলাদেশি নারী পাচারের ঘটনা এখন ‘ওপেন সিক্রেট’। এ ছাড়া নেপালেও নারীদের পাচার করা হচ্ছে। দুবাই ও নেপালে মেয়েদের ট্যুরিস্ট ভিসায় পাচারের তথ্য পাওয়া গেছে।

নারীদের পাচারের ফাঁদে ফেলতে তারা সামাজিক মাধ্যমের বিভিন্ন প্ল্যাটফরম ব্যবহার করে। নিজেদের পরিচয় গোপন করতে তারা ভিন্ন নামে ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খোলে। জানা যায়, বাংলাদেশ থেকে সবচেয়ে বেশি পাচার করা হচ্ছে ১০ থেকে ১৫ বছর পর্যন্ত বয়সী কিশোরীদের। আর মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে ১৬ থেকে ১৮ বছরের কিশোরীদের বয়স বাড়িয়ে ২২ থেকে ২৩ বছর দেখিয়ে পাচার করা হচ্ছে।

পুলিশের তথ্যে, ভোমরা-বেনাপোল সীমান্ত দিয়ে গত কয়েক মাসে হাজারের ওপর বাংলাদেশি নারীকে পাচার করা হয়েছে। জানা যায়, সীমান্ত এলাকায় পাচারকারীদের বাড়ি আছে। যেখানে ঢাকা ছাড়াও দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে পাচারের শিকার নারীদের রাখা হয়। সেখান থেকে তাদের মোটরসাইকেলে সীমান্ত এলাকায় নিয়ে ভারতীয় দালালদের কাছে দেওয়া হয়। ভারতের বেঙ্গালুরুতেও পাচারকারীদের অসংখ্য বাড়ি রয়েছে। সেখানে পাচারের শিকার নারীদের রাখা হয়। এসব বাড়ি থেকে পরে বিভিন্ন হোটেল ও বাড়িতে যৌনকাজের জন্য বাধ্য করে এদের। বেঙ্গালুুরু ছাড়াও পাচারকারীরা ভুক্তভোগীদের দিল্লি, গুরগাঁও, চেন্নাই, মুম্বাই, আহমেদাবাদ, কলকাতা, নদীয়াসহ অন্যান্য শহরে পাঠায়।

পাচারের সঙ্গে জড়িত বাংলাদেশি যুবক টিকটক বাবু ভারতের যে পাচারকারী চক্রের সঙ্গে জড়িত ছিল সেই চক্রের চার সদস্যকে সম্প্রতি ভারতীয় পুলিশ গ্রেফতার করেছে। এ চক্রটি এরই মধ্যে ভারতের বিভিন্ন স্থানে হাজারের ওপর নারীকে পাচার করেছে। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, কিছু চক্র আগে ভারতের যৌনসেবা গ্রহণকারীদের বাংলাদেশি মেয়েদের ছবি দেখায়। এরপর তারা যাকে পছন্দ করে তাকে প্লেনের টিকিট এবং জামাকাপড় কিনতে অগ্রিম টাকা পাঠায়। এর বিনিময়ে দালালরা প্রতি নারীর জন্য দৈনিক ১৫০০ ভারতীয় রুপি পায়।

গত ১৫ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশ থেকে বেনাপোল ইমিগ্রেশন চেকপোস্ট দিয়ে ভারতে পাচার হওয়া ১৯ নারী, পুরুষ ও শিশুকে বাংলাদেশের ইমিগ্রেশন পুলিশে হস্তান্তর করেছে ভারতের পেট্রাপোল পুলিশ। পাচারের শিকার নারীদের আইনি সহায়তা দেওয়া প্রতিষ্ঠান জাস্টিস অ্যান্ড কেয়ারের কর্মকর্তারা জানান, ভালো কাজ দেওয়ার কথা বলে পাচারকারীরা বাংলাদেশ থেকে নারীদের ভারতে নিয়ে যায়। বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে সীমান্ত রয়েছে প্রায় সাড়ে ৪ হাজার কিমি। এর মধ্যে সুরক্ষিত সীমান্ত প্রায় ৩ হাজার কিমি। বাকি অংশ নদী ও অরক্ষিত সীমান্ত। মূলত এ নদী ও অরক্ষিত সীমান্তের নিরাপত্তার ফাঁক গলে প্রতিবেশী দুই দেশের মধ্যে প্রতিদিন পাচারের ঘটনা ঘটছে। বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী জেলাগুলো থেকে পাচারের ঘটনা বেশি ঘট। শহরে ভালো বেতনে কাজ পাইয়ে দেওয়ার নামে গ্রামের সাধারণ নারীদের পাচার করা হচ্ছে।

বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি অ্যাডভোকেট সালমা আলী বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, নারী পাচার প্রতিরোধে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, মানবাধিকার সংস্থা সবাইকে মিলে কাজ করতে হবে। পাচারের ক্ষেত্রে যারা ঝুঁকিপূর্ণ তারা ঝুঁকিতেই রয়ে গেছে। এ-সংক্রান্ত সাতটি ট্রাইব্যুনাল হয়েছে কিন্তু সেগুলো কার্যকর নয়। দেশের আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের ইমিগ্রেশন কর্তৃপক্ষেরও এ বিষয়ে গাফিলতি আছে। তাঁর মতে, পাচারের ক্ষেত্রে যারা ঝুঁকিতে আছে তাদের বিকল্প উপার্জনের ব্যবস্থা করতে হবে। পাচারের মামলায় ভুক্তভোগীকে পর্যাপ্ত নিরাপত্তা ও আইনি সহযোগিতা দিতে হবে। পাচারসংক্রান্ত স্পর্শকাতর মামলাগুলো দ্রুত বিচারের ব্যবস্থা করতে হবে।

সর্বশেষ খবর