মঙ্গলবার, ৭ নভেম্বর, ২০২৩ ০০:০০ টা

অ্যাপে ঋণের ফাঁদ

মাহবুব মমতাজী

দেশে বাড়ছে ঋণ দেওয়ার অ্যাপ। এগুলোর মধ্যে ‘সান ওয়ালেট সিকিউর লোন’ নামের একটি অ্যাপ ব্যক্তিপর্যায়ে ৬ থেকে ২৪ শতাংশ সুদে ৫ হাজার থেকে ২ লাখ টাকা পর্যন্ত ঋণের প্রস্তাব দিচ্ছে। অ্যাপটি চলতি বছরের এপ্রিলে গুগলের প্লে স্টোরে আসে। এখন পর্যন্ত ১ লাখের বেশিবার ডাউনলোড হয়েছে বলে জানা গেছে। গতকাল তারা সর্বনিম্ন ঋণের পরিমাণ দিয়েছে ৩০ হাজার টাকা।

অ্যাপ খুলে ঋণ দেওয়ার নামে প্রতারণার ঘটনায় পুলিশের বিভিন্ন ইউনিট আটটি মামলার তদন্ত করছে। এসব প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ‘সান ওয়ালেট সিকিউর লোন’ একটি। এসব মামলায় গত আগস্টে চীনের ৭ নাগরিকসহ ২০ জনকে গ্রেফতার করেছে।

পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) সূত্রে জানা গেছে, চীনের নাগরিকরা অ্যাপভিত্তিক ক্ষুদ্রঋণের প্রলোভন দেখান। বিনা জামানতে ঋণ দেওয়ার কথা বলে মানুষকে ফাঁদে ফেলেন। ওই অ্যাপের মাধ্যমে বিভিন্ন ব্যক্তির জাতীয় পরিচয়পত্রের তথ্য, ই-মেইল, মোবাইলফোনের নম্বরসহ বিভিন্ন ব্যক্তিগত তথ্য নিয়ে নেওয়া হয়। এরপর কাউকে ৫ হাজার টাকা ঋণ দিয়ে ৫০ হাজার থেকে কয়েক লাখ টাকা দাবি করা হয়। গ্রাহক টাকা দিতে অস্বীকার করলে ব্যক্তিগত তথ্য সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে দেওয়াসহ মামলার ভয় দেখানো হয়। দেশে ঋণ দেওয়ার অন্তত ৩২টি অবৈধ অ্যাপ রয়েছে। এর মধ্যে ক্যাশ বক্স, হ্যাপি মানি, কুইক অ্যান্ড সেফ, লোন ট্রাই, গাইড লোন ইত্যাদি। মেটাভার্স ফরেন এক্সচেঞ্জ (এমটিএফই) গ্রুপ ইনকরপোরেটেড নামের একটি প্রতিষ্ঠান দেশের শত শত মানুষকে ফাঁদে ফেলে বিপুল অর্থ হাতিয়ে নিয়ে চলে যায় গত আগস্টে। ২৯ আগস্ট ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়ে সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও সংস্থার প্রতিনিধিদের নিয়ে বৈঠক হয়। সেখানে এ ধরনের জালিয়াতি ঠেকাতে টাস্কফোর্স গঠনের সিদ্ধান্ত হয়।

গত ১৮ মে রাজশাহীতে মোবাইলে ঋণ নেওয়ার অ্যাপ দিয়ে প্রতারণার ফাঁদ পেতে অর্থ আদায় চক্রের ১৭ জনকে গ্রেফতার করে সেখানকার বোয়ালিয়া মডেল থানা-পুলিশ। গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জ ও রাজধানীর বিভিন্ন জায়গায় অভিযান চালিয়ে তাদের আটক করা হয়। এরা হলেন- মাহিউদ্দিন মাহির, বিন সাদ মিনহাজ, ছানা মিয়া, লিটন, মেহেদী হাসান, হাসান ইমাম, বেলায়েত হোসেন, মারুফ আহমেদ, সাব্বির হোসেন, শিহাবুল ইসলাম, ফায়েজুল ইসলাম, সোহান খান, আবদুল ওয়াদুদ, ইতি আক্তার, স্মৃতি শাহ সৌমিক, আয়েশা ও রুবাইয়া। গত ২৯ মার্চ রাজশাহী নগরের বাসিন্দা আবুল এহসান ফেসবুকে ‘র‌্যাপিড ক্যাশ’ নামের একটি অ্যাপে ৩০ হাজার টাকা ঋণের লোনের বিজ্ঞাপন দেখেন। তিনি অ্যাপটি ডাউনলোড করে মোবাইল নম্বর, জাতীয় পরিচয়পত্র নম্বর ও লাইভ ছবি দিয়ে নিবন্ধন করেন। ওই দিন রাত সাড়ে ১০টার দিকে মোবাইল ব্যাংকিং সেবাদাতা প্রতিষ্ঠান নগদের মাধ্যমে তার হিসাবে ৭১৫ টাকা ঢোকে। রাত ১২টার দিকে অ্যাপ চেক করে দেখেন, তার নামে ৭১৫ টাকা জমা হয়েছে। ঋণের শর্তে বলা হয়, ৫৮৫ টাকা সুদসহ মোট ১ হাজার ৩০০ টাকা ৩ এপ্রিলের মধ্যে পরিশোধ করতে হবে। এত সুদ দেখে তিনি তাদের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করেন। কাস্টমার কেয়ারে ফোন দিয়ে বন্ধ পেলে ই-মেইলের মাধ্যমে তিনি টাকা পরিশোধ করবেন মর্মে একটি মেইল পাঠান। তখন প্রতারকরা একটি নম্বর দিয়ে টাকা পরিশোধ করতে বলেন। এরপর তিনি ১ হাজার ৩০০ টাকা পরিশোধ করেন।

ওই দিন আবুল এহসানের নগদ হিসাবে আবার আগের মতো টাকা জমা হয়। আবার ঋণের শর্ত দিয়ে সুদসহ পরিশোধ করতে বলা হয়। এবার সুদসহ পরিশোধ করতে না চাইলে প্রতারকরা ফোনে জানায়, তার মোবাইলের কন্টাক্ট লিস্ট, ছবি-ভিডিওসহ যাবতীয় তথ্য হ্যাক করেছেন তারা। টাকা পরিশোধ না করলে তার নগ্ন ছবি বানিয়ে সব কন্টাক্ট নম্বরসহ ফেসবুকে ছড়িয়ে দেবে। তিনি টাকা দিতে অস্বীকার করলে প্রতারকরা তার নগ্ন ছবি বানিয়ে তাকেসহ তার নম্বর তালিকায় থাকা কয়েকজনকে পাঠায়। পরে ভয়ে তিনি প্রতারকদের দাবি করা টাকা পরিশোধ করেন। অনলাইনে কিছু অ্যাপের মাধ্যমে ঋণ দেওয়ার প্রচারণা নিয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র মেজবাউল হক বলেন, এগুলো বন্ধের বিষয়ে বিটিআরসিকে একাধিকবার চিঠি দেওয়া হয়েছে। এসব বন্ধের দায়িত্ব বিটিআরসির। গত ২০ অক্টোবর ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি) রাজধানীর মতিঝিল ও বনশ্রী থেকে পাঁচজনকে গ্রেফতার করে। তারা হলেন- আরিফ হাসান রনি, সুমন, রাসেল, হাবিব ও খন্দকার মো. ফারুক। ডিবির সাইবার অ্যান্ড স্পেশাল ক্রাইম (দক্ষিণ) বিভাগের অতিরিক্ত উপকমিশনার (এডিসি) সাইফুর রহমান আজাদ জানান, গ্রেফতার ব্যক্তিরা বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান খুলে অনলাইনে চটকদার বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে লোন পাইয়ে দেওয়ার মিথ্যা আশ্বাসে কোটি কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছে। গত ফেব্রুয়ারিতে রাজধানীর এক যুবক ইউটিউবে প্যান্ডোরা ক্রেডিট ও মিনি কয়েন নামে দুটি অ্যাপের বিজ্ঞাপন দেখতে পান। কিছু না বুঝেই ওই যুবক অ্যাপ দুটিতে নিবন্ধন করে ফেলেন। নিবন্ধনের সময় অ্যাপ কর্তৃপক্ষ তার ফোনের সব তথ্য তাদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নেয়। রপর তাকে নিয়ে অশ্লীল ভিডিও বানিয়ে ব্ল্যাকমেল শুরু করে।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর