মঙ্গলবার, ৭ নভেম্বর, ২০২৩ ০০:০০ টা

বদলে যাচ্ছে ব্রিটিশ আমলের জুয়া আইন

♦ অনলাইন জুয়ায় পাঁচ বছরের দণ্ড ১০ লাখ টাকা জরিমানা ♦ ম্যাচ ফিক্সিংয়ে দণ্ড তিন বছর, জরিমানা ৫ লাখ ♦ পর্যটন, হোটেল বা ক্লাব এ আইনের আওতামুক্ত রাখতে পারবে সরকার

রুকনুজ্জামান অঞ্জন

বদলে যাচ্ছে ব্রিটিশ আমলের জুয়া আইন

ব্রিটিশ আমল। স্থানীয় জনগণকে জুয়া খেলা থেকে দূরে রাখতে ১৮৬৭ সালে ‘দ্য পাবলিক গ্যাম্বলিং অ্যাক্ট’ নামে একটি আইন করে তখনকার সরকার। বিস্ময়কর ব্যাপার হচ্ছে, এরপর ১৫৬ বছর পেরিয়ে গেলেও ওই আইনেই চলছে দেশে জুয়া প্রতিরোধ কার্যক্রম। এর ফলে অনলাইন জুয়া, অ্যাপভিত্তিক জুয়া কার্যক্রম প্রতিরোধে আইনি ব্যবস্থা নিতে পারছে না সরকার। এ অবস্থায় পুরনো আইনটিকে যুগোপযোগী করে ‘জুয়া প্রতিরোধ আইন, ২০২৩’ নামে একটি নতুন আইন করতে যাচ্ছে সরকার।

সংশ্লিষ্টরা জানান, প্রচলিত আইনে সর্বোচ্চ শাস্তি ৫০০ টাকা জরিমানা ও তিন মাসের জেল। এত অল্প দণ্ড দিয়ে দেশে জুয়া প্রতিরোধ করা যাচ্ছে না। ফলে নতুন আইনে শাস্তির মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে। এতে সর্বোচ্চ পাঁচ বছরের দণ্ড বা ১০ লাখ টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ডের বিধান যুক্ত করা হয়েছে।

প্রস্তাবিত আইনে বলা হয়েছে, সামাজিক যোগাযোগ বা অন্য কোনো অনলাইন বা ইলেকট্রনিক বা ডিজিটাল মাধ্যমে খেলাধুলা বা এ-সংক্রান্ত অন্য কোনো বিষয়ে বাজি ধরলে বা বাজি ধরার জন্য নগদ বা ক্যাশবিহীন ব্যাংকিং লেনদেন (যেমন- ডেবিট কার্ড, ক্রেডিট কার্ড ইত্যাদি) বা মোবাইল ব্যাংকিং লেনদেন (যেমন- বিকাশ, রকেট, নগদ, উপায়, পেপল ইত্যাদি) বা বিট কয়েনসহ অন্য যে কোনো ক্রিপ্টোকারেন্সি ইত্যাদি বা অন্য কোনো ধরনের ইলেকট্রনিক বা ডিজিটাল মাধ্যমে লেনদেন করলে তবে তা অনলাইন বেটিং বা জুয়া হবে। পর্যটনের স্বার্থে এ আইনে কিছু দায়মুক্তিও দেওয়া হয়েছে। খসড়ায় বলা হয়েছে, সরকার চাইলে পর্যটন বা বিশেষায়িত এলাকা, কোনো হোটেল বা ক্লাবকে এ আইনের আওতামুক্ত রাখতে পারবে।

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের যুগ্মসচিব এস এম ফেরদৌস বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, সংশোধিত জুয়া আইন নিয়ে মন্ত্রণালয়গুলোর মতামত নেওয়া হয়েছে। স্টেক হোল্ডারদের সঙ্গে সভা করে খসড়াও চূড়ান্ত করা হয়েছে। এখন মন্ত্রিসভায় উপস্থাপনের জন্য ৯ নভেম্বর আন্তমন্ত্রণালয় সভা আহ্বান করা হয়েছে। এ সভায় খসড়া অনুমোদন হলে প্রস্তাবিত আইনটি কেবিনেটে পাঠানো হবে।

কী আছে নতুন আইনে : সব ধরনের বাজি বা পণ ধরা, হাউজি খেলা, লটারি, আর্থিক ঝুঁকিপূর্ণ খেলা বা পুরস্কার প্রতিযোগিতা, ম্যাচ ফিক্সিং বা স্পট ফিক্সিং করা, দূরবর্তী জুয়া বা অনলাইন জুয়া যুক্ত হচ্ছে প্রস্তাবিত আইনে। জুয়ার সামগ্রী হিসেবে বাজির কাজে ব্যবহৃত যন্ত্রপাতি বা ডিভাইস যেমন : টেবিল গেমস, নন-ক্যাসিনো গেমস, আর্কেড গেমস, জুয়া খেলায় ব্যবহৃত অর্থ, কয়েন, কার্ড, খাতা ইলেকট্রনিক সামগ্রী, ইলেকট্রনিক গেমিং, বিংগো, হাউজি, লটারি, ডেডপুল, পোকার, কার্ড গেম, রুলেট, বোলিং, ডাইস গেম, ভিডিওগেম, সফটওয়্যার, ওয়েবসাইট, ডেটাবেজ বা অন্যান্য রেকর্ডপত্র অন্তর্ভুক্ত হবে। কর্মকর্তারা জানান, বর্তমানে অনলাইন জুয়ার প্রসার দেশব্যাপী ছড়িয়ে গেছে। ছাত্র, যুবা থেকে শুরু করে মিডিয়া পার্সোনালিটি এমনকি গ্রামে-গঞ্জের পেশাজীবী মানুষও অজান্তে অনলাইন বা ডিজিটাল জুয়ার ফাঁদে জড়িয়ে পড়ছে। কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়া হচ্ছে অনলাইন জুয়ার মাধ্যমে। এ জুয়ার খপ্পরে নিঃস্ব হচ্ছেন অনেকে। কেউ কেউ আত্মহত্যা করছেন, হত্যাকাণ্ডের ঘটনাও ঘটছে। সাম্প্রতিককালে পাতানো খেলা বা ম্যাচ ফিক্সিংয়ের ঘটনাও বেড়ে গেছে। এ কারণে প্রস্তাবিত আইনে অনলাইন জুয়াসহ এসব বিষয়ে জোর দেওয়া হয়েছে। একই সঙ্গে জুয়া খেলা যায় এমন সব প্রচলিত খেলাকেও আইনের আওতায় আনা হয়েছে। অনেকে ক্রিকেট খেলায় বলে বলে জুয়া ধরছে। ফুটবলের একটি দলের জয়-পরাজয় এমনকি পছন্দের খেলোয়াড়ের গোল নিয়েও জুয়া হচ্ছে। এ কারণে সরকারের অনুমোদিত প্রতিযোগিতার বাইরে ফুটবল, ক্রিকেট, কাবাডি, ভলিবল, অ্যাথলেটিক্স, মুষ্টিযুদ্ধ, নৌকাবাইচ, বিভিন্ন প্রকার রেস, তাস খেলা, ইনডোর গেমস বা অন্যান্য খেলাকে আর্থিক ঝুঁকিপূর্ণ খেলা হিসেবে চিহ্নিত করে জুয়া আইনে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। তবে শুধু বিনোদন বা মানব বিকাশের জন্য কোনো ব্যক্তি, ক্লাব, সংস্থা বা সংগঠন সরকারের অনুমোদন নিয়ে এসব খেলার আয়োজন করে তবে তা আর্থিক ঝুঁকিপূর্ণ খেলা হিসেবে বিবেচিত হবে না।

জুয়ার শাস্তি : প্রস্তাবিত আইনে অনলাইন জুয়ার অপরাধে সর্বোচ্চ পাঁচ বছরের দণ্ড বা অনূর্ধ্ব ১০ লাখ টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ড, ম্যাচ ফিক্সিংয়ের জন্য তিন বছরের কারাদণ্ড বা ৫ লাখ টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ড, স্পট ফিক্সিংয়ের জন্য দুই বছরের কারাদণ্ড বা ২ লাখ টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ড, আর্থিক ঝুঁকিপূর্ণ খেলার শাস্তি হিসেবে দুই বছরের কারাদণ্ড বা ২ লাখ টাকা জরিমানা, জুয়ার উদ্দেশ্যে পুরস্কার প্রতিযোগিতার জন্য এক বছর কারাদণ্ড বা ১ লাখ টাকা জরিমানা, বাজি বা পণ আয়োজনের দণ্ড তিন বছর কারাদণ্ড বা অনূর্ধ্ব ৫ লাখ টাকা জরিমানা, জুয়ার উদ্দেশ্যে হাউজির অননুমোদিত লটারির অপরাধে দুই বছরের কারাদণ্ড বা ২ লাখ টাকা জরিমানার এবং কোনো ব্যক্তি জুয়া আয়োজন করলে, জুয়ার স্থান দিলে তার বিরুদ্ধে পাঁচ বছরের কারাদণ্ড বা ১০ লাখ টাকার জরিমানা বা উভয় দণ্ডের শাস্তির বিধান রাখা হয়েছে। যদি কোনো ব্যক্তি এই আইনের অধীন কোনো নির্দেশ বা সরকারের নির্দেশ লঙ্ঘন করে তবে তার বিরুদ্ধেও পাঁচ বছরের কারাদণ্ড বা ১০ লাখ টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ডের বিধান যুক্ত করা হয়েছে প্রস্তাবিত আইনে। আরও বলা হয়েছে, এ আইনের অধীন দণ্ড ভোগ করার পর একই অপরাধ পুনঃপুন করলে তার বিরুদ্ধে সর্বোচ্চ দণ্ডের দ্বিগুণ শাস্তি হবে। এ আইনে মোবাইল কোর্টে দণ্ড দেওয়া যাবে। তবে মোবাইল কোর্ট মনে করলে উচ্চতর দণ্ডের জন্য নিয়মিত মামলা দায়ের করতে পারবে।

সর্বশেষ খবর