রবিবার, ৫ নভেম্বর, ২০২৩ ০০:০০ টা

৬ ঘণ্টায় ১২০০ ফিটনেস সনদ!

আরাফাত মুন্না ও হাসান ইমন

৬ ঘণ্টায় ১২০০ ফিটনেস সনদ!

মাত্র ৬ ঘণ্টায় প্রায় ১ হাজার ২০০ যানবাহনের ফিটনেস সনদ দেওয়ার ঘটনা ঘটেছে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) ঢাকার দুই কার্যালয়ে। বিআরটিএর ঢাকা মেট্রো সার্কেল-২ (ইকুরিয়া) ও ঢাকা মেট্রো সার্কেল-৪ (পূর্বাচল) কার্যালয়ে এ ঘটনা। এর বিপরীতে একই দিন রাজধানীর সবচেয়ে ব্যস্ত বিআরটিএ মিরপুর সার্কেলে (ঢাকা মেট্রো-১) মাত্র ৪৫টি এবং উত্তরা কার্যালয়ে (ঢাকা মেট্রো-৩) মাত্র ২৭টি গাড়ির ফিটনেস সনদ দেওয়া হয়েছে।

বিআরটিএর পরিসংখ্যান অনুযায়ী, গত সোমবার ইকুরিয়া কার্যালয়ে ৬২১ গাড়ি এবং পূর্বাচল কার্যালয়ে ৫৬৪ গাড়িকে ফিটনেস সনদ দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে পূর্বাচল কার্যালয়ের মোটরযান পরিদর্শক শামসুদ্দিন আহমেদ একাই দিয়েছেন ৪৮০ যানবাহনের ফিটনেস সনদ।

বাংলাদেশ প্রতিদিনের অনুসন্ধান বলছে, ওইদিন ইকুরিয়া ও পূর্বাচল বিআরটিএ কার্যালয়ে যেসব গাড়ির ফিটনেস সনদ দেওয়া হয়েছে, তার ১০ শতাংশ গাড়িও সরাসরি উপস্থিত হয়নি। দালাল চক্র ও অন্যান্য পদ্ধতিতে গাড়ির রেজিস্ট্রেশন নম্বর ও আর্থিক সুবিধা নিয়ে এসব অনুপস্থিত গাড়ির ফিটনেস সনদ দেওয়া হয়েছে। অনুসন্ধানে আরও জানা গেছে, দুই বিআরটিএ কর্যালয়ে সেদিন ছয়জন মোটরযান পরিদর্শক এসব ফিটনেস সনদ দিয়েছেন। সকাল ৯টা থেকে বিকাল ৪টা পর্যন্ত ৭ কর্মঘণ্টার মাঝে মধ্যহ্নভোজের বিরতি থাকে ১ ঘণ্টা। সে হিসাবে মাত্র ৬ ঘণ্টায় এই বিপুল সংখ্যক গাড়ির ফিটনেস সনদ দেন তারা। সে হিসাবে গড়ে ২ মিনিটের কম সময়ে প্রতি গাড়ির ফিটনেস সনদ দেওয়া হয়েছে।

পরিবহন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মাত্র এক কর্মদিবসে দুই বিআরটিএতে প্রায় ১ হাজার ২০০ যানবাহনের ফিটনেস সনদ দেওয়া অস্বাভাবিক। সঠিক পদ্ধতিতে কোনো ভাবেই এত কম সময় ও জনবল দিয়ে বিপুল সংখ্যক গাড়ির ফিটনেস সার্টিফিকেট ইস্যু করা সম্ভব নয়। তারা বলেন, প্রতিটি গাড়ি কমপক্ষে ৫ মিনিট করে পর্যবেক্ষণ করলেও উল্লিখিত সংখ্যক যানবাহনের ফিটনেস সনদ প্রদানে কমবেশি ১০০ ঘণ্টা প্রয়োজন। ফিটনেস সনদ প্রদানের জন্য মাঠে সরেজমিনে গাড়ি পরিদর্শন ছাড়াও পরিদর্শকদের ফাইলওয়ার্ক রয়েছে। এই সময়ের মধ্যে তারা গাড়ি পরিদর্শনই কীভাবে করলেন আর সনদই বা কীভাবে ইস্যু করলেন তা বোধগম্য নয়।

বিআরটিএর সংশ্লিষ্টরা জানান, যানবাহনের ফিটনেস সনদ প্রদানের জন্য প্রথমে গাড়ির ইঞ্জিন পরীক্ষা করতে হয় একজন মোটরযান পরিদর্শককে। এরপর গাড়ির রং, বডির কন্ডিশন, বিভিন্ন ধরনের সিগন্যাল লাইট, ধোঁয়া, হেড লাইট, ব্রেক পরীক্ষার বাধ্যবাধকতাও রয়েছে। ফলে একটি গাড়ি সঠিক পদ্ধতিতে পরিদর্শন করতে অন্তত ১৫ মিনিট সময় প্রয়োজন হবে। নির্দেশনা অনুযায়ী ফিটনেস সনদ নবায়নে আসা প্রতিটি গাড়ির ফাইল পর্যবেক্ষণের পাশাপাশি গাড়ির সঙ্গে সেলফি তোলারও বাধ্যবাধকতা রয়েছে মোটরযান পরিদর্শকদের। তবে গত সোমবার ওই দুই বিআরটিএ কার্যালয়ে এসব নিয়ম-কানুনের তোয়াক্কাই করেননি মোটরযান পরিদর্শকরা।

একদিনে এত ফিটনেস সনদ কীভাবে? এ প্রশ্নের উত্তর জানতে চাইলে বিআরটিএর ইকুরিয়া কার্যালয়েল সহকারী পরিচালক (ফিটনেস) জিএম নাদির হোসেন বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, আমরা প্রতিটি গাড়ি পরিদর্শন করেই ফিটনেস সনদ প্রদান করে থাকি। সুনির্দিষ্ট সময় উল্লেখ করে গাড়ি উপস্থিতির বিষয়ে জানতে চাইলে বিষয়টি এড়িয়ে যান তিনি। পরে একাধিকবার মোবাইল ফোনে কল করলে তিনি রিসিভ করেননি।

অন্যদিকে বিআরটিএর পূর্বাচল কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক (ফিটনেস) মোহাম্মদ নাসির উদ্দিন বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, রবিবার হরতাল থাকায় সোমবার গাড়ির চাপ বেশি ছিল। সাধারণত হরতাল অবরোধ কর্মসূচির পরদিন বিআরটিএতে গাড়ির চাপ বেশি থাকে। একই দিন মিরপুর ও উত্তরায় অনেক কম ফিটনেস সনদ দেওয়ার বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে তিনি বলেন, কিছু তো রেফারেন্স থাকেই। আর এই অফিসের বয়স এক বছরেরও কম উল্লেখ করে নতুন অফিস হিসেবে রিপোর্ট করা থেকে বিরত থাকতেও অনুরোধ করেন বিআরটিএর এই কর্মকর্তা।

এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে পরিবহন বিশেষজ্ঞ ও বুয়েটের এক্সিডেন্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (এআরআই) বিভাগের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ড. হাদিউজ্জামান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, এক দিনে এত বিপুল সংখ্যক ফিটনেস সনদ প্রদান একেবারেই অস্বাভাবিক ও অবাস্তব। তিনি বলেন, ফিটনেস একটি বৈজ্ঞানিক বিষয়। এখানে অনেক খুঁটিনাটি বিষয় পর্যবেক্ষণের প্রয়োজন হয়। শুধু যানবাহনের বাহ্যিক দিক দেখে এর ফিটনেস দেওয়া যায় না।

এই পরিবহন বিশেষজ্ঞ বলেন, এক দিনে একটি কার্যালয় থেকে ৬০০-৭০০ গাড়ির ফিটনেস সনদ ইস্যু করা কল্পনাতীত বিষয়। এটা আদৌ সম্ভব নয়। সঠিকভাবে যাচাই-বাছাই না করলে হয়তো বিপুল সংখ্যক গাড়ির ফিটনেস দেওয়া সম্ভব। তবে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে সঠিক যাচাই-বাছাই করে এক দিনে দুটি অফিস থেকে ১ হাজার ২০০ গাড়ির ফিটনেস সার্টিফিকেট প্রদান অবাস্তব ও অসম্ভব।

সর্বশেষ খবর