শনিবার, ৪ নভেম্বর, ২০২৩ ০০:০০ টা

আগ্রহ শুধু বিসিএসে

সমাজে টাকার কর্তৃত্বের কাছে জ্ঞান অবমূল্যায়িত : সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী

আফরিদ সাররাফ আলী

গবেষণায় আগ্রহ দিন দিন কমছে শিক্ষার্থীদের। তাদের কাছে সরকারি চাকরিই প্রধান ও সবচেয়ে আকর্ষণীয় হয়ে উঠেছে। আর সরকারি চাকরির মধ্যে পছন্দের শীর্ষে স্থান করে নিয়েছে বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিসের মাধ্যমে বিভিন্ন চাকরি।

সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গ বলছেন, সরকারি চাকরিতেই সবচেয়ে বেশি ক্ষমতা, আর্থিক নিরাপত্তা আর বিভিন্ন সুযোগসুবিধা আছে। তাই অধিকাংশ শিক্ষার্থীই বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েই প্রস্তুতি নিতে থাকেন বিসিএসের। ক্লাসের পড়ায়ও তাদের মনোযোগ থাকে কম। গবেষণার তাৎক্ষণিক বাজারমূল্য না থাকায় শিক্ষার্থীরা গবেষণায় আগ্রহী হন না বলে জানিয়েছেন শিক্ষাসংশ্লিষ্টরা। আর শিক্ষাবিদরা বলছেন, সমাজে টাকার কর্তৃত্বের কাছে গবেষণা অবমূল্যায়িত হচ্ছে। তাই জ্ঞানের যে স্পৃহা থাকা উচিত তা কোথাও দেখা যাচ্ছে না।

জানা যায়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চলতি অর্থবছরে গবেষণায় ব্যয় ধরা হয়েছে ১৫ কোটি ৫ লাখ টাকা, যা মোট বাজেটের ১.৬৫ শতাংশ। গত অর্থবছরের সংশোধিত বাজেটে গবেষণায় বরাদ্দের হার ছিল ১.৬৩ শতাংশ এবং ২০২১-২২ অর্থবছরে ১.৩ শতাংশ। অর্থাৎ বিশ্ববিদ্যালয়ের বাজেটে গবেষণায় বরাদ্দ প্রতি বছর খুব অল্প পরিমাণে বাড়ছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বশেষ অর্থাৎ ২০২১-২২ শিক্ষাবর্ষের বার্ষিক বিবরণীতে গবেষণা প্রবন্ধের সংখ্যা দেখানো হয়েছে ১ হাজার ৫২৭টি। গবেষণা প্রকল্প রয়েছে ১৯৬টির বেশি। বই ও জার্নাল প্রকাশিত হয়েছে ১৪৮টি। সেকশন প্রকাশিত হয়েছে ১১৯টি, কনফারেন্স পেপার ও প্রবন্ধ উপস্থাপন করা হয়েছে ১১২টি। এ ছাড়া বইয়ের রিভিউ, রিপোর্ট ও অন্যান্য প্রবন্ধ রয়েছে ৬৫টি। এ শিক্ষাবর্ষে ৯১ জন পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেছেন।

ইউজিসির সর্বশেষ বার্ষিক প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০২১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবন্ধ, সাময়িকী, বই ও অন্যান্য মিলিয়ে প্রকাশনা সংখ্যা ছিল ২ হাজার ৫১৭টি। এখানে গবেষণা কেন্দ্র রয়েছে ৫৯টি।

টাইমস হায়ার এডুকেশন র‌্যাংকিংয়ের সর্বশেষ প্রতিবেদন অনুযায়ী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, ব্র্যাক ও নর্থ সাউথের অবস্থান ৮০১ থেকে ১০০০-এর মধ্যে; বুয়েট রয়েছে ১০০১ থেকে ১২০০-এর ঘরে। প্রতিবেদন অনুযায়ী গবেষণার পরিবেশের জন্য বুয়েটের স্কোর সর্বাধিক ১৫.৮। গবেষণার গুণমানের ক্ষেত্রে নর্থ সাউথের স্কোর সবচেয়ে বেশি ৭৬.১।

ইউজিসির বার্ষিক প্রতিবেদনমতে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রকাশনা সবচেয়ে বেশি। এ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রকাশনা ২ হাজার ৫১৭টি। বুয়েটের ৪৭৯টি, নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ৪৬১টি ও ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ৩২০টি। তথ্যমতে, চলতি বছরের জুনে অনুষ্ঠিত ৪৫তম বিসিএস প্রিলিমিনারি পরীক্ষায় অংশ নেন ২ লাখ ৬৮ হাজার ১১৯ জন শিক্ষার্থী। এ বিসিএসে প্রতিটি ক্যাডার আসনের বিপরীতে প্রতিযোগিতা করছেন ১১৬ জন। বিসিএসের চাকরি পেতে তরুণ-তরুণীদের আগ্রহের বিষয়টি লক্ষণীয় হয়ে উঠেছে। এ ব্যাপারে বাংলাদেশ সরকারি কর্ম কমিশনের সদস্য অধ্যাপক ড. সৈয়দ মো. গোলাম ফারুক বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘এমনিতেই আমাদের গবেষণার ঐতিহ্য কম। অতীতেও তেমন ছিল না। শিক্ষার্থীদের জন্য গবেষণার পরিবেশ সেভাবে উন্নত করা হয়নি। অন্যদিকে শিক্ষার্থীরা যখন অন্যান্য উপার্জনের পন্থার সঙ্গে তুলনা করে, তখন তারা সরকারি চাকরিতে সুযোগসুবিধা, স্থায়িত্ব ও নিশ্চয়তার বিষয়টি দেখতে পায়।’

মাস্টার্সে থিসিস নেওয়া ঢাবি শিক্ষার্থী খালিদ বিন আহমেদ সেজান বলেন, ‘যে শিক্ষক থিসিস করান, তাঁকে ক্লাস করাতে হয়, খাতা দেখা, ডিপার্টমেন্টের যাবতীয় অনেক কাজ করতে হয়। যার জন্য তিনি পুরোপুরি মনোযোগ দিতে পারেন না। অন্যদিকে গবেষণায় আগ্রহী শিক্ষার্থীরা অনেক ক্ষেত্রেই বিদেশে চলে যান। দেশে থাকলে বিসিএসের পড়া বাদ দিলে একটা বিকল্প আয়ের উৎস থাকা লাগবে।’

ঢাবির ইতিহাস বিভাগের শিক্ষার্থী মো. বেল্লাল হোসেন বলেন, ‘গবেষণায় যুক্ত থাকলে আগামী পাঁচ বছর পর আমার আর্থিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করা যাবে কি না তা নিয়ে আশঙ্কা রয়েছে।’ ঢাবি শিক্ষার্থী নুর ই আফরিন বলেন, ‘বিসিএসের মাধ্যমে পাওয়া চাকরিগুলো লোভনীয়। অন্য চাকরির চেয়ে সমাজে এর গ্রহণযোগতাও বেশি।’ জগ্ননাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী মো. সোহেল রানা বলেন, ‘ব্যক্তিগতভাবে আমি গবেষণাকে এগিয়ে রাখব। কিন্তু জীবনজীবিকা, সামাজিক অবস্থা আমাকে গবেষণার চেয়ে বিসিএসকে এগিয়ে রাখতে বাধ্য করছে।’ বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ফারহান ইশরাক ইমন বলেন, ‘প্রাইভেট চাকরিগুলোয় পরিশ্রমের তুলনায় আয় কম। গবেষণার সুযোগ দেশের বাইরে আবার বেশি। আমি দেশে পরিবারের সঙ্গে থাকতে চাই। তাই বিসিএসকেই প্রাধান্য দিই।’ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের পরিচালক অধ্যাপক ড. মো. আবদুল হালিম বলেন, ‘গবেষণার ফলাফল জাতীয় উন্নয়ন, পলিসি ও নীতি নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। আমাদের মধ্যে গবেষণার মানসিকতা থাকা জরুরি। গবেষণার মান এবং পরিমাণ বাড়াতে অর্থের বরাদ্দ যেমন বাড়ানো উচিত তেমন শিক্ষার্থীদের মধ্যে গবেষণা করার আগ্রহ ও উদ্দীপনাও সৃষ্টি করা উচিত।’ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক ড. সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, ‘বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় উন্নয়ন হলেও কর্মসংস্থান বৃদ্ধি পায়নি। কর্মসংস্থানের জন্য সরকারি চাকরিই প্রধান ও সবচেয়ে আকর্ষণীয়। সরকারি চাকরিতেই সবচেয়ে বেশি ক্ষমতা ও সুযোগসুবিধা আছে। তাই অধিকাংশ শিক্ষার্থীর ইচ্ছা থাকে বিসিএস পরীক্ষা দিয়ে একটা সরকারি চাকরি পাওয়ার। গবেষণার তো বাজারমূল্য নেই। বাজারে বিসিএস পরীক্ষা দিয়ে পাস করতে পারলে একটা চাকরি পাওয়া যাবে। আমাদের অর্থনৈতিক অবস্থা এর জন্য দায়ী। আমি শিক্ষার্থীদের কোনো দোষ দেব না। তাদের জীবিকা খুঁজতে হবে।’

তিনি আরও বলেন, ‘সমাজের ভিতর থেকেই জ্ঞানের মূল্য বাড়াতে হবে। সমাজে টাকার কর্তৃত্বের কাছে জ্ঞানের মূল্য অবমূল্যায়িত হচ্ছে। তাই জ্ঞানের স্পৃহা দেখা যাচ্ছে না। শিক্ষার্থীরাও গবেষণায় অনুপ্রাণিত হচ্ছে না। জ্ঞানের চর্চাকে উৎসাহিত করার দায়িত্ব সমাজের। এর জন্য সমাজব্যবস্থায় পরিবর্র্তন আনতে হবে। সেই পরিবর্তন আনার ক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয়কে ভূমিকা নিতে হবে।’

সর্বশেষ খবর