মঙ্গলবার, ৭ নভেম্বর, ২০২৩ ০০:০০ টা

রোহিঙ্গা বোঝা সামলাতে হিমশিম

ধারাবাহিকভাবে কমছে বিদেশি সহায়তা

মানিক মুনতাসির

রোহিঙ্গা বোঝা সামলাতে হিমশিম

বাংলাদেশে আশ্রিত রোহিঙ্গা নাগরিকদের ভরণপোষণে বিদেশি সহায়তা কয়েক মাস ধরে ধারাবাহিকভাবে কমছে। রোহিঙ্গা খাতের খরচ মেটাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে সরকারকে। একদিকে বিশ্বব্যাপী যুদ্ধবিগ্রহের কারণে তৈরি হয়েছে আর্থিক সংকট। যা বাংলাদেশের অর্থনীতিতেও গভীর সংকটের সৃষ্টি করেছে। এ ছাড়া জাতীয় সংসদ নির্বাচন ঘনিয়ে আসায় সবার মধ্যে রাজনৈতিক ও নির্বাচনি ব্যস্ততা বেড়েছে। ফলে রোহিঙ্গা খাতেও ঠিকমতো নজর দিতে পারছেন না সংশ্লিষ্টরা। ফলে রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে নিরাপত্তাজনিত ঘাটতিও দেখা দিয়েছে। অর্থবিভাগ সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক প্রতিবেদনের তথ্যমতে, ক্যাম্পগুলোর নিরাপত্তা প্রাচীর ঘেঁষে কাঁটাতারের বেড়া নষ্ট হয়ে যাওয়ায় অর্থসংকটে সেগুলোর সময়মতো মেরামতও করা যাচ্ছে না। ফলে সার্বিক নিরাপত্তা পরিস্থিতিতেও কিছুটা ঘাটতি দেখা দিয়েছে। আবার ক্যাম্পগুলোতে খাদ্য সহায়তাও কমে গেছে। ফলে নিজেদের চাহিদা মেটাতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর চোখকে ফাঁকি দিয়ে ক্যাম্পের বাইরে বেরিয়ে কাজ খুঁজছেন অনেক রোহিঙ্গা নাগরিক। যা সংশ্লিষ্ট এলাকায় স্থানীয়ভাবে নিরাপত্তার জন্য হুমকি বলে মনে করে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।

সূত্রমতে, দীর্ঘ ছয় বছরেরও বেশি সময় ধরে কক্সবাজার এলাকার বিভিন্ন ক্যাম্পে মিয়ানমার থেকে জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গা নাগরিকদের বসবাসের সুযোগ দেয় সরকার। তাদের জীবনধারণের জন্য জাতিসংঘের বিভিন্ন সংস্থা ও দেশ থেকে বিদেশি সহায়তা আসার পরিমাণ কমে গেছে। একই সঙ্গে সম্প্রতি আন্তর্জাতিক মহলে এই বৈশ্বিক সংকটটির গুরুত্ব কমে এসেছে বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা। এ জন্য সরকারের তরফ থেকে আন্তর্জাতিক মহলে আরও বেশি জোর লবিং করার পরামর্শ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তথ্যমতে, বর্তমানে কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফের ৩৩ আশ্রয়শিবিরে নিবন্ধিত রোহিঙ্গার সংখ্যা সাড়ে ১২ লাখ। এর মধ্যে ৮ লাখ এসেছে ২০১৭ সালের ২৫ আগস্টের পরের কয়েক মাসে। এ পর্যন্ত একজন রোহিঙ্গাকেও ফেরত পাঠানো সম্ভব হয়নি।

সূত্র জানায়, চলতি বছর বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি (ডব্লিউএফপি) রোহিঙ্গাদের জন্য খাদ্য সহায়তা ৩৩ শতাংশ কমিয়ে প্রতি মাসে মাথাপিছু ৮ ডলারে নামিয়ে আনা হয়েছে। ফলে ৪৫ শতাংশ রোহিঙ্গা পরিবার পর্যাপ্ত খাবার থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। এতে এসব পরিবারে পুষ্টিহীনতার আশঙ্কা করা হচ্ছে। এমনকি ক্যাম্পগুলোতে সামাজিক সংকট সৃষ্টিরও উপক্রম হয়েছে বলে মনে করে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। ২০২২ সাল পর্যন্ত বৈশ্বিক রোহিঙ্গা সহায়তা তহবিলের ৪০ শতাংশ আসত যুক্তরাষ্ট্র থেকে। ২০২২ সালে যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তার পরিমাণ ছিল ৩৩৬ মিলিয়ন ডলার। সেখানে চলতি বছর যুক্তরাষ্ট্র থেকে সহায়তা কমে ১০০ মিলিয়ন ডলারে নেমে আসায় তহবিল সংকটের সৃষ্টি হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র রোহিঙ্গা এবং তাদের আশ্রয়দাতা স্থানীয় জনগোষ্ঠীর জন্য ১ দশমিক ৭ বিলিয়ন ডলারের বেশি সহায়তা দিয়েছে। তবে সাম্প্রতিক সময়ে এ সহায়তার পরিমাণও কমিয়ে দিয়েছে দেশটি। সম্প্রতি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের আইনশৃঙ্খলা কমিটির এক সভায় আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছে, কক্সবাজারের রোহিঙ্গা শিবিরগুলোতে খাদ্য সংকট থেকে সামাজিক বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হতে পারে। এতে শিবিরগুলোতে অভ্যন্তরীণ অসন্তোষও ছড়িয়ে পড়তে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। কেননা রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে জাতিসংঘের খাদ্য সহায়তা কমে গেছে। এ ছাড়া অনুদানের অর্থ কমে যাওয়ায় কক্সবাজারে অবস্থানরত রোহিঙ্গাদের খাদ্য বরাদ্দ কমিয়ে দিয়েছে জাতিসংঘের বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি (ডব্লিউএফপি)। এতে অনেক রোহিঙ্গা পরিবার দুর্ভোগেও পড়তে পারে। যার কারণে তারা আরও বেশি অপরাধ কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়তে পারে বলেও আশঙ্কা করা হচ্ছে। এ জন্য রোহিঙ্গাদের মধ্যে পুষ্টিহীনতাও বাড়তে পারে। রোহিঙ্গাদের যে আন্তর্জাতিক সহায়তা দেওয়া হচ্ছে, তা চলতি বছর দুই ধাপে কমানো হয়েছে। যা এখন প্রতি মাসে মাথাপিছু ৮ ডলারে নেমে এসেছে। সহায়তার এ হার আরও কমার আশঙ্কা করা হচ্ছে। খাদ্য বরাদ্দ কমানোর ফলে রোহিঙ্গাদের সার্বিক দুর্গতি ও অপরাধপ্রবণতা বাড়বে বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা। যার একটা নেতিবাচক প্রভাব পড়বে পুষ্টি-স্বাস্থ্যসহ সার্বিক জীবনযাত্রায়। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন অতিরিক্ত সচিব নাম প্রকাশ না করার শর্তে বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, খাদ্য সংকট মানুষকে সামাজিক সংকটের দিকে ঠেলে দেয়। রোহিঙ্গাদের ক্ষেত্রে হয়তো সেটাই হতে যাচ্ছে। কেননা তারা সহায়তা পাওয়া সত্ত্বেও বাইরে কাজ করতে চায়। এতে তারা ক্যাম্পের বাইরে চলে আসে। যার ফলে ক্যাম্পের ভিতরে ও বাইরে আইনশৃঙ্খলার অবনতি ঘটছে। আবার অনেকে ক্যাম্প থেকে পালিয়েও যাচ্ছে। এতে ওই অঞ্চলে সামাজিক বিশৃঙ্খলা তৈরি হচ্ছে বলে মনে করেন তিনি।

 

সর্বশেষ খবর