রবিবার, ১২ নভেম্বর, ২০২৩ ০০:০০ টা

ভোটের মাঠে আত্মবিশ্বাসী আওয়ামী লীগ

অপেক্ষা তফসিলের সিলেট থেকে নির্বাচনি প্রচারণা শুরু করবেন সভানেত্রী, ভোটের পরও সতর্ক প্রহরায় থাকার সিদ্ধান্ত, শেষ সময়ে তিন নির্বাচনি চ্যালেঞ্জ

শরিফুল ইসলাম সীমান্ত

ভোটের মাঠে আত্মবিশ্বাসী আওয়ামী লীগ

টানা ১৫ বছর রাষ্ট্রক্ষমতায় থাকার রেকর্ড করল বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ। স্বাধীনতার পর এত দীর্ঘ সময় একটানা ক্ষমতায় থাকতে পারেনি আর কোনো রাজনৈতিক দল। দলটির লক্ষ্য এখন আগামী দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জনগণের ম্যান্ডেট নিয়ে টানা চতুর্থবারের মতো সরকার গঠন। ভোটের মাঠে আত্মবিশ্বাসী আওয়ামী লীগের দাবি, সরকারের উন্নয়ন কর্মকান্ডের জন্য দেশের ৭০ শতাংশ ভোটার শেখ হাসিনাকে আবারও প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দেখতে চায়। তবে নির্বাচনের আগ মুহূর্তে এসে তিন নির্বাচনি চ্যালেঞ্জের মুখে ক্ষমতাসীনরা।

নির্বাচনি বৈতরণী পার হতে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, পোশাক শ্রমিকদের মজুরি বৃদ্ধির আন্দোলন আর বিরোধী দলগুলোর সরকার পতনের এক দফা আন্দোলন- এই তিন সংকট মোকাবিলা করতে হবে আওয়ামী লীগকে। দলীয় সূত্রে জানা যায়, নির্বাচন কমিশনের তফসিল ঘোষণার অপেক্ষায় আছে আওয়ামী লীগ। তফসিল ঘোষণা হলেই ভোটের মাঠে পুরোপুরি মনোনিবেশ করতে পারবেন তারা। সিলেট থেকে শুরু হবে দলীয় সভানেত্রী বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার নির্বাচনি প্রচারণা। ইতোমধ্যে মাঠের অন্যতম বিরোধী দল বিএনপি নির্বাচনে আসবে ধরে নিয়েই নির্বাচনের আগে ও পরের সব পরিস্থিতি মোকাবিলার জন্য প্রস্তুতি নিতে বলেছেন সভানেত্রী। দলের সর্বশেষ কার্যনির্বাহী সভায় তিনি বলেছেন, বিএনপি মনোনয়ন বাণিজ্য আর নির্বাচন প্রশ্নবিদ্ধ করতে শেষ মুহূর্তে নির্বাচনে আসবে। দলের নেতা-কর্মীদের তাই নির্বাচনের আগে ও পরে মাঠে সতর্ক প্রহরায় থাকতে হবে। 

তবে, গত অক্টোবর থেকে শুরু হওয়া বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পের উদ্বোধনী ঘিরে অনুষ্ঠিত জনসমাবেশ ও মাঠের অবস্থান পর্যালোচনায় আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা এখন আত্মবিশ্বাসের তুঙ্গে। তারা বলছেন, স্বাধীনতার পর বাংলাদেশের আর কোনো সরকার দেশের জন্য এতসব উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে পারেনি। ডিজিটাল বাংলাদেশের টার্গেট পূরণের পর তাদের টার্গেট এখন ‘স্মার্ট বাংলাদেশ’ বিনির্মাণ। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের নির্বাচনি ইশতেহারে তুলে ধরা হবে স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণের রূপরেখা। 

আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য লে. কর্নেল (অব.) মুহাম্মদ ফারুক খান এমপি বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, গণতন্ত্রের মূল চালিকাশক্তি হলো উন্নয়ন। দেশে গণতন্ত্র আছে বলেই এত সব উন্নয়ন কর্মকান্ড আওয়ামী লীগ করতে পেরেছে। ভোট পেয়ে পাস করে গেলেই কাজ শেষ হয়ে যায় না। আমরা জানি, পাঁচ বছর পর আবার জনগণের কাছে আমাদের যেতে হবে ভোটের জন্য।

জনগণের আস্থা ধরে রেখে ভোটের পরিবেশ নিজেদের পক্ষে রাখতে সব সমস্যার দ্রুত সমাধানের জন্য মত দিচ্ছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। তারা বলছেন, সরকারের জন্য বিষয়গুলো চ্যালেঞ্জিং। দ্রুত সমাধান জরুরি। নির্বাচনে নিজেদের এগিয়ে রাখতে এবং জনগণের আস্থা ধরে রাখতে ক্ষমতাসীনদের অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে সব সংকট মোকাবিলা করতে হবে।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, সরকারের জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে মূল্যস্ফীতি। দ্রব্যমূল্যের লাগামহীন বৃদ্ধিতে দিন দিন কঠিন হয়ে উঠছে সাধারণ মানুষের জীবন। নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের চড়া মূল্যের কারণে তৃণমূলে অস্বস্তিকর পরিস্থিতিতে পড়তে হচ্ছে আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের।

৬ নভেম্বর বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, অক্টোবরে দেশের মূল্যস্ফীতির হার বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৯.৯৩ শতাংশ, যা সেপ্টেম্বরে ছিল ৯.৬৩ শতাংশ। অক্টোবরে খাদ্য মূল্যস্ফীতি সেপ্টেম্বরের ১২.৩৭ শতাংশ থেকে বেড়ে ১২.৫৬ শতাংশ হয়েছে।

অক্টোবরে খাদ্যবহির্ভূত মূল্যস্ফীতির হার রেকর্ড করা হয়েছে ৮.৩০ শতাংশ, যা আগের মাসে ছিল ৭.৮২ শতাংশ। গ্রামাঞ্চলে মূল্যস্ফীতি শহরাঞ্চলকে ছাড়িয়ে গেছে। গ্রামীণ এলাকায় মূল্যস্ফীতির হার সেপ্টেম্বরের ৯.৭৫ শতাংশ থেকে বেড়ে অক্টোবরে ৯.৯৯ শতাংশে উঠেছে।

ক্ষমতাসীনরাই বিভিন্ন সময় স্বীকার করছেন, দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধিতে কষ্টে আছে সাধারণ মানুষ। বিভিন্ন সময় বিভিন্ন পণ্যের মূল্যও নির্ধারণ করে দেওয়া হচ্ছে সরকারের পক্ষ থেকে। তারপরও অসাধু ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটের কারণে নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের মূল্য। অসাধু ব্যবসায়ীদের সিন্ডিকেটের বিষয়ে ৩ নভেম্বর জেলহত্যা দিবসের আলোচনা সভায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, দ্রব্যমূল্য নিয়ে নানাভাবে চক্রান্ত হচ্ছে। সবকিছুর উৎপাদন বেড়েছে তাহলে কীসের অভাব হবে। এগুলোর পেছনে কারা আছে? মজুদ করে রেখে দেবে কিন্তু বাজারে আনবে না। না এনে দাম বাড়িয়ে সরকারের বিরুদ্ধে কথা বলবে। এ ধরনের মজুদ কারা করে? মালপত্র থাকা সত্ত্বেও বাজারে না এনে জনগণের পকেট কাটার চেষ্টা যারা করে তাদের খুঁজে বের করতে হবে। তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে। উৎপাদন এতটুকু কমেনি। সবকিছুর উৎপাদন বেড়েছে। আন্তর্জাতিক বাজার থেকে অতিরিক্ত দাম দিয়ে আমরা কিনে নিয়ে আসছি। কিন্তু সেটা মানুষের কাছে পৌঁছাবে না কেন?

এদিকে, হঠাৎ উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে দেশের তৈরি পোশাক খাত। ন্যূনতম মজুরি বাড়ানোর দাবিতে আন্দোলনে নেমেছেন পোশাক শ্রমিকরা। গাজীপুর, মিরপুর, সাভার এলাকার রাস্তায় পোশাক কারখানার শ্রমিকরা প্রতিদিনই বিক্ষোভ করছেন। একাধিক কারখানায় অগ্নিসংযোগ ও ভাঙচুরের ঘটনার পাশাপাশি সড়ক অবরোধ, পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষ, গাড়ি ভাঙচুর, হতাহতের খবর পাওয়া যাচ্ছে প্রতিদিন। পরিস্থিতি সামলাতে না পেরে অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ হয়ে যাচ্ছে একের পর এক পোশাক কারখানা। ৭ নভেম্বর মজুরি বোর্ডের ষষ্ঠ সভায় শ্রমিকদের সর্বনিম্ন মজুরি সাড়ে ১২ হাজার টাকা নির্ধারণ করা হলেও পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আসেনি। ন্যূনতম মজুরি ২৫ হাজার টাকার দাবিতে আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছেন পোশাক শ্রমিকরা। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের ১০ নভেম্বর এক সংবাদ সম্মেলনে জানিয়েছেন, বিএনপি ও তার দোসররা শ্রমিক আন্দোলনে উসকানি দিচ্ছে। এ বিষয়ে কথা হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক সাব্বীর আহমেদের সঙ্গে। বাংলাদেশ প্রতিদিনকে তিনি বলেন, বাজার পরিস্থিতির সঙ্গে সামঞ্জস্য করে শ্রমিকরা তাদের ন্যূনতম মজুরি চাইবে, এটাই স্বাভাবিক। এর সঙ্গে রাজনীতির কোনো সম্পর্ক নেই। তবে, শ্রমিকদের আন্দোলনকে ভিত্তি করে তৃতীয় কোনো পক্ষ এর রাজনৈতিক ফায়দা লোটার চেষ্টা করতেই পারে। নির্বাচনের একদম শেষ মুহূর্তে এসে সরকারও চাইবে না এ সমস্যা দীর্ঘদিন জিইয়ে রাখতে। এ সংকট অচিরেই কেটে যাবে।

এদিকে, সহিংস রূপ নিয়েছে বিএনপিসহ সমমনা বিরোধী দলগুলোর সরকার পতনের এক দফা আন্দোলনও। এক দফা দাবিতে বিএনপি যুগপৎভাবে বিভিন্ন দল ও জোটকে নিয়ে আন্দোলন শুরু করে গত ১২ জুলাই। এরপর থেকে টানা তিন মাসে ঢাকাসহ সারা দেশে রোডমার্চ, পদযাত্রা, গণমিছিল, কালো পতাকা মিছিল, অবস্থান কর্মসূচি, সমাবেশ-বিক্ষোভসহ নানা কর্মসূচি পালন করে তারা। এরপর গত ২৮ অক্টোবর রাজধানীর নয়াপল্টনসহ নয়টি স্থানে মহাসমাবেশের ডাক দেয় বিএনপিসহ সমমনা দলগুলো। কিন্তু বিএনপির সমাবেশ শুরুর পর সংঘর্ষ বাধে পুলিশের সঙ্গে। সমাবেশ প- হলে হরতাল ডাকে দলটি। এরপর থেকে নিয়মিত বিরতিতে হরতাল-অবরোধের মতো কঠোর কর্মসূচি দিয়ে যাচ্ছে দলটি, যেখানে বিএনপিকে সমর্থন দিচ্ছে সমমনা দলগুলো। এসব কর্মসূচিতে প্রতিদিনই পুড়ছে গণপরিবহন। এ পর্যন্ত ৬৪টি বাসে অগ্নিকান্ডের ঘটনা ঘটেছে। বাসের ভিতর ঘুমন্ত অবস্থায় অগ্নিদগ্ধ হয়ে মারা গেছেন এক বাসচালক সহকারী। রাস্তায় কমেছে যান চলাচলের সংখ্যা। আতঙ্ক বাড়ছে জনমনে। সব মিলিয়ে অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে দেশ। আজ থেকে ফের শুরু হচ্ছে বিএনপি ও সমমনাদের চতুর্থ দফা অবরোধ।

এসব বিষয়ে জানতে চাইলে রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক হারুন-অর-রশিদ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, বিএনপির রাজনৈতিক কর্মসূচির সঙ্গে সাধারণ জনগণের সম্পৃক্ততা নেই। এ জন্য তাদের আন্দোলন সফল হচ্ছে না, হবেও না। শ্রমিকদের আন্দোলনের বিষয়টি অস্থায়ী। এর সমাধান দ্রুত হয়ে যাবে। মূল্যস্ফীতির কারণে মানুষের কষ্ট হচ্ছে, এটা সত্য। ভোটের আগে যতটুকু সম্ভব এর লাগাম টেনে ধরতে হবে। মনে রাখতে হবে, শুধু উন্নয়ন দিয়ে ভোটে জেতা যাবে না। পদ্মা সেতু পার হয়ে এসে চড়া মূল্য দিয়ে যদি চাল-ডাল কিনতে হয়, ভোটের ফলাফল কিন্তু বিপক্ষে চলে যেতে পারে।

সর্বশেষ খবর