শুক্রবার, ১০ নভেম্বর, ২০২৩ ০০:০০ টা

তদন্ত ঝুলছে ৯ বছর ধরে

মাওলানা ফারুকী হত্যা

মাহবুব মমতাজী

তদন্ত ঝুলছে ৯ বছর ধরে

পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগে (সিআইডি) মাওলানা নুরুল ইসলাম ফারুকীর হত্যা মামলাটির তদন্ত ঝুলে আছে প্রায় ৯ বছর ধরে। চাঞ্চল্যকর ওই হত্যায় গ্রেফতার দুজন গত বছর আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছে। তাদের তথ্যেই বেরিয়ে আসে ওই হত্যা পরিকল্পনায় ছিল জেএমবি। আর বাস্তবায়ন করেছে আনসার আল ইসলাম। হত্যায় জড়িত দুজন জঙ্গিবাদের অন্য মামলায় গ্রেফতারের পর জামিনে বের হয়ে পলাতক রয়েছে।

সিআইডি সূত্র জানায়, গত বছরের ৫ মার্চ ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) অভিযানে গ্রেফতার হওয়া ভুয়া পাঁচ ডিবি সদস্যের মধ্যে সোহাগ ও বাপ্পী নামে দুই জঙ্গি ছিল ফারুকী হত্যায় জড়িত। হত্যাকান্ডের চার বছরের মাথায় ২০১৮ সালের ৩০ মে ঢাকার মুখ্য মহানগর হাকিমের আদালতে প্রথম জবানবন্দি দেয় হাদিসুর রহমান সাগর। দুর্ধর্ষ এই জঙ্গির স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দির মধ্য দিয়ে মূলত জট খুলতে শুরু করে টেলিভিশন উপস্থাপক ও ইসলামী ফ্রন্টের নেতা মাওলানা নুরুল ইসলাম ফারুকী হত্যার রহস্য। মামলার তদন্ত কর্মকর্তা সিআইডির অতিরিক্ত বিশেষ পুলিশ সুপার আবুল কাশেম গতকাল এ প্রতিবেদককে বলেন, মামলাটির তদন্ত প্রায় শেষ। দ্রুত এর চার্জশিট আদালতে জমা দেওয়া হবে।

আদালত সূত্র জানায়, সাগরের দেওয়া জবানবন্দিতে বেরিয়ে আসে ফারুকী হত্যা মিশনে জেএমবির দুটি অংশ সম্মিলিতভাবে অংশ নিয়েছিল। হত্যা মিশনে ৯ জন সরাসরি জড়িত। প্রধান ভূমিকায় ছিল আনোয়ার হোসেন ফারুক ওরফে জামাই ফারুক। হত্যার আগে আশুলিয়ায় বৈঠকে চূড়ান্ত হয় ছক। এই জবানবন্দির প্রায় ৪ বছর পর আবদুল্লাহ আল তাসনীম নামে আরেক জঙ্গি গত বছরের ২৭ মার্চ আদালতে জবানবন্দি দিয়েছে। তাসনীমের দেওয়া তথ্যের পর ফারুকী হত্যার রহস্য উদঘাটনের আশা জেগে উঠেছিল কিন্তু পরে আবারও তা থেমে যায়।

জানা গেছে, সাগর যখন জবানবন্দি দেয় তখন মামলাটির তদন্ত তদারকিতে ছিলেন সিআইডির তৎকালীন বিশেষ পুলিশ সুপার মোল্যা নজরুল ইসলাম। আর তদন্ত কর্মকর্তা ছিলেন অতিরিক্ত বিশেষ পুলিশ সুপার মাহমুদুল ইসলাম তালুকদার। তাসনীম যখন জবানবন্দি দেন তখন তদন্ত তদারকির দায়িত্বে ছিলেন সিআইডির ডিআইজি ইমাম হোসেন। তদন্ত কর্মকর্তা ছিলেন অতিরিক্ত বিশেষ পুলিশ সুপার জিসানুল হক। এর মাঝখানে আরও অন্তত ৫-৬ জন তদন্ত কর্মকর্তা পরিবর্তন হয়েছেন। তাসনীমের জবানবন্দি আদালতে রেকর্ডের আগে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তাকে তিন দিনের রিমান্ডে নিয়েছিল সিআইডি। এরপর দ্বিতীয় দফায় আরও ১০ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর হয়। এই রিমান্ডের দ্বিতীয় দিনেই জবানবন্দি দেয় তাসনীম। আদালত ও তদন্ত-সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, আগেই সাগর স্বীকার করেছিল ফারুকী হত্যায় জেএমবির ভিতর ও বাইরের দুটি গ্রুপ অংশ নেয়। সাধারণত মাওলানা সাঈদুর রহমানের গ্রুপকে জেএমবি ভিতরের গ্রুপ বলে অভিহিত করা হতো। আর আবদুর রহমান ওরফে সারওয়ার জাহান মানিক ও ডা. নজরুল ইসলামের গ্রুপ বাইরের গ্রুপ বলে পরিচিত। ফারুকী হত্যাকান্ডের আগের দিন ২০১৪ সালের ২৬ আগস্ট আশুলিয়ায় একটি বেসরকারি মেডিকেল কলেজের পাশে জেএমবির ভিতর ও বাইরের দুই গ্রুপ একত্রিত হয়। সেখানে উপস্থিত ছিল- মানিক, জামাই ফারুক, সাগর, আবদুলাহ আল তাসনীম, আশফাকসহ অন্তত ৯ জন। মূলত দুই গ্রুপ সমঝোতার জন্য একত্রিত হয়েছিল সেখানে। মানিক ও নজরুল গ্রুপের সদস্য হিসেবে সাগর ঘটনার দিন আবদুল্লাহপুর থেকে আশুলিয়ার বৈঠকে যায়। তবে সমঝোতা আলোচনার বাইরে ওই বৈঠকে ফারুকীকে হত্যার ব্যাপারে আলোচনা হয়।

 জঙ্গিদের মধ্যে কয়েকজন সেখানে তাদের ভাষায় ব্যাখ্যা দেন- ‘ফারুকী কোরআন, হাদিসের ভুল ব্যাখ্যা দিচ্ছেন। একইভাবে আল্লাহ ও নবীকে নিয়ে অপব্যাখ্যা দেন তিনি।’ পরদিন তার ফার্মগেটের বাসায় চলে যেতে বলা হয় সবাইকে। সাগর ছাড়াও তাসনীমের দেওয়া জবানবন্দিতেও এসব তথ্য পাওয়া গেছে। ২০১৪ সালের ২৭ আগস্ট রাতে রাজধানীর পূর্ব রাজাবাজারের ১৭৪ নম্বর বাসায় মাওলানা ফারুকীকে গলা কেটে হত্যার ঘটনা ঘটে। এ ঘটনায় শেরেবাংলানগর থানায় করা মামলাটি পরে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশে (ডিবি) স্থানান্তর করা হয়। ডিবির তদন্তে কোনো ফল না আসায় মামলাটি তদন্তের দায়িত্ব পায় সিআইডি। সিআইডি জানায়, ফারুকীর হত্যা মিশনের মূল পরিকল্পনাকারী ছিল জেএমবির ঢাকা অঞ্চলের আমির ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র তাসনীম। তবে মূল অপারেশনের কমান্ডার করা হয় জেএমবির দুর্ধর্ষ সদস্য জামাই ফারুককে। ২০১৭ সালে সে ভারতে গ্রেফতার হয়। ফারুকী হত্যা ছাড়াও ২০১৪ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি পুলিশ হত্যা করে ত্রিশালে জঙ্গি ছিনিয়ে নেওয়ার অন্যতম পরিকল্পনাকারী ছিল ফারুক। ২০১৪ সালের শেষের দিকে পুলিশ তাসনীমকে গ্রেফতার করে। আর মানিক সাভারে র‌্যাবের একটি অভিযানে নিহত হয়। এ ছাড়া হত্যায় জড়িত আশফাক নামে আরেকজন কারাগারে। দুজন আছেন পলাতক। আবদুল্লাহ আল তাসনীমের জবানবন্দিতে ফারুকী হত্যায় জাহিদুল ইসলাম সোহাগ ও বাপ্পী মিয়ার নাম পাওয়া যায়। এর আগেই তারা ডিবির রমনা বিভাগের এক অভিযানে ভুয়া ডিবি হিসেবে গ্রেফতার হয়। গত বছরের ৫ মার্চ যাত্রাবাড়ীর কাজলা ফুটওভার ব্রিজের পশ্চিম পাশে ডিবি পুলিশ পরিচয় দেওয়া পাঁচজনকে গ্রেফতার করে ডিবির রমনা বিভাগ। এদের মধ্যে জাহিদুল ইসলাম সোহাগ নিজেকে ডিবির এসি সোহাগ বলে পরিচয় দেয়। বাপ্পী মিয়া নিজেকে ডিবির এসআই বলে পরিচয় দেয়। এরা দুজনই মাওলানা ফারুকী হত্যায় জড়িত বলে তাসনীমের জবানবন্দিতে তথ্য পাওয়া গেছে।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর