মঙ্গলবার, ৩১ অক্টোবর, ২০২৩ ০০:০০ টা
উপযুক্ত পাত্রেই রাজি অভিভাবক

থামছে না বাল্যবিয়ে

♦ বাল্যবিয়েতে বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান পঞ্চম, এশিয়ায় প্রথম ♦ কিশোরীরা ঠেকাচ্ছে বাল্যবিয়ে এগিয়ে আসছে প্রশাসনও ♦ ১৮ বছরের কম বয়সী মেয়েদের বিয়ের হার প্রায় ৪৫ শতাংশ

জিন্নাতুন নূর

থামছে না বাল্যবিয়ে

বাল্যবিয়ে বন্ধে দেশের প্রচলিত আইন, সামাজিক সচেতনতা এবং প্রশাসনের হস্তক্ষেপ কোনো কিছুই কাজে আসছে না। উল্টো বিশ্ব জনসংখ্যা পরিস্থিতি ২০২৩-এর প্রতিবেদন বলছে, ২০৪টি দেশ ও অঞ্চলের মধ্যে বাল্যবিয়ের হারের দিক দিয়ে বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান পঞ্চম ও এশিয়ায় প্রথম। দীর্ঘদিন ধরে দেশে বাল্যবিয়ের অন্যতম কারণ হিসেবে দরিদ্রতা ও সামাজিক নিরাপত্তাহীনতাকে দায়ী করা হলেও সম্প্রতি প্রকাশিত এক জরিপের তথ্য বলছে ভিন্ন কথা। এতে বলা হচ্ছে, সচ্ছল-অসচ্ছল উভয় পরিবারের অভিভাবকরাই ‘উপযুক্ত পাত্র’ পেলে নিজের অপ্রাপ্তবয়স্ক কন্যার ভবিষ্যতের কথা চিন্তা না করেই বাল্যবিয়ে দিয়ে দিচ্ছেন। আর অভিভাবকের ৫০ শতাংশই মনে করছেন, মেয়েদের বয়স ১৮ হওয়ার আগেই বিয়ে দিয়ে দেওয়া উচিত।

বাল্যবিয়ে নিয়ে ৫ অক্টোবর রাজধানীতে ‘বার্ন টু বি আ ব্রাইড, চাইল্ড ম্যারেজ : ট্রেন্ডস অ্যান্ড কজেম’ শীর্ষক একটি জরিপ প্রকাশ করে ব্র্যাকের সোশ্যাল এমপাওয়ারমেন্ট অ্যান্ড লিগ্যাল প্রটেকশন কর্মসূচি। সেখানে এসব তথ্য উঠে এসেছে। চলতি বছরের মার্চ ও এপ্রিলে দেশের ২৭ জেলার ২ হাজার ৮০ গ্রামের ৫০ হাজার পরিবারের ওপর জরিপটি পরিচালিত হয়। এতে দেখা যায়, ১৮ বছরের কম বয়সী মেয়েদের বিয়ের হার প্রায় ৪৫ শতাংশ। এর মধ্যে প্রায় ৭ শতাংশ ১৫ বছরের কম বয়সী। আর ৭০ শতাংশ কিশোরী বাল্যবিয়ের ঝুঁকিতে রয়েছে।

ব্র্যাকের জরিপ আরও বলছে, ২৭ জেলার মধ্যে পিরোজপুরে সবচেয়ে বেশি, প্রায় ৭৩ শতাংশ বাল্যবিয়ে হচ্ছে। এরপর রয়েছে চাঁপাইনবাবগঞ্জের অবস্থান, যা ৬৫ শতাংশের বেশি। এরপর নওগাঁয় ৬৫, ঠাকুরগাঁওয়ে প্রায় ৬৩ এবং জয়পুরহাটে ৬১ শতাংশের বেশি বাল্যবিয়ে হচ্ছে। যেসব জেলায় বাল্যবিয়ের হার কম এমন পাঁচটি জেলা হচ্ছে নেত্রকোনা (২৪ শতাংশ), মৌলভীবাজার (২৯ শতাংশ), বাগেরহাট (২৯ শতাংশ), ময়মনসিংহ (প্রায় ৩০ শতাংশ) এবং মানিকগঞ্জ (৩২ শতাংশ)। এ জরিপে অংশগ্রহণকারী ৪৪ শতাংশ অভিভাবক বলেছেন, ‘উপযুক্ত’ পাত্র পাওয়ায় তাদের কন্যাশিশুর বিয়ে দিয়েছেন। ৫০ শতাংশ অভিভাবক মনে করেন, ১৮ বছরের আগেই মেয়েদের বিয়ে হওয়া উচিত। এর বাইরে বাল্যবিয়ের অন্য কারণগুলোর মধ্যে আছে দরিদ্রতা, কম বয়সে বিয়ে দিলে বরপক্ষের যৌতুকের চাহিদা কম থাকা, সামাজিক নিরাপত্তার অভাব ইত্যাদি। বিশেষ করে মাধ্যমিক শিক্ষা কার্যক্রম শেষ করার দ্বারপ্রান্তে চলে আসা মেয়েরা সবচেয়ে বেশি বাল্যবিয়ের ঝুঁকিতে আছে। ১৬-১৭ বছর বয়সী মেয়েদের বিয়ের হার ৬৩ শতাংশের বেশি। জরিপ থেকে আরও জানা গেছে, ধনী ও মধ্যবিত্ত পরিবারেও বাল্যবিয়ের হার ৫০ শতাংশের ওপরে। আবার যেসব পরিবারে একটিমাত্র মেয়ে সেখানে বাল্যবিয়ের হার অস্বাভাবিক বেশি, প্রায় ৮৯ শতাংশ। হিন্দু মেয়েদের চেয়ে মুসলিম মেয়েদের বাল্যবিয়ে বেশি হচ্ছে। গাইবান্ধার পলাশবাড়ীতে নবম শ্রেণির এক ছাত্রী ৭ অক্টোবর স্কুল থেকে ফিরেই জানতে পারে, রাতে তাকে পাত্রপক্ষ দেখতে আসছে। ছেলে সৌদিপ্রবাসী শুনে ছাত্রীটির অভিভাবকরা খুব খুশি। আবার বিয়ের জন্য পাত্রপক্ষের যৌতুকের চাহিদাও কম। মেয়েকে শুধু দেখার কথা থাকলেও পছন্দ হওয়ায় আংটি পরিয়ে দুই দিন বাদেই তুলে নেয় পাত্রপক্ষ। মেয়েটির অভিভাবকরা বাংলাদেশ প্রতিদিনকে জানান, ছেলে ভালো রোজগার করে। আর মেয়েদের বেশি বয়সে বিয়ে দিলে যৌতুকও বেশি দিতে হয়। আশপাশের মানুষ এ নিয়ে নানা কথাবার্তাও বলে। তাই কম বয়সে বিয়ে দেওয়াই ভালো।

বাল্যবিয়ে ঠেকাচ্ছে কিশোরীরাই : প্রতিকূল পরিস্থিতিতেও আশার আলো দেখাচ্ছে বাল্যবিয়ের শিকার হতে যাওয়া কিশোরীরা। তারা কখনো নিজ বুদ্ধিতে, আবার কখনো প্রশাসনের সহায়তায় নিজের বিয়ে আটকে দিচ্ছে। গত জুলাইয়ের প্রথম সপ্তাহে সপ্তম শ্রেণির এক ছাত্রী ৯৯৯-এ কল দিয়ে নিজের বিয়ে বন্ধ করে। নাটোরের লালপুর উপজেলায় এ ঘটনা ঘটে। জানা গেছে, ঘটনার দিন রাতে মেয়েটির পরিবার তার বিয়ের আয়োজন করে। বরযাত্রীও বিয়েতে উপস্থিত হয়। কিন্তু বিয়েতে রাজি না থাকায় মেয়েটি জাতীয় জরুরি সেবা-৯৯৯-এ কল করে। খবর পেয়ে পুলিশ গিয়ে বিয়ে বন্ধ করে দেয়। এ ছাড়া ১০ অক্টোবর পিরোজপুরে নিজের বিয়ে বন্ধ করতে ইউএনও অফিসে এসে লিখিত আবেদন করে নবম শ্রেণির এক মাদরাসাছাত্রী। ছাত্রীটির আবেদন পেয়ে প্রশাসন তার বাড়ি গিয়ে বাল্যবিয়ে বন্ধ করে দেয়। মানবাধিকারকর্মী অ্যাডভোকেট এলিনা খান বলেন, ‘স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা চাইলে বাল্যবিয়ে প্রতিরোধ করতে পারেন। কিন্তু অনেক সময় আমরা উচ্চস্থানীয় সরকারি কর্মকর্তাদেরই বাল্যবিয়ের দাওয়াত খেতে দেখি। যে কাজি বাল্যবিয়ে পড়ান তিনি যদি জন্মনিবন্ধন ছাড়া বিয়ের রেজিস্ট্রেশন না করেন তাহলে বাল্যবিয়ের হার অনেকটাই রোধ করা সম্ভব।’

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর