মঙ্গলবার, ৭ নভেম্বর, ২০২৩ ০০:০০ টা

যৌতুকে নির্যাতন চলছেই

♦ ২০২২ সালে নির্যাতনের শিকার ১৬৫ জন ♦ গরম পানি ঢেলে, চুল কেটে, জিব কেটে, গায়ে আগুন দিয়ে চালানো হচ্ছে বর্বরতা

জিন্নাতুন নূর

যৌতুকে নির্যাতন চলছেই

দেশজুড়ে যৌতুকের কারণে চলা নির্যাতন থামছেই না। এ নির্যাতনের মাত্রা যেন দিনকে দিন বেড়েই চলেছে। সাধারণ ব্যক্তি থেকে শুরু করে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরাও যৌতুকের লোভে নিজের স্ত্রী, সন্তান এবং স্ত্রীর পরিবারের লোকজনের ওপর চালাচ্ছেন। শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের পাশাপাশি কেড়ে নিচ্ছেন ভুক্তভোগীর প্রাণ। গরম পানি ঢেলে, চুল কেটে, জিব কেটে এবং গায়ে আগুন দিয়ে চালানো হচ্ছে পাশবিক নির্যাতন। এই পাশবিকতায় নববধূ থেকে শুরু করে দুই সন্তানের মা কেউই রেহাই পাচ্ছেন না। পারিবারিক বিয়ে বা প্রেমের বিয়ে যাই হোক না কেন ভয়াবহ এই সামাজিক ব্যাধির ছোবলে একের পর এক প্রাণ দিতে হচ্ছে নির্যাতিত গৃহবধূকে।

বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের মাসিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, যৌতুকের কারণে ২০২৩ সালের অক্টোবর মাসে নির্যাতনের শিকার হন ১০ জন নারী। এর মধ্যে যৌতুকের কারণে হত্যা করা হয়েছে সাতজনকে। ২০২২ সালে যৌতুকের কারণে নির্যাতনের শিকার ১৬৫ জনের মধ্যে ৬৫ জনকে হত্যা করা হয়। এই ৬৫ জনের তিনজন ছিল কন্যাশিশু।

আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য হওয়ার পরও যশোরে এক পুলিশ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ৫ লাখ টাকা যৌতুক দাবি করার অভিযোগ উঠেছে। গত ১ নভেম্বর যশোর সদর উপজেলার তপসীডাঙ্গা গ্রামের ডলি খাতুন তার স্বামী ইমদাদুল ইসলামের বিরুদ্ধে মামলা করেন। চলতি বছরের ২৭ সেপ্টেম্বর যৌতুকের ৫ লাখ টাকা না পেয়ে ইমদাদুল তার স্ত্রী ডলিকে মারপিট করে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দেন।

সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুরে মিশু খাতুন (১৭) নামের এক গৃহবধূকে শ্বাসরোধে হত্যার অভিযোগে তার স্বামী ও শ্বশুরকে গ্রেফতার করে র‌্যাব-১২ এর সদস্যরা। এরপর চলতি বছরের ২৭ অক্টোবর পুলিশ অভিযান চালিয়ে অপরাধীদের গ্রেফতার করে। জানা যায়, মিশুর স্বামী জাহিদুল ইসলাম তার পরিবারের কথা মতো তাকে যৌতুকের টাকার জন্য চাপ দিতে থাকেন। মিশু টাকা দিতে না পারায় বিভিন্ন সময় তাকে বকাবকি ও মারধর করা হতো। টাকা না পেয়ে ভিকটিমের বাবার বাড়ির লোকজনের সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করেন জাহিদুল। যৌতুকের টাকা না পেলে মিশুকে মেরে ফেলার হুমকিও দেওয়া হয়। এর ধারাবাহিকতায় গত ২২ অক্টোবর যৌতুকের টাকা না পেয়ে জাহিদুল তার বাবা ইছাহাক প্রামাণিকের সহায়তায় তার স্ত্রীকে শ্বাসরোধে হত্যা করেন।

গাইবান্ধার সদর উপজেলায় যৌতুকের টাকা না পেয়ে বেবি বেগম (২৬) নামের এক গৃহবধূর জিহ্বা কাটার অভিযোগ উঠেছে তার স্বামী রিপন মিয়ার বিরুদ্ধে। এ ঘটনায় থানায় লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন ভুক্তভোগীর বোন। অক্টোবরের মাঝামাঝি এ ঘটনা ঘটে। বিয়ের পর থেকেই যৌতুকের জন্য বেবিকে মারধর করতেন তার স্বামী। বাধ্য হয়ে রিপনকে প্রায় দেড় লাখ টাকা দেওয়া হয়। এরপর আবারও ৫ লাখ টাকা যৌতুকের জন্য বেবিকে চাপ দিচ্ছিলেন রিপন। টাকা না পেয়ে বেবিকে মারধর করে রিপন। এতে জ্ঞান হারালে ধারালো ছুরি দিয়ে তার জিহ্বা কেটে দেওয়া হয়।

গত অক্টোবরের ২৪ তারিখ আড়াইহাজারে শ্বশুরবাড়ি থেকে যৌতুকের টাকা না পেয়ে স্ত্রী উম্মে হানী আক্তার হাবিবার চুল কেটে তার শরীরে গরম পানি ঢেলে দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে স্বামী ডালিম হোসেনের বিরুদ্ধে। এ ঘটনায় ভুক্তভোগীর স্বামীসহ শ্বশুর-শাশুড়ির বিরুদ্ধে থানায় নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে মামলা দায়ের করা হয়। এরপর পুলিশ ডালিমকে গ্রেফতার করেন। বিয়ের সময় ডালিমকে নগদ ৩ লাখ টাকা ও তিন ভরি স্বর্ণালংকার দেওয়া হলেও বিয়ের কিছুদিন পর থেকে তার স্ত্রীকে বাবার বাড়ি থেকে যৌতুক হিসেবে আরও ৫ লাখ টাকা আনতে বলে ডালিম। এতে রাজি না হওয়ায় তাকে শারীরিক ও মানসিকভাবে নির্যাতন করে আসছিল। পরপর কয়েকবার মারার পর একসময় উম্মে হানীর মাথার চুল কেটে এবং শরীরে গরম পানি ঢেলে গুরুতর জখম করা হয়। এ ঘটনায় স্থানীয় লোকজন মীমাংসা করে দিলে আবারও গত ২৪ অক্টোবর ৫ লাখ টাকা যৌতুক দাবি করে ডালিম। উম্মে হানী দিতে অনীহা জানালে তাকে আঘাত করলে তিনি গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েন। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, যৌতুক প্রতিরোধে যৌতুক নিরোধ আইন-২০১৮ থাকলেও আইনটির নানা ফাঁকফোকর থাকার কারণে অনেক ক্ষেত্রে অপরাধীরা পার পেয়ে যাচ্ছে। এ আইনে যৌতুকের সংজ্ঞা নির্ধারণে বলা হয়েছে মুসলিম ব্যক্তিগত আইন (শরিয়াহ) প্রযোজ্য হয় এমন ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে দেনমোহর, মোহরানা অথবা বিবাহের সময় বিবাহের পক্ষগণের আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব বা শুভাকাক্সক্ষী কর্তৃক বিবাহের কোনো পক্ষকে প্রদত্ত উপহারসামগ্রী যৌতুকের অন্তর্ভুক্ত হবে না। আইনের এ ব্যাখ্যার সুযোগে মূল্যবান অনেক সামগ্রী যৌতুকের নামে এখন দেওয়া-নেওয়া চলছে। প্রচলিত আইন অনুযায়ী বিয়েতে যৌতুক দাবি, গ্রহণ বা প্রদানের পাশাপাশি এক্ষেত্রে সহায়তা করার অপরাধে সর্বোচ্চ পাঁচ বছরের কারাদণ্ড ও ৫০ হাজার টাকার অর্থদণ্ডের বিধান রাখা হয়েছে।

বাংলাদেশ হিউম্যান রাইটস অ্যাসোসিয়েশনের প্রধান নির্বাহী অ্যাডভোকেট এলিনা খান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, দেশের আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলো অনেক সময় যৌতুকের অভিযোগ আমলে নিচ্ছে না এটি দুঃখজনক। আবার কিছু ক্ষেত্রে নিরপরাধ ব্যক্তিদের এই মামলায় জড়ানো হচ্ছে। এর ফলে প্রকৃত মামলাগুলো গতি হারিয়ে ফেলছে। তবে ঘৃণ্য এই প্রথা শুধু আইন প্রয়োগে বন্ধ করা যাবে না। এ জন্য প্রয়োজন সামাজিক সচেতনতা।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর